ভিসি হারুন সম্পাদিত পাঠ্যবইয়ে বিকৃত তথ্য দেখুন এক নজরে - দৈনিকশিক্ষা

ভিসি হারুন সম্পাদিত পাঠ্যবইয়ে বিকৃত তথ্য দেখুন এক নজরে

নিজস্ব প্রতিবেদক |

চলতি শিক্ষাবর্ষের নবম-দশম শ্রেণির ‘পৌরনীতি ও নাগরিকতা’ পাঠ্যবইয়ে রাজনৈতিক দলের ইতিহাসে ভুল তথ্য ও বিকৃত করে প্রকাশ করা হয়েছে। বইটিতে সংবিধান সংশ্লিষ্ট কিছু তথ্য ভুলভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে। বইয়ে সংক্ষিপ্তভাবে আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাকালীন তথ্য ভুলভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে। অপরদিকে জামায়াতের পরিচয় দিতে গিয়ে দলটির মুক্তিযুদ্ধে বিরোধিতার তথ্য এবং এ দেশে নিষিদ্ধ হওয়ার তথ্য সম্পূর্ণ এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে। এছাড়া সংবিধান সংশ্লিষ্ট একাধিক তথ্য ভুলভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে।

প্রকাশিত বইয়ে ভুলের দায় এড়ানোর চেষ্টা করছেন এনসিটিবির কর্মকর্তারা। তাদের মতে বইয়ের লেখক সম্পাদকরা যা লিখে দিয়েছেন, তাই প্রকাশ করা হয়েছে। বইটি ঘেঁটে দেখা গেছে তা সম্পাদনা করেছেন জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য প্রফেসর ড. হারুন-অর-রশীদ। বইটি লিখেছেন ড. সেলিনা আক্তার, ড. সাব্বীর আহমেদ ও মো. রফিকুল ইসলাম। 

জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি) প্রকাশিত বইটির সপ্তম অধ্যায়ের ‘গণতন্ত্রে রাজনৈতিক দল ও নির্বাচন’ শীর্ষক শিরোনামে রাজনৈতিক দলের ইতিহাস তুলে ধরতে গিয়ে আওয়ামী লীগের ঠিকঠাক পরিচয় না দেয়া, বিএনপিকে ইসলামী দল ও মুক্তবাজার অর্থনীতির ধারকবাহক বানানো হয়েছে। জামায়াতের পরিচয় দিতে গিয়ে দলটির মুক্তিযুদ্ধে বিরোধিতার তথ্য এবং এ দেশে নিষিদ্ধ হওয়ার তথ্যটি সম্পূর্ণ চেপে যাওয়া হয়েছে। বিতর্কিত এসব তথ্যে বিভ্রান্তিতে হচ্ছে নবম-দশম শ্রেণির অন্তত ৩০ লাখ শিক্ষার্থী।

শুধু বিতর্কিত ইতিহাসই নয়, ওই বইয়ের ৫১নং পৃষ্ঠায় সংবিধান কত বার সংশোধন করা হয়েছিল, ৫৬নং পৃষ্ঠায় দেশের শাসন ক্ষমতা কার ওপরে ন্যস্ত, ৫৭নং পৃষ্ঠায় রাষ্ট্রপতি কীভাবে নির্বাচিত হন এবং তার মেয়াদ কতদিন, ৮৩নং পৃষ্ঠায় জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান কীভাবে নির্বাচিত হন, ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগ কীভাবে ক্ষমতায় আসে এসব ইতিহাসও ভুল ও বিকৃত করে প্রকাশ করা হয়েছে।

নবম-দশম শ্রেণির ‘পৌরনীতি ও নাগরিকতা’ পাঠ্যবইয়ের ৭৩ পৃষ্ঠায় বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের অংশে বলা হয়েছে ‘আওয়ামী লীগ এ দেশের সবচেয়ে পুরাতন ও বৃহত্তম রাজনৈতিক দল। ১৯৪৯ খ্রিষ্টাব্দের ২৩ জুন ঢাকায় আওয়ামী মুসলিম লীগ নামে দলটি প্রতিষ্ঠিত হয়। পরবর্তীতে সবার কাছে গ্রহণযোগ্য হওয়ার জন্য ১৯৫৫ খ্রিষ্টাব্দে দলের নাম থেকে মুসলিম শব্দটি বাদ দেয়া হয়। বাঙালি জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা ও শোষণমুক্ত সমাজ বিনির্মাণ আওয়ামী লীগের মূলনীতি। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে এই দল পাকিস্তানে ১৯৭০ খ্রিষ্টাব্দের সাধারণ নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠ আসন লাভ করে। আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে ১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দে আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধ পরিচালিত হয়। এর মধ্য দিয়ে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জন্ম হয়।’ আওয়ামী লীগ এই দেশের সবচেয়ে পুরাতন রাজনৈতিক দল কিনা তা নিয়ে গবেষণার কথা বলেছেন বিশ্লেষকরা। এছাড়া আওয়ামী লীগের পরিচিতি দিতে গিয়ে অত্যন্ত কম তথ্য উপস্থাপন করা হয়েছে বলে তারা মনে করেন।

বিএনপি সম্পর্কে একই পৃষ্ঠায়ই বলা হয়েছে, ‘বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) দেশের অন্যতম বৃহৎ রাজনৈতিক দল। মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান ১৯৭৮ খ্রিষ্টাব্দের ১ সেপ্টেম্বর এই দলটি প্রতিষ্ঠা করেন। বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের আদর্শ বা মূলনীতি হচ্ছে ইসলামী মূল্যবোধে বিশ্বাস, বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র ও মুক্তবাজার অর্থনীতি।’ বিএনপির একাধিক নেতা বলেন, বিএনপির পরিচিতি অত্যন্ত স্বল্প দেয়া হয়েছে। তবে আওয়ামী লীগের নেতারা বলছেন, মাঠেতো বিএনপি নেই। এতদিন পত্রিকায় ছিল। এবার পাঠ্যবইয়ে ঢুকে গেছে।

জামায়াতে ইসলামী সম্পর্কে বলা হয়েছে, ‘জামায়াতে ইসলামী একটি ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল। ১৯৪১ খ্রিষ্টাব্দের ব্রিটিশ ভারতে মাওলানা আবুল আলা মওদুদীর নেতৃত্বে এ দলের প্রতিষ্ঠা। তখন এর নাম ছিল জামায়াতে ইসলামী হিন্দ। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর এর নাম হয় জামায়াতে ইসলামী পাকিস্তান। স্বাধীন বাংলাদেশে ১৯৭৯ খ্রিষ্টাব্দের মে মাসে জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশ-এর আত্মপ্রকাশ ঘটে। বর্তমানে এর নাম বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী।’ বিশ্লেষকরা বলছেন, এখানেই ইতিহাস বিকৃতি ঘটিয়ে জামায়াতে ইসলামীকে কোমলমতি শিক্ষার্থীদের কাছে পবিত্র করে তোলা হয়েছে। জামায়াতের মুক্তিযুদ্ধ বিরোধীতার কথা না থাকা, ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল হিসেবে এ দেশে নিষিদ্ধ হওয়ার তথ্য না দেয়া এবং সর্বশেষ আদালতে যুদ্ধাপরাধের দায়ে অভিযুক্ত হওয়া জামায়াতে ইসলামী সম্পর্কে কোনো তথ্য না থাকা অবাক করেছে।

পাঠ্যবইটি ঘেঁটে আরো দেখা গেছে, এই বইয়ের ৫১নং পৃষ্ঠায় বলা হয়েছে, ‘১৯৭২ সালের সংবিধান প্রণয়নের পর থেকে এ পর্যন্ত বাংলাদেশের সংবিধান ১৬ বার সংশোধন করা হয়েছে।’ কিন্তু এই তথ্য সম্পূর্ণ ভুল। সঠিক হচ্ছে- ‘বাংলাদেশের সংবিধানে এ পর্যন্ত ১৭টি সংশোধনী আনা হয়েছে।’ 

৫৬নং পৃষ্ঠায় বলা হয়েছে, ‘দেশের প্রকৃত শাসন ক্ষমতা প্রধানমন্ত্রী ও তার মন্ত্রিপরিষদের হাতে ন্যস্ত। মন্ত্রিপরিষদই এখানে প্রকৃত শাসন ক্ষমতার অধিকারী এবং প্রধানমন্ত্রী হলেন সরকারপ্রধান। তার নেতৃত্বে মন্ত্রিপরিষদ দেশের শাসনকার্য পরিচালনা করে।’ এই তথ্যটিও ভুল। সঠিক হচ্ছে- ‘বাংলাদেশের সংবিধানের ৫৫ (২) ধারা অনুযায়ী প্রধানমন্ত্রী কর্তৃক বা তাহার কর্তৃত্বে এই সংবিধান অনুযায়ী প্রজাতন্ত্রের নির্বাহী ক্ষমতা প্রযুক্ত হইবে।’

৫৭নং পৃষ্ঠায় লেখা হয়েছে, ‘রাষ্ট্রপতি জাতীয় সংসদের সদস্যদের ভোটে নির্বাচিত হন। তার কার্যকাল ৫ বছর। রাষ্ট্রপতি পুনর্নির্বাচিত হতে পারেন, তবে কোনো ব্যক্তি পরপর দুই মেয়াদে অর্থাৎ টানা ১০ বছরের বেশি রাষ্ট্রপতি পদে থাকতে পারেন না।’ সঠিক তথ্যটি হবে, ‘বাংলাদেশের সংবিধানের ৫৫ (২) ধারা অনুযায়ী-একাধিকক্রমে হউক বা না হউক দুই মেয়াদের অধিক রাষ্ট্রপতি পদে কোনো ব্যক্তি অধিষ্ঠিত থাকিবেন না।’ 

বইয়ের ৮৩নং পৃষ্ঠায় লেখা হয়েছে, ‘জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান জেলার জনগণ দ্বারা সরাসরি নির্বাচনের বিধান রাখা হয়।’ সঠিক তথ্যটি হচ্ছে- ‘জেলা পরিষদ আইন-২০০০ অনুযায়ী প্রত্যেক জেলার অন্তর্গত সিটি করপোরেশন (যদি থাকে তাহলে) মেয়র ও কাউন্সিলর, উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান, ভাইস চেয়ারম্যান, পৌর মেয়র ও সদস্যদের সমন্বয়ে জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ও সদস্য নির্বাচনের জন্য নির্বাচকমণ্ডলী গঠিত হয়।’


জানা গেছে, রাজনৈতিক দলগুলোর নেতারা এসব ভুল তথ্যের কারণে এনসিটিবির ওপর বেজায় চটেছেন। তারা বিষয়টি নিয়ে লিখিতভাবে এনসিটিবির কাছে ব্যাখ্যা চাইবেন। এছাড়া একটি অসমর্থিত সূত্র বলছে, ইতিহাস ভুলের কারণে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় এনসিটিবির কাছে বইগুলো চেয়েছে। তারা সেখানে বিষয়গুলো খতিয়ে দেখবে।

জানতে চাইলে এনসিটিবি চেয়ারম্যান প্রফেসর নারায়ণ চন্দ্র সাহা গণমাধ্যমকে বলেন, কিছু ভুল হয়েছে। এগুলো বিশেষজ্ঞদের মাধ্যমে ঠিকঠাক করার প্রক্রিয়া চলছে। তবে রাজনৈতিক দলের তথ্যগত ভুলের দায় এনসিটিবির নয় বলে দাবি করে তিনি বলেন, এর দায় লেখক ও সম্পাদকের। তবু বইটি এখন বিশেষজ্ঞদের কাছে পাঠানো হবে। সংশোধনের প্রয়োজন পড়লে তা ঠিকঠাক করে ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হবে। 
বইটির সম্পাদক ও জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য প্রফেসর ড. হারুন-অর-রশীদের সঙ্গে কয়েক দফা যোগাযোগ করেও তার বক্তব্য নেয়া সম্ভব হয়নি।

আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মো. মাহবুব-উল আলম হানিফ গণমাধ্যমকে বলেছেন, পাঠ্যবইয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর পরিচয় দিতে গিয়ে যা বলা হয়েছে তাতে ঠিকঠাক তথ্য আসেনি। বিশেষ করে মুক্তিযুদ্ধের সময় জামায়াতের ভূমিকা কি ছিল তার বিস্তারিত বলা উচিত ছিল। জামায়াত এ দেশে নিষিদ্ধ হয়েছিল, এরকম জঘন্যতম ইতিহাস ভুলে যায় কী করে এনসিটিবি- প্রশ্ন এই নেতার।

এ বিষয়ে মন্তব্য জানতে প্রফেসর ড. হারুন-অর-রশীদের সাথে একাধিকবার দৈনিক শিক্ষাডটকমের পক্ষ থেকে টেলিফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তিনি ফোন ধরেননি।

রোজায় স্কুল: শিক্ষার্থী উপস্থিতি কম, নজরদারিও ঢিলেঢালা - dainik shiksha রোজায় স্কুল: শিক্ষার্থী উপস্থিতি কম, নজরদারিও ঢিলেঢালা পেনশন প্রজ্ঞাপনে উদ্বিগ্ন ঢাবি উপাচার্য - dainik shiksha পেনশন প্রজ্ঞাপনে উদ্বিগ্ন ঢাবি উপাচার্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের গবেষণা অনুদান করমুক্ত - dainik shiksha শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের গবেষণা অনুদান করমুক্ত ব্রাজিলে তীব্র গরমে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ - dainik shiksha ব্রাজিলে তীব্র গরমে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ শিক্ষা সহায়তা ট্রাস্টের নামে প্রতারণা, সতর্কীকরণ বিজ্ঞপ্তি - dainik shiksha শিক্ষা সহায়তা ট্রাস্টের নামে প্রতারণা, সতর্কীকরণ বিজ্ঞপ্তি উচ্চ মাধ্যমিকের সমমান পেলো ‘হেট’ - dainik shiksha উচ্চ মাধ্যমিকের সমমান পেলো ‘হেট’ আটকের ১৩ দিন পরেও বরখাস্ত হননি অধ্যক্ষ - dainik shiksha আটকের ১৩ দিন পরেও বরখাস্ত হননি অধ্যক্ষ please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0038609504699707