মফস্বলের শিক্ষক সমাজের বাজেট প্রত্যাশা - দৈনিকশিক্ষা

মফস্বলের শিক্ষক সমাজের বাজেট প্রত্যাশা

অধ্যক্ষ এস এম খায়রুল বাসার |

করোনা ভাইরাসের বৈশ্বিক মহামারিতে সম্পূর্ণ ভিন্ন প্রেক্ষাপটে আগামী ১১ জুন জাতীয় সংসদে ২০২০-২১ অর্থবছরের বাজেট প্রস্তাব পেশ করবেন অর্থমন্ত্রী। করোনা পরিস্থিতির কারণে বাজেট অধিবেশনের সকল আনুষ্ঠানিকতা সীমিত আকারে করা হলেও বাজেটের আকার সীমিত থাকছে না। বরং চলতি অর্থবছরের চেয়ে ৫ শতাংশ বাড়িয়ে আসন্ন বাজেটের সম্ভাব্য আকার ধরা হয়েছে ৫ লাখ ৫০ হাজার কোটি টাকা। ২০১৯-২০ অর্থবছরে বাজেটের আকার ছিল ৫ লাখ ২৩ হাজার ১৯০ কোটি টাকা। বাজেটের উপকারভোগী হিসেবে তাই দেশের বেসরকারি শিক্ষক সমাজও আসন্ন বাজেটে তাদের প্রত্যাশার প্রতিফলন দেখতে আগ্রহী।

বেসরকারি শিক্ষক সমাজের প্রাণের দাবি হলো তাদের চাকরি সরকারিকরণ। এই দাবি নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে তারা আন্দোলনও চালিয়ে আসছেন। তাদের দাবির যৌক্তিকতাও আছে। মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগ এবং মাদরাসা শিক্ষা অধিদপ্তরের তথ্যানুযায়ী দেশে ২ হাজার ৯২৯টি নিম্নমাধ্যমিক, ১৬ হাজার ৪৭৭টি মাধ্যমিক বিদ্যালয়, ৩ হাজার ১৯৪টি কলেজ এবং ৯ হাজার ২৯৪টি দাখিল, আলিম, ফাজিল ও কামিল মাদরাসা রয়েছে। এর মধ্যে সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের সংখ্যা ৬৬২টি, সরকারি কলেজের সংখ্যা ৬০৩টি এবং সরকারি মাদরাসার সংখ্যা ৪টি। অর্থাৎ ৩১ হাজার ৮৯৪ টি স্কুল-কলেজ-মাদরাসার মধ্যে মাত্র ১ হাজার ২৬৯টি সরকারি। অবশিষ্ট ৩০ হাজার ৬২৫টি প্রতিষ্ঠানই বেসরকারি। অর্থাৎ মাত্র ৪ শতাংশ স্কুল-কলেজ-মাদরাসা সরকারি হয়েছে। বাকি ৯৬ শতাংশই রয়েছে বেসরকারি।

আশার কথা হলো, এই সরকারি স্কুল-কলেজ-মাদরাসার মধ্যে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বর্তমান সরকার টানা তিন মেয়াদে ৬২৮টি স্কুল-কলেজ সরকারিকরণ করেছে। এর মধ্যে ৩১৪টি কলেজ ও ৩১৪টি হাই স্কুল। উল্লেখ্য, ২০০৯ খ্রিষ্টাব্দের আগে বর্তমান সরকার প্রথম মেয়াদে দায়িত্ব নেয়ার আগে দেশে সরকারি কলেজ ছিল মাত্র ২৮৯টি। (সূত্র: দৈনিক সংবাদ. ১৩ অক্টোবর ২০১৮) ২০১০ খ্রিষ্টাব্দের আগে সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয় ছিল মাত্র ৩৪৮টি। (সূত্র: প্রথম আলো, ০৩ জুলাই ২০১৯)

স্কুল-কলেজ সরকারিকরণের ক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রীর এই উদ্যোগকে আমরা সাধুবাদ জানাই। কিন্তু সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর সব-ই বিভাগ, জেলা এবং উপজেলা সদরে অবস্থিত। অথচ শহরের বাইরে মফস্বলে রয়েছে দেশের বেশিরভাগ স্কুল-কলেজ-মাদরাসা। দেশের দুই-তৃতীয়াংশ শিক্ষার্থীই মফস্বলের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে লেখাপড়া করে। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের তথ্যানুযায়ী মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক স্তরের মোট শিক্ষার্থীর ৭২ শতাংশ গ্রামাঞ্চলে লেখাপড়া করে। বাকি ২৮ শতাংশ লেখাপড়া করে শহরাঞ্চলে। কিন্ত সরকারিকরণের ক্ষেত্রে মফস্বলের প্রতিষ্ঠানগুলো বরাবরই থেকেছে বঞ্চিত। এইজন্য গ্রামের শিক্ষার্থীরা ভয়াবহ বৈষম্যের মধ্যে বেড়ে উঠছে। অথচ সংবিধানের ১৭ ধারায় বৈষম্যহীন শিক্ষার স্বীকৃতি দেয়া আছে। বৈষম্য নিরসনের একমাত্র পথ হচ্ছে- মফস্বলের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোকে সরকারিকরণের অগ্রাধিকার দেয়া।

শহর এলাকার  প্রতিষ্ঠানগুলোর স্বক্ষমতা বেশি। বিশেষ করে উপজেলা সদর পর্যন্ত প্রতিষ্ঠানগলোতে অপেক্ষাকৃত স্বচ্ছল ব্যক্তিদের সন্তানেরা পড়ালেখা করে। শুধু সন্তানের মানসম্মত লেখাপড়ার জন্য গ্রামের স্বচ্ছল ব্যক্তিরা শহরে বসবাস গড়ে তোলে এমন ভুরিভুরি নজির রয়েছে। কিন্তু অস্বচ্ছল ব্যক্তিরা অর্থের অভাবে তাদের সন্তানদের শহরের মানসম্মত প্রতিষ্ঠানে পড়াতে পারে না। একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান যখন সরকারি হয়, তখন সবচেয়ে বেশি উপকৃত হয় শিক্ষার্থীরা। সরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে অবকাঠামোসহ অন্যান্য অনেক সুবিধা বেড়ে যায়। শিক্ষার্থীরা কম খরচে পড়তে পারে। আর্থিক সুবিধা, প্রশিক্ষণ সুবিধাসহ বিভিন্ন সুবিধার কারণে শিক্ষকদের মান অনেক ভালো হয়। ফলে শিক্ষার্থীদের মানও বেড়ে যায়। সুতরাং মফস্বলের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো সরকারিকরণ না করলে শিক্ষার মান সেই তিমিরেই থেকে যাচ্ছে। তাছাড়া মফস্বলের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো সরকারিকরণ করার আরও অনেক যৌক্তিকতা আছে।

সরকারিকরণের মূল উদ্দেশ্য হওয়া উচিৎ সকলের জন্য মানসম্মত শিক্ষার ব্যবস্থা করা। কিন্তু বাস্তবতা হলো শিক্ষাক্ষেত্রে শহরের তুলনায় গ্রাম ব্যাপক বৈষম্যের শিকার। এর একটি বড় কারণ হলো দরিদ্র ও পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠির বসবাস গ্রামেই। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক শিক্ষার ব্যয় সংক্রান্ত গবেষণায় বলা হয়েছে, শহরের একটি এমপিওভুক্ত প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীর পেছনে অভিভাবক গড়ে সাড়ে ৯ হাজার টাকা ব্যয় করে। অথচ মফস্বলের একটি স্কুলে এর পরিমাণ প্রায় ২ হাজার টাকা। ব্যাপক বৈষম্যের কারণে উচ্চ মাধ্যমিকের মতো উচ্চশিক্ষার সম্পন্নেও শহরের তুলনায় অনেক পিছিয়ে গ্রামীণ জনগোষ্ঠী। বিবিএসের পরিসংখ্যান বলছে, শহরে উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষা সম্পন্ন করছে ১১ দশমিক ১ শতাংশ মানুষ। গ্রামে এ হার মাত্র ৬ শতাংশ। শহরাঞ্চলে উচ্চশিক্ষার হার ৮ দশমিক ৬ শতাংশ। গ্রামে এ হার এখনো ২ দশমিক ৩ শতাংশের মধ্যে সীমিত। শহর ও গ্রামের শিক্ষার এ বৈষম্য আবার নারীদের ক্ষেত্রে তুলনামূলক বেশি। শহুরে নারীর উচ্চশিক্ষা গ্রহণের হার যেখানে ৫ দশমিক ৯ শতাংশ, সেখানে গ্রামের নারীদের মধ্যে এ হার মাত্র ১ দশমিক ২ শতাংশ। সুতরাং পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীকে লেখাপড়ার ব্যয়ে সমতার সৃষ্টি করার জন্যেও মফস্বলের প্রতিষ্ঠানগুলোকে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে সরকারিকরণ করা দরকার।

জেএসসি, এসএসসি, এইচএসসি এবং এই স্তরের সমমান পরীক্ষার ফলেও গ্রাম ও শহরের মধ্যে রয়েছে বিস্তর ফারাক। ফলে গ্রামীণ ও শহুরে বৈষম্য বেড়েই চলছে।  গ্রাম বা মফস্বলের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে ইংরেজি ও বিজ্ঞান বিষয়সমূহের জন্য পর্যাপ্ত শিক্ষকের ঘাটতি রয়েছে। তদুপরি শ্রেণিকক্ষ, বিজ্ঞাণাগার, লাইব্রেরি পাঠদান, অবকাঠামো সুবিধা,  দক্ষ ও অভিজ্ঞ, প্রশিক্ষিত শিক্ষক এবং শিক্ষা উপকরণ শহরের তুলনায় গ্রামে কম। গ্রামের চেয়ে শহরাঞ্চলের অভিভাবকরা সন্তানদের পড়াশোনা নিয়ে বেশি সচেতন। অন্যদিকে গ্রামের শিক্ষার্থীরা শহুরে ছাত্রছাত্রীদের মতো কোচিং, প্রাইভেট শিক্ষা ও সঠিক নির্দেশনা প্রত্যাশাই করতে পারে না। এসব ব্যবধান ক্রমান্বয়ে ঘুচিয়ে আনা সম্ভব হলে গ্রামের পরীক্ষার্থীরাও ভালো ফলাফল অর্জন করবে। ফলাফলের ফারাক কমানোর জন্যেও তাই মফস্বলের প্রতিষ্ঠানগলোকে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে সরকারিকরণ করা দরকার।

সর্বোপরি মফস্বলের প্রতিষ্ঠানগুলোতে সরাসরি উৎপাদন প্রক্রিয়ার সাথে জড়িত জনগোষ্ঠি যেমন- কৃষক, জেলে, মজুর, কামার, কুমার, ভ্যানচালক, মৎস্য ধরার উপকরণ তৈরিতে নিয়োজিত প্রান্তিক মানুষগুলোর সন্তানেরা লেখাপড়া করে। মফস্বলে অধ্যয়নরত ছাত্ররা প্রায় সময় পিতার সহিত উৎপাদনের শরিক হিসেবে কাজ করে থাকে। করোনার চলমান এবং পরবর্তী প্রেক্ষাপটে আমাদের কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধি এবং নতুন ধরনের শিক্ষাব্যবস্থার সাথে খাপ খাওয়ানোর খাতিরেও মফস্বলের বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোকে সরকারিকরণের যৌক্তিকতা আরও বেড়ে গেছে।

মোটকথা রাষ্ট্রের শিক্ষাব্যবস্থায় সমতা আনতে, রাষ্ট্রীয় সম্পদের সমবন্টন ও মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করতে মফস্বলের প্রতিষ্ঠানগলোকে সরকারিকরণে অগ্রাধিকার দেয়ার কোনো বিকল্প নেই। তবে আমরা বিশ্বাস করি, দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা এবং করোনা মহামারির প্রেক্ষিতে শুধুমাত্র একটি বাজেটেই বেসরকারি শিক্ষাখাতের সমগ্রই সরকারিকরণ সম্ভব নয়। এইজন্য সকল বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সরকারিকরণের আগ পর্যন্ত সরকারি শিক্ষকদের অনুরূপ বাড়িভাড়া, চিকিৎসা ভাতা, পূর্ণ উৎসব ভাতার ব্যবস্থা করতে হবে। পাশাপাশি গ্রহণযোগ্য সময়সীমা নির্ধারণ করে বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগলোকে সরকারিকরণের রোডম্যাপ ঘোষণার প্রত্যাশা করে বেসরকারি শিক্ষক সমাজ।

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, ‘গ্রাম হবে শহর’। অন্যান্য বিষয়ের পাশাপাশি গ্রাম ও শহরের শিক্ষা ব্যবস্থার মধ্যে বৈষম্য দূর করতে পারলেই গ্রাম শহরে পরিণত হবে। এইজন্য সংক্ষিপ্ত সময়ে গ্রামে শহরের সমতুল্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার লক্ষ্যে মফস্বলের প্রতিষ্ঠানগুলোকে সরকারিকরণে অগ্রাধিকার দিয়ে আসন্ন বাজেট থেকে শুরু করে প্রতিটি বাজেটে অর্থ বরাদ্দের ব্যবস্থা করতে প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ কামনা করছি।

লেখক : এস এম খায়রুল বাসার, অধ্যক্ষ, পল্লীমঙ্গল আদর্শ মহাবিদ্যালয়, ইছামতি, অভয়নগর, যশোর।

[মতামতের জন্য সম্পাদক দায়ী নন।]

শিক্ষায় বরাদ্দ বেড়েছে, আরো বাড়বে: শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী - dainik shiksha শিক্ষায় বরাদ্দ বেড়েছে, আরো বাড়বে: শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী সমাবর্তনের অজুহাতে সনদ আটকে রাখা যাবে না - dainik shiksha সমাবর্তনের অজুহাতে সনদ আটকে রাখা যাবে না হিটস্ট্রোকে স্কুলছাত্রীর মৃত্যু - dainik shiksha হিটস্ট্রোকে স্কুলছাত্রীর মৃত্যু চুয়েটে আন্দোলন স্থগিত, সড়কে যান চলাচল শুরু - dainik shiksha চুয়েটে আন্দোলন স্থগিত, সড়কে যান চলাচল শুরু প্রাথমিকের প্রশ্ন ফাঁসে অল্পদিনে কয়েকশ কোটি টাকা আয় - dainik shiksha প্রাথমিকের প্রশ্ন ফাঁসে অল্পদিনে কয়েকশ কোটি টাকা আয় রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম সংবিধানবিরোধী নয়: হাইকোর্ট - dainik shiksha রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম সংবিধানবিরোধী নয়: হাইকোর্ট কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.020928144454956