মহান শিক্ষা দিবস ও প্রাসঙ্গিক কথা - দৈনিকশিক্ষা

মহান শিক্ষা দিবস ও প্রাসঙ্গিক কথা

অলোক আচার্য |

আজ ১৭ সেপ্টেম্বর। মহান শিক্ষা দিবস। এই দিবসের একটি ইতিহাস রয়েছে। ১৯৫৮ খ্রিষ্টাব্দের ৩০ ডিসেম্বর, ক্ষমতা দখলের মাত্র দুই মাসের মধ্যে জেনারেল আইয়ুব খান শিক্ষানীতি প্রণয়নের লক্ষ্যে পাকিস্তানের তৎকালীন শিক্ষাসচিব এসএম শরিফকে প্রধান করে শিক্ষা কমিশন গঠন করেন। কমিশন ১৯৫৯ খ্রিষ্টাব্দের আগস্ট মাসে ২৪ অধ্যায়ে বিভক্ত বিশাল শিক্ষা রিপোর্ট প্রণয়ন করে। রিপোর্টের অধিকাংশ সুপারিশ গ্রহণ করে সামরিক সরকার তা বাস্তবায়ন শুরু করলে পূর্ব পাকিস্তানের ছাত্রসমাজ বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। সৃষ্টি হয় একের পর এক ইতিহাস। ছাত্র সংগঠনগুলো এই শিক্ষানীতির বিরুদ্ধে রাজপথে নামে। প্রতিক্রিয়াশীল শিক্ষানীতির বিরুদ্ধে ঢাকা কলেজ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিক্যাল স্কুল, ন্যাশনাল মেডিক্যাল ইনস্টিটিউটসহ বহু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে স্ব-স্ব দাবির ভিত্তিতে জুলাই-আগস্ট মাস জুড়ে আন্দোলন চলতে থাকে।

আন্দোলনে দাবিগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয় হয়েছিলো শিক্ষানীতিতে প্রস্তাবিত তিন বছরের ডিগ্রি কোর্স এবং উচ্চমাধ্যমিক ইংরেজির অতিরিক্ত বোঝা বাতিল করার বিষয়টি। এই দাবির সমর্থনে দেশের প্রায় অধিকাংশ স্কুল-কলেজের ছাত্ররা স্বতঃস্ফূর্তভাবে ক্লাস বর্জন করতে থাকে। আন্দোলনের অংশ হিসেবে ১৭ সেপ্টেম্বর দেশব্যাপী হরতাল আহ্বান করা হয়। ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের ডাকে দেশব্যাপী সর্বাত্মক হরতাল পালিত হয়। সেদিন পুলিশের গুলিতে নিহত হন মোস্তফা, ওয়াজিউল্লাহ এবং বাবুল। ২৪ সেপ্টেম্বর পল্টন ময়দানের ছাত্রসমাবেশ থেকে শিক্ষানীতি বাতিল, হত্যার বিচারসহ ছাত্রসমাজের উত্থাপিত দাবি মানার জন্য চরমপত্র ঘোষণা করা হয়। ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মুখে সরকার শিক্ষানীতি বাস্তবায়ন স্থগিত করে। সংবিধানের ১৭ নং অনুচ্ছেদে গণমুখী, বিজ্ঞানভিত্তিক ও সর্বজনীন ধারার শিক্ষাব্যবস্থা প্রবর্তনের বাধ্যবাধকতা রয়েছে। কিন্তু শিক্ষা এখন অনেক ক্ষেত্রেই পণ্য। বাজার দরে লাভ ক্ষতি হিসেব করা হয়। কোনো বিভাগে পড়ালেখ করলে কতো দামি চাকরি পাওয়া যায় আর সেখানে কী পরিমাণ বেতন সেসব দিয়েই মূল্যায়ন করা হয়। শিক্ষা এখন এটাই। কতজন মানুষ হলো এসব দেখে আর কী হবে! বিদ্যা ও বিদ্ব্যান টাকায় বিক্রি হয়। শিক্ষা তার, টাকা আছে যার। টাকা নেই, শিক্ষা পাওয়া যাবে না। আবার ভুয়া সার্টিফিকেট কেনা-বেচা হয়! মাঝে মধ্যেই জাল সার্টিফিকেট দিয়ে চাকরি করা শিক্ষকের সংবাদ প্রকাশিত হয়। অত্যন্ত দুঃখজনক হলো যে মানুষটি শেখাচ্ছেন তিনি নেহায়েত টাকার জন্য জাল সার্টিফিকেট বানিয়ে শিক্ষা এবং শিক্ষকতার মতো মহান একটি জায়গাকে কলঙ্কিত করছেন। একটি নতুন শিক্ষাব্যবস্থার দ্বারপ্রান্তে দেশ। আগামী বছর থেকে শিক্ষায় আমূল পরিবর্তন আসতে চলেছে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এই পরিবর্তন জুরুরি। কিন্তু যেখানেই যেভাবে পরিবর্তন হোক না কেন যদি শিক্ষা কারো অন্তরে ঢুকে তা পরিষ্কার করতে না পারে তাহলে শিক্ষা ব্যর্থ হবে এটা নিশ্চিত। একজন শিক্ষিত মানুষ কেনো মানুষ হতে পারছেন না সেটা আজ বড় প্রশ্ন। যেখানে শিক্ষা লাভ করলেই মানুষ হওয়ার কথা ছিলো।

শিক্ষা যতোটা মহান একজন শিক্ষার্থীকে ততোটাই মহান করার উদ্দেশে তা ধাবিত হওয়া উচিত। দিন যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আজকালকার শিক্ষার্থীদের মধ্যে থেকে বই পড়ার প্রবণতা ধীরে ধীরে কমে যাচ্ছে। সারাদিন মুখ বুজে মোবাইলের স্ক্রিনে ফেসবুক ঘাটতে যে আনন্দ জ্ঞান লাভে আর ততোটা আনন্দ পান না। তাইতো নতুন বই পেলে যে একধরনের মুগ্ধতা তৈরি হয় তা ঠিক আছে কিন্তু কয়েকমাস যেতেই সেই মুগ্ধতা আর থাকছে না। মূল বই থেকে আগ্রহ হারিয়ে ফেলছে। ঝুকছে গাইড বই, লেকচার শিট, প্রাইভেট এসবের প্রতি। এসব কিছুই অবশ্য পরীক্ষায় ভাল ফলাফল করার জন্য। পাস করা, ভাল ফলাফল করা এসবই যেনো মুখ্য উদ্দেশ্য! অবশ্য আজকালকার সচেতন অভিভাবক মাত্রই সন্তানের ভাল ফলাফল আশা করে। আমিও করি। কিন্তু ভালো ফলাফল করতে গিয়ে যদি পাঠ্য বইয়ের বদলে গাইড বা প্রাইভেট বা লেকচার শিটের প্রতি আগ্রহ বেড়ে যায় তবে সেটা একদম ভালো কথা নয়। তারপর আবার এসবের বাইরে গিয়ে পাঠ্য বইয়ের পাশাপাশি গল্প, উপন্যাস, কবিতা এসবের ভেতরের যে জ্ঞানের এক অফুরন্ত ভাণ্ডার আছে তার খোঁজ এরা করছেন না। তার কারণও কি শুধুই পরীক্ষায় ভালো ফলাফল? ফলে জ্ঞান হয়ে পড়ছে সীমাবদ্ধ। সীমাবদ্ধ জ্ঞান দিয়ে মুক্ত আকাশের সন্ধান মেলে কি? শুধুমাত্র পাস করা বা ঘণ্টার পর ঘণ্টা পড়ে (প্রাইভেট বা কোচিংয়ে বেশি সময়) ভালো ফলাফল করা যায় বৈকি তবে প্রকৃত মানুষ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করা যায় কি? মানুষ হওয়ার ক্ষেত্রে মুক্ত জ্ঞানের চর্চা থাকা আবশ্যক।

যখন দেখি বইয়ের বদলে ক্লাসের বাইরে বেশিরভাগ শিক্ষার্থীই ভারতীয় টিভি সিরিয়াল দেখে, মোবাইল বা ট্যাবে গেমস খেলে বা অপ্রয়োজনীয় কিছু ওয়েবসাইটে ঢুকে সময় কাটাচ্ছেন তাতে আমি মর্মাহত হই। কারণ, এতে তাৎক্ষণিক মনের আনন্দ মিটছে বৈকি কিন্তু মাথার ভেতর থেকে বই পড়ার ধৈর্যটা কমে যায়। বিষয়টা এমন যে একজন ছাত্র যখন তার মোবাইলের স্ক্রিনের দিকে যে তীব্র আগ্রহ নিয়ে তাকিয়ে থাকে সেই আগ্রহ যদি বইয়ের পৃষ্ঠার প্রতি থাকতো তাহলে কতো ভালোই না লাগতো। তবে বিষয়টা শুধু আমার ভালো লাগা বা মন্দ লাগার না বিষয়টা জাতির ভবিষ্যতের। আমাদের মোবাইলের দরকার আছে কিন্তু মাধ্যমিক শ্রেণিতে পড়ুয়া একজনের দিনের কয়েক ঘণ্টা মোবাইলের সঙ্গে কাটানো কতোটা প্রয়োজন আছে তা বোধগম্য নয়। এর অর্থ আমি প্রযুক্তির বিপক্ষে নই। বিজ্ঞানের আশীর্বাদে মানব সভ্যতা সামনে এগিয়ে যাচ্ছে। আমার তো চিন্তা একে সঠিকভাবে ব্যবহারের ওপর।

মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিকের গণ্ডি পেরিয়ে সবাই এখন বড় হওয়ার জন্যই ছুটছে। কেউ ডাক্তার, কেউ ইঞ্জিনিয়ার, কেউ প্রশাসনিক কর্মকর্তা ইত্যাদি কতো শত লক্ষ্য নিয়ে ছুটছে। অনেকেই তাদের তাদের স্বপ্নের পেশায় নিয়োজিতও হবে। কিন্তু এদের চাকরির বাজারে, টাকা অর্জনের বাজারে বড় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মানুষ হওয়ার গুণাবলিও অর্জন করা একান্ত জরুরি। পাসের ফলাফল দিয়ে শিক্ষার্থীর মেধা যাচাই করা যায় বটে কিন্ত সে মানুষ হওয়ার পথে কতোটুকু এগোলো তা যাচাই করতে হলে তার সার্বিক গুণাবলির দিকে তাকাতে হবে। সেটা কেবল সেই ব্যাক্তি আর তার সঙ্গে জড়িত আপনজনরাই ভালো বলতে পারবেন। তবে এইচএসসি পাস করা এসব শিক্ষার্থীর ওপর এখন প্রচণ্ড মানসিক চাপ যাবে। প্রত্যেকেই চাইবে নিজের পছন্দের বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে। কিন্তু বাস্তবতা হলো সবাই এ সুযোগ পাবেন না। যারা যোগ্য তারাই কেবল এখানে সুযোগ পাবেন। জীবনে এর চেয়ে ঢের বেশি গুরুত্বপূর্ণ হলো তুমি নিজেকে সত্যিকার অর্থে বড় মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতে পেরেছ কি না। কারণ, এখন এই সমাজে এইসব মানুষই সব থেকে বেশি দরকার। সার্টিফিকেটধারী অনেক আছে কিন্তু প্রকৃত মানুষ কজন? আজ যে সমাজে এতো হানাহানি, উগ্রতা এসব তো ভালো মানুষ হতে না পারারই ফল। একজন মানুষের উচ্চশিক্ষা লাভ করার পাশাপাশি মনুষত্ব্য অর্জনের শিক্ষা নেয়াটাও জরুরি। উচ্চশিক্ষা শুধু সার্টিফিকেটে উচ্চ হলেই হবে না মন ও মননশীলতায় উচু হতে হবে। সেই মানসিকতা গড়তে শুধুমাত্র নামিদামি ইউনিভার্সিটিতে চান্স পেলেই চলবে না। সাম্প্রতিক সময়ে আমরা এর অনেক উদাহরণ পেয়েছি। দেশে অনেক কলেজ রয়েছে যেখানে ভর্তি হয়ে অনায়াসে তার উচ্চশিক্ষা শেষ করা যায়। তাই মানসিকভাবে ভেঙে পড়লেও চলবে না। সার্টিফিকেট বিদ্যা অর্জন করার পাশাপাশি আমরা যে কিছু ভালো মানুষ চাই।

মহান শিক্ষা দিবসের পেছনে যে ইতিহাস রয়েছে আজও আমরা সেখানে পৌঁছাতে পারিনি। আমরা যে উদ্দেশ্য নিয়ে শিক্ষা দিতে চাই সে উদ্দেশ্য কিন্তু সফল হচ্ছে না। আবার সফল হচ্ছে না সেটাই বা কীভাবে বলি? আজ অভিভাবকের ইচ্ছা তো বড় বড় চাকরি করা, বিসিএস করা, দামি গাড়িতে ঘুরে বেড়ানো ইত্যাদি। সেটা তো অনেকেই পাচ্ছে। আবার বড় বড় সব দুর্নীতির অধ্যায় কিছু কুশিক্ষিত বড় পদে চাকরি করা মানুষেরই। তাহলে শিক্ষা যে শিক্ষিত করছে তা নিশ্চিতভাবে বলা যায় না। শিক্ষায় নানা পরীক্ষা নিরীক্ষা, উদ্দেশ্যর দুর্বলতা আমাদের শিক্ষাকে আজ টাকা দিয়ে মাপতে শেখাচ্ছে। যত নামিদামি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সেখানে পড়ালেখা করতে ততো টাকা। কতজনেরই বা সাধ্য আছে সেসব প্রতিষ্ঠানে নিজের সন্তানকে পড়ানোর। শিক্ষা এমন হোক যেন সার্টিফিকেটের গণ্ডি পেরিয়ে মানবতার ছোঁয়া এনে দিতে পারে। ব্যর্থতা শিক্ষার হয় না, ব্যর্থতা হয় শিক্ষার নীতিনির্ধারকদের। অথচ প্রাথমিক শ্রেণি থেকে আধুনিক ও প্রযুক্তিসম্পন্ন শিক্ষা প্রদানে সরকার আন্তরিক। কিন্তু মাঠ পর্যায়ে তার বাস্তবায়ন কতোটুকু হচ্ছে? এই দায় হলো শিক্ষকদের। আর যারা তা তদারকি করছেন তাদের। একটু পরিশ্রম করলে আমরা শিক্ষাকে সত্যিকার অর্থেই কাজে লাগাতে পারি। অর্থাৎ আমরা সত্যিকার অর্থেই মানুষ পাবো, চাকরিজীবী বা কর্মকর্তা না।

লেখক :অলোক আচার্য, প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট

 

শনিবার থেকে মাধ্যমিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলা - dainik shiksha শনিবার থেকে মাধ্যমিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলা রোববার থেকে প্রাথমিক বিদ্যালয় খোলা - dainik shiksha রোববার থেকে প্রাথমিক বিদ্যালয় খোলা ট্রেনে কাটা পড়ে স্কুলশিক্ষকের মৃত্যু - dainik shiksha ট্রেনে কাটা পড়ে স্কুলশিক্ষকের মৃত্যু গুচ্ছের ‘বি’ ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষা কাল - dainik shiksha গুচ্ছের ‘বি’ ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষা কাল শিক্ষকরাই স্মার্ট নাগরিক গড়ার কারিগর: শিল্পমন্ত্রী - dainik shiksha শিক্ষকরাই স্মার্ট নাগরিক গড়ার কারিগর: শিল্পমন্ত্রী এনটিআরসিএর সার্টিফিকেট সংশোধনের নতুন নির্দেশনা - dainik shiksha এনটিআরসিএর সার্টিফিকেট সংশোধনের নতুন নির্দেশনা মর্নিং স্কুলের ছয় সুবিধা উল্লেখ করলেন জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা - dainik shiksha মর্নিং স্কুলের ছয় সুবিধা উল্লেখ করলেন জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা দেড় মাস পর ক্লাসে ফিরছেন বুয়েট শিক্ষার্থীরা, স্থগিত পরীক্ষার তারিখ ঘোষণা - dainik shiksha দেড় মাস পর ক্লাসে ফিরছেন বুয়েট শিক্ষার্থীরা, স্থগিত পরীক্ষার তারিখ ঘোষণা অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত স্কুলের সংখ্যা বাড়াতে চায় সরকার - dainik shiksha অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত স্কুলের সংখ্যা বাড়াতে চায় সরকার দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0037961006164551