মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালকের পদ পেতে বিএনপি-জামাত আমলের সুবিধাভোগী বিসিএস (সাধারণ শিক্ষা) ক্যাডার কর্মকর্তারাই লবিংয়ে এগিয়ে রয়েছেন। দুই মাস আগে থেকেই দৌড়ঝাঁপ শুরু হয়েছে। বর্তমান মহাপরিচালক (চলতি দায়িত্ব) অধ্যাপক ড. সৈয়দ মো. গোলাম ফারুকের মেয়াদ আগামী ১১ জানুয়ারি শেষ হবে। তিনি ওইদিন অবসর প্রস্তুতিমূলক ছুটিতে (পিআরএল) যাবেন। এরই মধ্যে এ পদে আসতে আগ্রহীরা প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়, রাজনীতিবিদদের দরবারে ও শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে লবিং শুরু করেছেন। নিজেকে আলোচনায় আনতে বা ‘যোগ্য’ প্রার্থী হিসেবে চাউর করানোর জন্য গণমাধ্যমে নাম প্রকাশ করাচ্ছেন কেউ কেউ।
একাধিক সূত্র দৈনিক শিক্ষাকে জানায়, দশ শতাংশ কোটায় অধ্যাপক হওয়াদের মধ্যে কেউ নিয়োগ পেলে মামলা হতে পারে। কঠোর সমালোচনা হবে। কারণ, এখন যারা দশ শতাংশ কোটাধারী তারা সবাই বিএনপি-জামাতের আশীর্বাদে কোটা সুবিধায় অধ্যাপক হয়েছেন। বর্তমান যিনি আছেন তার এই পদে থাকা নিয়ে মামলা হলে তাকে চলে যেতে হতো। এখনও কেউ মামলা করেনি। বিধান অনুযায়ী কোটা সুবিধা প্রাপ্তরা প্রশাসনিক পদে আসতে পারেন না।
মাউশি অধিদপ্তরের মহাপরিচালকের বিসিএস (সাধারণ শিক্ষা) ক্যাডারের সর্বোচ্চ পদ। মর্যাদা ও সুযোগ-সুবিধার দিক থেকে পদটি খুবই আকর্ষণীয় বলে শিক্ষা ক্যাডারের কর্মকর্তাদের কাছে বিবেচিত হয়। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের কর্মকর্তারা জানান, মহাপরিচালক পদের জন্য এখনও প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে নাম পাঠানো হয়নি।
শিক্ষা খাত-সংশ্নিষ্ট একাধি সূত্রমতে, অসংখ্য পদপ্রত্যাশীর মধ্যে বিএনপি-জামাত আমলে সুবিধাভোগীরাই তদবির-লবিংয়ে এগিয়ে। সাবেক শিক্ষামন্ত্রীর পলাতক সাবেক এপিএস ও শিক্ষাখাতে বিশৃঙখলা সৃষ্টির অন্যতম প্রধান কারিগর মন্মথ রঞ্জন বাড়ৈর ঘনিষ্ঠরাও খোলস বদলে মহাপরিচালক হওয়ার তদবির করছেন।
জানা যায়, বর্তমান মহাপরিচালক অধ্যাপক ড. সৈয়দ মো. গোলাম ফারুক বিএনপি-জামাত আমলে দশ শতাংশ কোটায় অধ্যাপক নিযুক্ত হয়েছেন। এরপরপরই তৎকালীন সরকারের উচ্চ মহলের আশীর্বাদে সৌদিতে লিয়েনে ছিলেন প্রায় ৭ বছর। সৌদি থেকে ফিরে এসেই আওয়ামী লীগ সরকারের কাছ থেকে সুবিধা নেন বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে ‘কয়েকদিন ছাত্র ইউনিয়নের মিছিল করার অভিজ্ঞতায়’। প্রথমে নায়েমের মহাপরিচালক ও পরে মাউশি অধিদপ্তরের মহাপরিচালকের চলতি দায়িত্ব পাওয়ার পর নানা অঘটনের মধ্যেও টিকে আছেন দুই জাদুতে। এক. একজন আওয়ামী লীগপন্থী বুদ্ধিজীবীর আত্মীয়। ২. কাজে ঠনঠন হলেও সুন্দর করে কথা বলতে পারা। তার বিরুদ্ধে মানি লন্ডারিংয়ের মামলা করেছেন শিক্ষা ক্যাডারেরেই একজন প্রভাষক। এটা শিক্ষা ক্যাডারের ইতিহাসে প্রথম। যদিও পিবিআইয়ের তদন্তে অভিযোগ প্রমাণিত হয়নি।
শিক্ষাখাত সংশ্লিষ্টদের মতে, সৈয়দ গোলাম ফারুক ও সেসিপের উপপরিচালক শামসুন্নাহারের ‘সেসিপ কেলেংকারি’র দায়ে শাস্তির ফাইল আটকানো ও শিক্ষা অধিদপ্তরে নিয়োগ বাণিজ্যর অভিযোগ তদন্ত স্থগিত করার ঘটনায় ক্ষুব্ধ হয়ে একজন সচিব অন্য মন্ত্রণালয়ে বদলি হয়ে চলে গেছেন। অথবা অভিযুক্তদের শাস্তি দিতে চাওয়ায় সচিবকেই বদলি হতে হয়েছে।
জানা যায়, গোলাম ফারুককে আরও দুই বছরের জন্য চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দেওয়া চেষ্টা করছেন কেউ কেউ। ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান অধ্যাপক নেহাল আহমেদ কোনো চেষ্টা করছেন বলে খবর পাওয়া না গেলেও সবাই ধারণা করছেন তিনিও এই পদপ্রত্যাশী। তবে, আওয়ামী লীগের ত্যাগী রাজনীতিক ও বর্তমান রাষ্ট্রপতির ভাগ্নে হওয়ার ‘অপরাধে!’ নেহাল আহমদকে মাশুল দিতে হয়েছে পুরো বিএনপি-জামাত ও ফখরুদ্দীনের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় পর্যন্ত। অধ্যাপক হলে বড় পদে যেতে পারেন এই ভয়ে নেহালকে হালকা পদোন্নতি বঞ্চিত রাখা হয় ২০০৯ থেকে ২০১৪ পর্যন্ত।
শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদপ্তরের (ডিআইএ) পরিচালক অধ্যাপক অলিউল্লাহ মোহাম্মদ আজমতগীরের জন্য তদবির করছেন একজন মহাপরিচালক ও একজন সাবেক সচিব। এ কথা অনেকের মুখে মুখে । সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়গুলোর উন্নয়ন প্রকল্পের পরিচালক ও স্বাধীনতা বিসিএস শিক্ষা সংসদের সভাপতি অধ্যাপক মো. নাসির উদ্দিনের জন্য কেউ তদবির না করলেও কেউ কেউ মনে করছেন তিনিও একজন প্রত্যাশী।
মাউশির পরিচালক (প্রশিক্ষণ) অধ্যাপক প্রবীর কুমার ভট্টাচার্য্য, মাউশির পরিচালক (পরিকল্পনা ও উন্নয়ন) অধ্যাপক শফিউল আযম এবং রাজধানীর ঢাকা কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক আই কে সেলিম উল্লাহ খোন্দকারের নামও জোরেশোরে আলোচিত হচ্ছে। কয়েকদিন আগে একটি কম প্রচারসংখ্যার বাংলা জাতীয় দৈনিকে মাউশি অধিদপ্তরের সাবেক পরিচালক ও বর্তমানে ধামরাই সরকারি কলেজের অধ্যক্ষ দশ শতাংশ কোটায় হওয়া অধ্যাপক ড. মো. সেলিম মিয়ার নাম লেখা হয়েছে প্রার্থী হিসেবে। ওই পত্রিকায় প্রকাশ ছাড়া সেলিমের নাম কোথাও শোনা যায়নি। পত্রিকাটির শিক্ষা সাংবাদিকের বিরুদ্ধে শিবির নেতা ও পলাতক দণ্ডিত আসামী তারেক জিয়ার ঘনিষ্ঠ ক্যামরিয়ানের বশারের দালালি, টাউট ও ভবঘুরে অভিভাবক ফোরামের দালালিসহ নানা দুর্নীতির অভিযোগ সবার মুখে মুখে।
তবে, লবিং ও আলোচনায় নায়েমের মহাপরিচালক ড. মো. নিজামুল করিম সবচাইতে এগিয়ে রয়েছেন বলে শিক্ষা ক্যাডারে বলাবলি হচ্ছে।
জানা যায়, শিক্ষা ক্যাডারের কর্মকর্তাদের মধ্যে অধ্যাপক সৈয়দ মো. গোলাম ফারুকের ওপর শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের শীর্ষ নীতিনির্ধারকের আশীর্বাদ রয়েছে।
মহাপরিচালক হওয়ার বিষয়ে ঢাকা বোর্ড চেয়ারম্যান অধ্যাপক নেহাল আহমেদ বলেছেন, ‘আমি কোনো তদবির করছি না।’
অধ্যাপক মো. নাসির উদ্দিন বলেন, ‘আমি তদবির করছি না।’ ঢাকা কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক আই কে সেলিম উল্লাহ খন্দকার বলেন, আমার চাকরি আছে মাত্র কয়েকমাস। আম নাম কীভাবে আলোচনায় এসেছে, জানি না। শিক্ষামন্ত্রী আমাকে ঢাকা কলেজে দিয়েছেন, আমি এতেই সন্তুষ্ট। আজ পর্যন্ত কোনো পদে আমি কখনও তদবির করে যাইনি।
একাধিক সূত্র জানায়, এ পদে জ্যেষ্ঠতার ভিত্তিতেও নিয়োগ দেওয়ার বিষয়টি বিবেচনা করা হতে পারে। এ ক্যাডারের সব অধ্যাপক জাতীয় বেতন স্কেলের তৃতীয় গ্রেডপ্রাপ্ত নন। তাই গ্রেডেশন তালিকা অনুসারে তৃতীয় গ্রেডপ্রাপ্ত, শিক্ষা ক্যাডারের শীর্ষ জ্যেষ্ঠ ১০ কর্মকর্তা হলেন- নওগাঁ সরকারি কলেজের অধ্যাপক (ব্যবস্থাপনা) ড. মো. আলাউদ্দিন, সিরাজগঞ্জ ইসলামিয়া সরকারি কলেজের অধ্যাপক (হিসাববিজ্ঞান) ড. এসআইএমএ রাজ্জাক, মাউশির বর্তমান মহাপরিচালক অধ্যাপক ড. সৈয়দ মোহাম্মদ গোলাম ফারুক, যশোর সরকারি এমএম কলেজের অধ্যাপক (রাষ্ট্রবিজ্ঞান) ড. মো. হাসান সোহরাওয়ার্দী, মাউশিতে ওএসডি থাকা অধ্যাপক (রাষ্ট্রবিজ্ঞান) মো. সাইদুর রহমান, গভর্নমেন্ট কলেজ অব অ্যাপ্লায়েড হিউম্যান সায়েন্সের অধ্যক্ষ ইসমত রুবিনা, বগুড়া সরকারি আজিজুল হক কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক মো. শাহজাহান আলী, বরিশালের হায়ার সেকেন্ডারি টিচার্স ট্রেনিং ইনস্টিটিউটের (এইচএসটিটিআই) পরিচালক মো. শাহ আলম, ধামরাই সরকারি কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক ড. মো. সেলিম মিয়া এবং দিনাজপুর সরকারি কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক মো. আবু বকর সিদ্দিক।