মাতৃভাষা ছাড়া শিক্ষা যথার্থ হয় না : সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী - দৈনিকশিক্ষা

মাতৃভাষা ছাড়া শিক্ষা যথার্থ হয় না : সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী

দৈনিকশিক্ষা ডেস্ক |

১৯৫২ খ্রিষ্টাব্দের আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগে ভর্তি হই। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় তখন আমাদের কাছে খুব পরিচিত। আমাদের বাসা ছিল বেগমবাজারে। আমরা রমনা দিয়েই যাতায়াত করতাম। একুশের আন্দোলন যে হবে তা আমরা টের পাচ্ছিলাম। উর্দু চলে আসছে সর্বত্র। টাকাতে, স্ট্যাম্পে, স্কুল-কলেজের পরীক্ষায়, সিভিল সার্ভিস পরীক্ষায় উর্দুর প্রাবল্য। আসলে আন্দোলনের সূচনা হয়েছিল ১৯৪৮ খ্রিষ্টাব্দে। এরপর ধারাবাহিকভাবে নানা কর্মসূচি, বিক্ষোভ হয়েছে। ’৫২-তে এসে এটা প্রবল আকার ধারণ করে। মঙ্গলবার (৯ ফেব্রুয়ারি) বাংলাদেশ প্রতিদিন পত্রিকায় প্রকাশিত এক নিবন্ধে এ তথ্য জানা যায়।

নিবন্ধে আরও জানা যায়, একুশে ফেব্রুয়ারির আগে যে মিছিল হয়েছিল তাতে আমি অংশ নিয়েছিলাম। তখন আমি কলেজে পড়ি। আজিমপুরে আমাদের কলোনিতে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র নূরউদ্দিন ভাই, মাহমুদ ভাই ছিলেন, তারা এমকম-এ পড়তেন। তাদের সঙ্গে ২২ ফেব্রুয়ারি পত্রিকায় কী ছাপা হয়েছে আমরা তা দেখতে যাই। ওই সময় আজাদ, সংবাদ, মর্নিং নিউজ, পাকিস্তান অবজারভারে ভাষা আন্দোলনের খবর পড়ে আমরা সন্তুষ্ট হতে পারিনি। যদিও আজাদের সম্পাদক আবুল কালাম শামসুদ্দীন পরের দিন পদত্যাগ করেছিলেন। তিনি পরের দিন প্রথম শহীদ মিনারের যে স্তম্ভ হয় সেটা উদ্বোধন করেছিলেন। আমরা পত্রিকাগুলো পুড়িয়ে দিয়েছিলাম। আমরা মিছিল নিয়ে সদরঘাটে গিয়েছিলাম। দেখি সাধারণ মানুষ মর্নিং নিউজ অফিস জ্বালিয়ে দিয়েছে। এটা অভূতপূর্ব ঘটনা। ঢাকা শহরে এরকম কখনো ঘটেনি। একুশে ফেব্রুয়ারির আগে পুরান ঢাকার লোকেরা এ আন্দোলনে যোগ দেয়নি। একুশের আন্দোলনটাই ছিল রমনা ও বিশ্ববিদ্যালয়কেন্দ্রিক। কিন্তু পুলিশের গুলি চালানোর পরে পুরো আবহাওয়াটা বদলে গেল। আমরা দেখলাম পুরান ঢাকার লোকেরাও এ আন্দোলনে আসছে। তারা নানাভাবে ছাত্রদের সাহায্য করছে। পুরান ঢাকার লোকেরা উর্দু মিশ্রিত বাংলা বলত। একুশের ঘটনায় নবাববাড়ি মুসলিম লীগের যে ঘাঁটি সেই ব্যবধানটা ভেঙে গেল। এটা মধ্যবিত্তেরই আন্দোলন। রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের সুনির্দিষ্ট দাবি দুটির একটি ছিল রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই, অপরটি সর্বস্তরে বাংলা ভাষার প্রচলন চাই।

অখন্ড পাকিস্তানে বাংলাকে শেষ পর্যন্ত অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে মেনে নেওয়া হয়েছিল। কিন্তু তারপরে? বাংলা কি সর্বস্তরে প্রচলিত হয়েছে? হয়নি যে সেটা তো পরিষ্কার। ছবিটা আমাদের সবারই জানা। তবু তার দিকে চকিতে তাকানো যেতে পারে। বাংলা উচ্চশিক্ষার মাধ্যম হয়নি। তদুপরি শিক্ষা তিন ধারায় বিভক্ত হয়ে গেছে। উচ্চস্তরে মাতৃভাষার মাধ্যমে শিক্ষা না দেওয়ার ব্যর্থতার দরুন শিক্ষা গভীর হচ্ছে না, এমনকি তাকে যথার্থ শিক্ষাও বলা যাচ্ছে না, কেননা মাতৃভাষা ছাড়া কোনো শিক্ষাই যথার্থ হয় না। উচ্চ আদালতে বাংলা ভাষার কার্যকর ব্যবহার নেই, অথচ সেখানে বাদী-বিবাদী আইনজীবী বিচারক সবাই বাঙালি। এটিও বাংলার অপ্রচলনের একটি করুণ দৃষ্টান্ত বৈকি। কিন্তু এসবের কারণ কী? কারণটা স্পষ্ট, সেটা হলো দেশের শাসকশ্রেণি বাংলা ব্যবহারে আগ্রহী নয়। আমাদের দুর্ভাগ্য যে, এদেশের শাসকশ্রেণি বাংলা ভাষার ব্যাপারে কখনই উৎসাহী ছিল না।

রাষ্ট্র অনেক কিছুই করতে পারেনি; রাষ্ট্রের সবচেয়ে বড় ব্যর্থতা বাংলা ভাষার চর্চার ক্ষেত্রেই ঘটেছে। ব্যর্থতার কারণ হলো রাষ্ট্র ভেঙেছে ঠিকই, কিন্তু বদলায়নি। ভিতরে সে আগের মতোই রয়ে গেছে। মুক্তির জন্য প্রয়োজন ছিল বাংলা ভাষা চর্চার স্বাধীনতা। সেটা সম্ভব হতো রাষ্ট্রের চরিত্রে, অর্থাৎ রাষ্ট্রের ভিতরে শাসক ও শাসিতের সম্পর্কের ক্ষেত্রে যদি মৌলিক পরিবর্তন ঘটত তবেই। সেটা ঘটেনি। শাসক বদল হয়েছে, শাসক-শাসিতের সম্পর্কে বদল হয়নি। মুক্তির সংগ্রামে চালিকাশক্তি ছিল সাধারণ মানুষ। সেই সাধারণ মানুষের মুক্তি আসেনি। তাই তাদের মাতৃভাষাও মুক্তি পায়নি; আগের মতোই শাসকদের অবহেলা ও উৎপীড়নের শিকার হচ্ছে। কিন্তু হতাশ হওয়ার কারণ নেই। জনগণ আছে। এবং তাদের ভাষাও থাকবে।

লেখক : সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, ইমেরিটাস অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

ভিকারুননিসায় ৩৬ ছাত্রী ভর্তিতে অভিনব জালিয়াতি - dainik shiksha ভিকারুননিসায় ৩৬ ছাত্রী ভর্তিতে অভিনব জালিয়াতি ‘চার আনা’ উৎসব ভাতা: প্রধানমন্ত্রী ও শিক্ষামন্ত্রী সমীপে - dainik shiksha ‘চার আনা’ উৎসব ভাতা: প্রধানমন্ত্রী ও শিক্ষামন্ত্রী সমীপে মাকে ভরণপোষণ না দেয়ায় শিক্ষক গ্রেফতার - dainik shiksha মাকে ভরণপোষণ না দেয়ায় শিক্ষক গ্রেফতার ছুটি না বাড়ালে বাড়ি যেতে হতে পারে ঈদের দিন - dainik shiksha ছুটি না বাড়ালে বাড়ি যেতে হতে পারে ঈদের দিন হাইস্কুলে কমেছে দশ লাখের বেশি শিক্ষার্থী - dainik shiksha হাইস্কুলে কমেছে দশ লাখের বেশি শিক্ষার্থী জালিয়াতি করে পদোন্নতি শিক্ষা ক্যাডার গ্যাঁড়াকলে - dainik shiksha জালিয়াতি করে পদোন্নতি শিক্ষা ক্যাডার গ্যাঁড়াকলে রুয়েটের সাবেক উপাচার্য-রেজিস্ট্রারের বিরুদ্ধে মামলা - dainik shiksha রুয়েটের সাবেক উপাচার্য-রেজিস্ট্রারের বিরুদ্ধে মামলা উপবৃত্তির জন্য সংখ্যালঘু কোটার তথ্য চেয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয় - dainik shiksha উপবৃত্তির জন্য সংখ্যালঘু কোটার তথ্য চেয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয় প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগে সতর্কীকরণ বিজ্ঞপ্তি - dainik shiksha প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগে সতর্কীকরণ বিজ্ঞপ্তি উপবৃত্তির জন্য সংখ্যালঘু কোটার তথ্য চেয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয় - dainik shiksha উপবৃত্তির জন্য সংখ্যালঘু কোটার তথ্য চেয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয় হাইস্কুলে কমেছে দশ লাখের বেশি শিক্ষার্থী - dainik shiksha হাইস্কুলে কমেছে দশ লাখের বেশি শিক্ষার্থী please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0060439109802246