প্রত্যেক কাজেরই নির্দিষ্ট বয়স থাকে। বয়স সামর্থ ও রুচির বাইরে খাবার বা কোন কিছু করা হলে শিশুর শারীরিক ও মানসিক বিকাশ বাধাগ্রস্থ হয়। শিশুর শিক্ষা ক্ষেত্রেও এর ব্যতিক্রম নয়। শিক্ষার প্রধান উদ্দেশ্য জ্ঞান অর্জন। এ উপলদ্ধিবোধটুকু আমাদের সমাজে অনেকের মাঝে নেই। তারা লেখাপড়ার উদ্দেশ্য বলতে বুঝে থাকে ভাল পাস বা বেশি বেশি নম্বর পাওয়া। দুধের দাঁত উঠা শিশুকে কঠিন কঠিন ইংরেজি, আরবি ভাষা শিক্ষা দেয়া হলে, আমাদের সমাজে অধিকাংশ অভিভাবকের মাঝে গর্ববোধ জাগ্রত হয়। শুধু শিশু নয় সকলের ক্ষেত্রে মাতৃভাষার মাধ্যমে জ্ঞান অর্জন অধিকতর সহায়ক।
বর্হিবিশ্বের সাথে সম্পর্ক স্থাপন বা যোগাযোগের জন্য মাতৃভাষা ছাড়া ইংরেজি, আরবি, জাপানিসহ অন্যান্য ভাষা জানা বা শেখার প্রয়োজন। বিশেষ করে ইংরেজি ভাষায় জ্ঞান অর্জন করা প্রয়োজন। কারণ ইংরেজি হলো আন্তর্জাতিক ভাষা। ইংরেজি ভাষা জানা না থাকলে বহিঃবিশ্বের সাথে যোগাযোগ স্থবির হয়ে পড়বে। মুসলমান হিসাবে প্রকৃত আলেম হতে হলে ধর্ম সম্পর্কে জ্ঞান থাকা প্রয়োজন। এজন্য প্রত্যেক মুসলমানের আরবি ভাষা সম্পর্কে ব্যাপক জ্ঞান থাকতে হবে। যাতে আমরা পবিত্র কোরান হাদিসের আলোকে জীবন গড়ে তুলতে পারি। বাংলা তরজমা সম্পর্কে জানতে পারি। মাতৃভাষা ছাড়া অন্য ভাষা শেখার গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য। তবে শিশু শিক্ষার্থীদের জ্ঞানের বিকাশে অন্য ভাষা শেখা মানসিক চাপ বৃদ্ধিতে সহায়ক হবে। সর্বোপরি জ্ঞান অর্জনের সবচেয়ে সফল ও সহজ মাধ্যম হলো মাতৃভাষা। জ্ঞান বিজ্ঞানের প্রসারে আমাদের সমুদয় বিদেশি ভাষার পুস্তক বাংলায় অনুবাদ করা উচিত। স্বাধীনতার পর হতে বিদেশি ভাষার বই অনুবাদের কার্যক্রম হয়ে আসছে। বাংলা একাডেমী বিষয়টির ওপর অধিকতর গুরুত্ব দিবে বলে আশা করি। প্রতি বছর অমর একুশ আসলেই আমরা সালাম, জব্বার, রফিক, বরকতসহ অগণিত শহিদের ছবি আমাদের মানসপটে ভেসে আসে। বাঙালি জাতি ছাড়া পৃথিবীতে আর কোন জাতি মাতৃভাষার জন্য রক্ত দেয়নি। একুশ আসলেই আমরা একুশের শহিদদের স্মৃতির উদ্দেশ্যে গেয়ে থাকি। ‘আমার ভায়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি। আমি কি ভুলিতে পারি।’ সত্যই কি আমরা আমাদের হৃদয়ের আবেগ জড়িত গান মনে প্রাণে বাস্তবায়ন করতে সক্ষম। একুশের মধ্যরাত থেকে শেষ প্রহরে আমরা শহিদের স্মৃতির প্রতি ভালবাসার নিদর্শনস্বরুপ খালি পায়ে হেটে শহিদ মিনারে ফুল দেই।বঙ্গবন্ধুর সুযোগ্য কন্যা জননেত্রী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার মুক্তিযুদ্ধের সরকার বাংলাদেশের প্রায় সকল প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শহিদ মিনার নির্মাণ করেছেন। শুধু সরকরি প্রাথমিক বিদ্যালয় নয়, সকল কিন্ডারগার্টেন, উচ্চ বিদ্যালয়সহ সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শহিদ মিনার স্থাপন প্রয়োজন। আগামী প্রজন্মের শিক্ষার্থী যাতে একুশ তথা বাঙালি জাতির সংগ্রামী ইতিহাস জানতে পারে। একুশ বাঙালীর অহংকার। একুশ মানে মাতৃভাষার অধিকার অর্জন। একুশ মানে বাঙালির স্বাধিকার তথা স্বাধীনতার সংগ্রাম। একুশ মানে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা। আজকে স্বাধীন সার্বভৌম সোনার বাংলা সবকিছুই যেন একুশকে ঘিরে।
কিছুটা দুঃখ ভারাক্রান্ত মনে বলতে হয়, একুশে ফেব্রুয়ারি এলে আমরা আবেগী মন নিয়ে শহিদ মিনারে ফুল দিয়ে থাকি। একুশ শেষ হওয়ার পর ধীরে ধীরে ঐ ফুল শুকিয়ে নিঃশেষ হয়ে যায়। আমাদের মাঝ থেকে পাশাপাশি একুশের চেতনা অনেকটা দূরে সরে যায়। ফুল প্রাণহীন। তা শুকিয়ে যাওয়াটা স্বাভাবিক। একুশের চেতনা এদেশের মানুষের মনের মাঝ থেকে দূরে সরে যাবে। বিষয়টি ভাবতে কষ্ট হয়। ছোট সোনামনিদের জ্ঞানহীন পাঠদান বিদেশি ভাষায় রপ্ত করে এদেশের মানুষের মন অহংকারে ভরে উঠে। তবে কেন ? যে বাঙালি জাতি মাতৃভাষার অধিকার আদায়ের জন্য বুকের রক্ত দিয়েছিলেন। মুজিববর্ষে আমরা স্বাধীনতা রজত জয়ন্তী পালন করতে যাচ্ছি। এ দীর্ঘ সময়ে শিশুশিক্ষায় মাতৃভাষার ছাড়া অন্য ভাষায় শিক্ষা দিয়ে জ্ঞান অর্জন ব্যতিরেকে জাতির আগামী প্রজন্মকে জ্ঞানহীন বিকলাঙ্গ করে ফেলা হয়েছে। এ নিয়ে ভাবনাহীন হয়ে আছে সংশ্লিষ্টরা। ভাবখানা এমন শুধু ফুল দিয়ে ও একুশ স্মরণে বক্তব্য দিয়েই দায় শেষ হয়ে গেছে।
প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় শুধু শিশুর ওপর বিদেশি ভাষায় পাঠদানের বিষয়টি বন্ধ করার কোন উদ্যোগ না নিয়ে, শুধু চেয়ে চেয়ে দেখছে তো দেখছে। এতো পৃষ্ঠপোষকতার শামিল। একুশের চেতনায় মন্ত্রণালয় শিশু শিক্ষার কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করুক। এ আশা রাখছি। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনার প্রতি আহ্বান, দেশের সকল শিশুর শিক্ষায় বিদেশি ভাষায় বই নিষিদ্ধ করুন। এতে শিশু শিক্ষা সমৃদ্ধ ও জ্ঞান অর্জনমুখী হতে সক্ষম হবে। একুশের চেতনায় ছোট্ট সোনামনিদের পাঠদান হোক মাতৃভাষায়। সকলের মাঝে মা, মাতৃভাষা ও মাতৃভূমির প্রতি শ্রদ্ধা ও ভালবাসা জাগ্রত হতে হবে। বিদেশি ভাষায় শিশু শিক্ষা মুক্ত থাকুক। একুশের চেতনায় বেড়ে উঠুক আগামী প্রজন্ম।
মাতৃভাষায় হাতেখড়ির শপথ হোক ফেব্রুয়ারির। এ প্রত্যাশা দ্রুত বাস্তবায়নে সংশ্লিষ্টদের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি।
লেখক : মো. সিদ্দিকুর রহমান, সভাপতি, বঙ্গবন্ধু প্রাথমিক শিক্ষা গবেষণা পরিষদ; সম্পাদকীয় উপদেষ্টা, দৈনিক শিক্ষাডটকম।