গ্লোবাল পার্টনারশিপের এক বিশ্লেষণে দেখা যায, বাংলাদেশে মাথাপিছু জিডিপির (মোট দেশজ উৎপাদন) বিপরীতে মাধ্যমিকের শিক্ষার্থীপ্রতি ব্যয়ের পরিমাণ ১০ দশমিক ২ শতাংশ, যেখানে ভারতে এ হার ১৬ দশমিক ৮২ শতাংশ। পাকিস্তান মাথাপিছু জিডিপির বিপরীতে মাধ্যমিকের শিক্ষার্থীপ্রতি ব্যয় করে ১৫ দশমিক ২২ শতাংশ। এছাড়া মালয়েশিয়ায় মাথাপিছু জিডিপির ২২ দশমিক ৯৭ ও সিঙ্গাপুর ২২দশমিক ২২ শতাংশ মাধ্যমিকের শিক্ষার্থীপ্রতি ব্যয় করে। ইউনেস্কো ইনস্টিটিউট অব স্ট্যাটিসিটিকসের (ইউআইএস) তথ্য উপাত্তের ভিত্তিতে ‘এডুকেশন সেক্টর অ্যানালাইসিস (ইএসএ) ফর বাংলাদেশ’ শীর্ষক প্রতিবেদনে এসব তথ্য তুলে ধরে গ্লোবাল পার্টনারশিপ। পাঁচটি দেশের তুলনামূলক বিশ্লেষণে দেখা যায়, মাথাপিছু জিডিপির বিপরীতে মাধ্যমিকের শিক্ষার্থীপ্রতি ব্যয়ে সবচেয়ে পিছিয়ে রয়েছে বাংলাদেশ।
একটি কথা আমাদের স্বীকার করতে হবে, স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছরে শিক্ষা ব্যবস্থার ব্যাপক প্রসার হয়েছে, তবে সেটি পরিকল্পিত উপায়ে ঘটেনি। বিশেষ করে মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষায় এ সংকট প্রকট। গত পাঁচ দশকে দেশে কয়েক হাজার মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের অনুমোদন দেয়া হয়েছে, যার প্রায় সবই বেসরকারি। বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় পরিচালিত হওয়ায় ইউনিফরম কোনো ব্যবস্থা গড়ে ওঠেনি এ পর্যায়ের শিক্ষা ব্যবস্থায়। অথচ মাধ্যমিক স্তর হচ্ছে গোটা শিক্ষা ব্যবস্থার মেরুদণ্ড। বেসরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের পরিচালনার জন্য রয়েছে একটি স্থানীয় কমিটি, যা ‘স্কুল ম্যানেজিং কমিটি’ নামে পরিচিত। শিক্ষা ব্যবস্থাপনায় স্থানীয় প্রতিনিধির সক্রিয় অংশগ্রহণ নিশ্চিত করার মাধ্যমে শিক্ষাকে ‘সাসটেনেবল’ করা ও মান উন্নীত করার জন্য এই ব্যবস্থা। কিন্তু এই ব্যবস্থাই মাধ্যমিক শিক্ষার মানকে তলানিতে নিয়ে গেছে। অপরাজনীতি আর অযোগ্যদের দৌরাত্ম্যে মাধ্যমিক শিক্ষার করুণ হাল হয়েছে। অনেক প্রতিষ্ঠানই অর্থাভাবে শিক্ষক নিয়োগ দিতে পারছে না। নাজুক অবস্থানে থাকছে অবকাঠামো। কোনো ধরনের প্রশিক্ষণ ছাড়াই উল্লেখযোগ্যসংখ্যক শিক্ষক শ্রেণিকক্ষে পাঠদান করছেন। জীবনে একবার প্রশিক্ষণ পেলেই একজন শিক্ষক যে, ফলপ্রসূ পাঠদান করতে পারবেন এমনটিও নয়। পেশাগত উন্নয়ন বিষয়টি হচ্ছে অবিরত অনুশীলন, শেয়ারিং, শিক্ষা সংন্ত্রান্ত সভা সেমিনারে অংশগ্রহণ, পর্যবেক্ষণ, পড়াশোনা ও শিক্ষার্থীদের নিয়ে গবেষণা করা। এগুলোর কোনোটিই কিন্তু বিদ্যালয়গুলোতে নেই। এ ছাড়া শিক্ষার ব্যয় বেশি হওয়ায় স্বল্প আয়ের পরিবারের অনেক শিক্ষার্থীই মাধ্যমিকে এসে ঝরে পড়ছে। গত কয়েক বছরে কিছুসংখ্যক প্রতিষ্ঠান জাতীয়করণ করা হলেও মোটা দাগে দেশে সরকারি উদ্যোগে ভালমানের মাধ্যমিক বিদ্যালয় গড়ে ওঠেনি। তাই স্বাধীনতার পাঁচদশক পরও মাধ্যমিক শিক্ষার ভিত অনেকটাই দুর্বল। শিক্ষার মান এখন ধরা হয় কতজন শিক্ষার্থী এসএসসি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করেছে, তাদের মধ্যে কতজন পাস করেছে, একটু ভাল বিদ্যালয় হলে বলা হয় কতজন জিপিএ-৫ পেয়েছে। যেখানে শিক্ষাদান ও পুরো শিক্ষা ব্যবস্থাপনায় সমস্যা থেকে গেছে সেখানে একটি পাবলিক পরীক্ষার মূল্যায়ন যে, শিক্ষার মানের কথা বলেনা সেটি বোধ হয় আর বাড়িয়ে বলা হবে না। পাবলিক পরীক্ষার খাতা মূল্যায়নের যে পদ্ধতি, তাতে শিক্ষার্থীরা খাতায় যাই লিখুক, ফেল করার জো নেই। কাজেই এটি দ্বারা শিক্ষার মান নির্ণয় করা কতটা যুক্তিযুক্ত, সে প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে।
এসব সত্ত্বেও কিছু নামকরা বিদ্যালয় রয়েছে যেগুলোতে পড়াশোনা করলে বিদ্যালয়গুলো নিজস্ব ব্যবস্থাপনা, কালচার, ট্র্যাডিশন, পদ্ধতি এবং শিক্ষকদের ঐকান্তিক প্রচেষ্টার ফলে শিক্ষার্থীরা ব্যাসিক কিছু জ্ঞান অর্জন করে, বাস্তবধর্মী কিছু দক্ষতা অর্জন করে যা সাধারণ প্রচলিত বিদ্যালয়ে হয় না। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, সেন্ট গ্রেগরিজ, ভিকারুননিসা, হলিক্রস, মতিঝিল বয়েজ স্কুল, অজিমপুর গার্লস স্কুল। এসব বিদ্যালয়ের ট্রাডিশন, পরিবেশ, সুনাম এবং সর্বোপরি শিক্ষাদান পদ্ধতি শিক্ষার্থীদের একটু আলাদা করে গড়ে তোলে। রাজধানীতে অবস্থিত এসব স্বনামধন্য প্রতিষ্ঠানের অধিকাংশই গড়ে উঠেছিল পাকিস্তান কিংবা ব্রিটিশ শাসনামলে। একইভাবে চট্টগ্রামের খাস্তগীর, কলেজিয়েট স্কুল, ইস্পাহানি কিংবা মুসলিম হাইস্কুলের মতো নামকরা স্কুলগুলো প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল বাংলাদেশ অধ্যায়ের আগে। জেলা পর্যায়ের মাধ্যমিক শিক্ষায়ও এখানো নেতৃত্ব দিয়ে যাচ্ছে স্বাধীনতার আগে গড়ে ওঠা জিলা স্কুলগুলো। এ ধরনের বিদ্যালয় কিন্তু এখন আর হচ্ছে না। এখন হচ্ছে মার্কেটের ওপর ভাড়া নিয়ে কয়েকটি রুমে একটি বিদ্যালয়। জমির অভাব, সঠিক পরিকল্পনার অভাব আর ব্যবসায়িক মনোভাব এসব বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা পেছনে দায়ী। ভাল মানের বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করার জন্য নেই কোনো সরকারি উদ্যোগ, নেই ব্যক্তি বা সামাজিক উদ্যোগ। শিশুরু কী শিখবে? কোথায় শিখবে?
মাধ্যমিকে দুর্বলতা থেকে গেলে গোটা ব্যবস্থার ভিতই নড়বড়ে থেকে যায়। আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থায় সেটি ঘটছে। মানসম্মত পরিকল্পনার অভাবে অনেকটা বিচ্ছিন্নভাবে পরিচালিত হচ্ছে মাধ্যমিকের প্রতিষ্ঠান। নানা ক্যাটাগরিতে বিভক্ত বিদ্যালয়গুলোয় সরকারের পক্ষ থেকে তেমন কোনো কার্যকর মনিটরিং ব্যবস্থা নেই। সরকারি মনিটরিং মানেই ‘টাকার খেলা’। সেখানে মানের কোনো বিষয় নেই। যেসব অর্থ বিনিয়োগ করা হচ্ছে পরিকল্পনার অভাবে সেটির আউটকামও নিশ্চিত হচ্ছে না। ব্রিটিশ আমল কিংবা স্বাধীনতার আগে গড়ে ওঠা বিদ্যালয়গুলোয় খেলার মাঠ থেকে শুরু করে শিক্ষার্থীদের বিকাশের উন্মুক্ত পরিবেশ রয়েছে। এখন একটি ভবন ও কয়েকজন শিক্ষক নিয়েই গড়ে তোলা হচ্ছে বিদ্যালয়। ভাল ও নামকরা বিদ্যালয় গড়ে তুলতে হলে অবশ্যই সেখানে শিক্ষার মানসম্মত পরিবেশ গড়ে তুলতে হবে। গত কয়েক দশকে ঢাকায় কয়েকটি মডেল বিদ্যালয় গড়ে তোলা হলেও সারা দেশে সে মডেল অনুসরণ করতে দেখা যায়নি। বাংলাদেশ শিক্ষা তথ্য ও পরিসংখ্যান ব্যুরোর (ব্যানবেইস) সর্বশেষ প্রকাশিত শিক্ষা পরিসংখ্যান অনুযায়ী বর্তমানে দেশে মাধ্যমিক বিদ্যালয় রয়েছে ২০ হাজার ১৭৯টি। এগুলোর মধ্য সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয় মাত্র ৬৮৩টি। তার মানে হচ্ছে দেশের মাধ্যমিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ৩ শতাংশ সরকারি ব্যবস্থাপনায় পরিচালিত হচ্ছে। বাকি সাড়ে উনিশ হাজার বিদ্যালয়ই পরিচালিত হচ্ছে বেসরকারি ব্যবস্থপনায়। এর বাইরে প্রায় ছয় হাজার দাখিল মাদ্রাসা রয়েছে।
সঠিক ও উপযুক্ত বিনিয়োগের অভাবে নানা ধরনের সংকটে ভুগছে দেশের মাধ্যমিক শিক্ষা। ব্যানবেইসের সর্বশেষ প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুযায়ী দেশের মাধ্যমিক বিদ্যালয়গুলোয় শিক্ষক রয়েছেন ২ লাখ ৫২ হাজার ৫০৫ জন। এর মধ্যে বিএড, বিপিএ, এমএড-এ ধরনের প্রশিক্ষণ নিয়েছেন ১ লাখ ৬৭ হাজার ৬৫২ জন। সে হিসেবে মাধ্যমিকে প্রায় ৮৫ হাজার শিক্ষক এখনো প্রশিক্ষণ ছাড়াই শ্রেণিকক্ষে পাঠদান করছেন যা মোট শিক্ষকের ৩৩ দশমিক ৬শতাংশ। এ ছাড়া অর্থের অভাবে অনেক বেসরকারি বিদ্যালয়ই প্রয়োজনীয় সংখ্যক শিক্ষক নিয়োগ দিতে পারে না। বেসরকারি স্কুলগুলোয় অভিভাবকদের শিক্ষা ব্যয়ের পরিমাণও অনেক বেশি। এ ব্যয়ভার বহন করতে না পারায় শিক্ষার্থীদের একটি বড় অংশ মাধ্যমিক পর্যায় থেকে ঝরে পড়ছে। কোভিড-১৯ মহামারি এই অবস্থাকে আরও নড়বড়ে করে দিয়েছে। কোভিডের কারণে মাধ্যমিক পর্যায়ে ৪৫ শতাংশ শিক্ষার্থীর ঝরে পড়ার একটি খবর বিভিন্ন পত্রিকায় এসেছে। এটি উদ্বেগজনক। দেশের গোটা শিক্ষা ব্যবস্থায় ঝরে পড়ার হার সবচেয়ে বেশি মাধ্যমিকে। শিক্ষা পরিসংখ্যান প্রতিবেদন অনুযায়ী বর্তমানে দেশে মাধ্যমিক স্করের শিক্ষার্থীর সংখ্যা এক কোটি ৩ লাখ ৪৯ হাজার ৩২৩ জন। এর মধ্যে ছাত্রী ৫৩ দশমিক ৮৩ শতাংশ। মাধ্যমিকে এসব শিক্ষার্থীর ৩৬ দশমিক ৭৩ শতাংশই দশম শ্রেণি শেষ করার আগে ঝরে পড়ে। শিক্ষার্থী ঝরে পড়ার পেছনে আটটি কারণ রয়েছে। এগুলো হচ্ছে পরিবার অন্যত্র চলে যাওয়া, বই-খাতাসহ লেখাপড়ার উপকরণ নষ্ট হয়ে যাওয়া, তাৎক্ষণিকভাবে স্কুলের ব্যয় বহনে অক্ষমতা, মা-বাবাকে গৃহস্থালি কাজে সহায়তা, উপাজর্ন বা ভাগ্যান্বেষণে নেমে পড়া, লেখাপড়ায় আর আগ্রহ না পাওয়া, স্কুলে যেতে নিরাপাদ বোধ না করা, যাতায়াতে যানবাহন সংকট সমস্যা। ছেলেদের ক্ষেত্রে ১৭ দশমিক ১৫ আর মেয়েদের ক্ষেত্রে ১৭ দশমিক ৫৬ শতাংশ্ই মা-বাবাকে ঘরের বা আয়-উপার্জনের কাজে সহায়তার কারণে স্কুলে আসে না। স্কুলে যাওযার ক্ষেত্রে এর পরের সবচেয়ে বড় বাধা দুর্যোগ-পরবর্তী যানবাহনের সংকট। ১৬ দশমিক ৩০ শতাংশ ছেলে ও ১৭দশমিক ২৭শতাংশ মেয়ে এ কারণে স্কুলে যায় না। উভযের ক্ষেত্রে স্কুলে না যাওয়ার তৃতীয় কারণ হচ্ছে লেখাপড়ায় আগ্রহ না থাকা। ১০ দশমিক ৯৭ শতাংশ ছেলে ও ১১ দশমিক ২২ শতাংম মেয়ে এ কারণে স্কুলে যায় না।
রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনায় প্রতিবছরই দু’একটি করে বিদ্যালয় সরকারি করা হচ্ছে। বেছে বেছে সরকারি করা হচ্ছে অর্থাৎ তেলা মাথায় তেল দেয়া হচ্ছে। যদি এমন হতো যে, পিছিয়ে পড়া এলাকাগুলোর বিদ্যালয় সরকারি করা হচ্ছে তাহলে বোঝা যেত, সরকার দরিদ্র শ্রেণি, পিছিয়ে পড়া এলাকার শিক্ষার্থীদের জন্য এ ব্যবস্থা করেছেন, সেটি তো হচ্ছে না। শহর কিংবা উপজেলার ভাল স্কুলটি সরকারি করা হচ্ছে যেখানে ইতিমধ্যে ভাল ভাল শিক্ষক রয়েছেন, অভিভাবকগন অনেকটাই স্বচছল, তদুপরি সরকারি স্কুলের টিউশন ফি নামমাত্র। আর প্রত্যন্ত এলাকার শিক্ষার্থীরা না পাচ্ছে ভাল বিদ্যালয়, না পাচ্ছে ভাল শিক্ষা। উচচমূল্যে তাদের প্রতিষ্ঠান থেকে শিক্ষা কিনতে হচ্ছে যার সামর্থ্য তাদের অনেকেরই নেই। কে দেখবে এসব?
লেখক : মাছুম বিল্লাহ, কান্ট্রি ডিরেক্টর, ভলান্টিয়ারস অ্যাসোসিয়েশন ফর বাংলাদেশ (ভাব) এবং প্রেসিডেন্ট- ইংলিশ টিচার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ ( ইট্যাব)।