মানসম্মত শিক্ষক ছাড়া মানসম্মত শিক্ষা অর্জিত হবে না - দৈনিকশিক্ষা

মানসম্মত শিক্ষক ছাড়া মানসম্মত শিক্ষা অর্জিত হবে না

দৈনিকশিক্ষা ডেস্ক |

দেশের শিক্ষাব্যবস্থাকে মানসম্মত পর্যায়ে উন্নীত করতে হলে সরকারি, বেসরকারি ও ব্যক্তিমালিকানাধীন পরিচালিত শিক্ষাব্যবস্থার সামগ্রিক উন্নয়নের সঙ্গে শিক্ষকদের আর্থিক ও সামাজিক মানোন্নয়নের কোনো বিকল্প নেই। তবে দেশের শিক্ষাব্যবস্থা যেভাবে বহুধাবিভক্ত হয়ে আছে, তাতে শুধু সরকারি কিংবা বেসরকারি অথবা ব্যক্তিমালিকানাধীন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার মান আলাদাভাবে বৃদ্ধি করলে সেটি হবে আংশিক। আবার সমন্বিতভাবে করাও এখন বেশ জটিল। কিন্তু যেভাবে চলছে, সেভাবে চলতে দেওয়া হলে তা মানবসম্পদ উন্নয়ন ও জাতীয় অগ্রগতি অর্জনে খুব একটা সাফল্য বয়ে আনবে না। শনিবার (২৩ এপ্রিল) কালের কণ্ঠ পত্রিকায় প্রকাশিত উপসম্পাদকীয়তে এ তথ্য জানা যায়।   

উপসম্পাদকীয়তে আরও জানা যায়, পুরো শিক্ষাব্যবস্থার প্রতিটি ধারায়ই একদিকে নিয়ম-নীতি, শৃঙ্খলা ও শিক্ষার কার্যক্রম যথাযথভাবে পরিচালিত হচ্ছে না বলে যথেষ্ট প্রমাণ রয়েছে; অন্যদিকে সেগুলোতে বিচ্ছিন্নভাবে পরিবর্তন সাধনের উদ্যোগ নেওয়ার ক্ষেত্রেও জটিলতা বাড়বে বৈ কমবে না। পুরো শিক্ষাব্যবস্থাই এখন মানের সংকটে জর্জরিত। শিক্ষা প্রশাসন স্থানীয় পর্যায়ের সমস্যা দূরীকরণে আমলাতান্ত্রিক জটিলতায় আটকে আছে। কোনো রকম কার্যকরী উদ্যোগ বা ভূমিকা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এবং শিক্ষা প্রশাসন সমন্বিতভাবে নেওয়ার নজির স্থাপন করতে পারছে না। ফলে গ্রাম কিংবা শহরের কোথাও সরকারি, বেসরকারি বা ব্যক্তিমালিকানাধীন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো মানসম্মত শিক্ষা কার্যক্রমে খুব বেশি প্রশংসনীয় দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে পারছে না। পুরো শিক্ষাব্যবস্থাই সে কারণে যেভাবে চলছে, সেভাবে চলার মাধ্যমে জাতির কোনো লাভ বয়ে আনবে না।
আমরা চাই বেসরকারি এমপিওভুক্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষক-কর্মচারীদের সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি করার মাধ্যমে প্রতিষ্ঠানগুলোর মানসম্মত শিক্ষাদানের সক্ষমতা বৃদ্ধি করা। মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিক ও স্নাতক পর্যায়ের শিক্ষাব্যবস্থার বেশির ভাগই এখন বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ওপর ন্যস্ত করা হয়েছে। এটি অতীতের একটি ধারাবাহিকতার ফসল। তবে একসময় বেসরকারি অনুমোদনপ্রাপ্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা, অনুমোদন এবং কার্যক্রম পরিচালিত হওয়ার ক্ষেত্রে সরকারের ভূমিকা ছিল খুবই নগণ্য ও অবহেলিত। একটি দেশের শিক্ষাব্যবস্থায় এভাবে স্কুল থেকে কলেজ পর্যায়ে শিক্ষাব্যবস্থা গড়ার বিষয়ে সরকারের নজরদারি, নিয়ম-নীতি, আইন এবং আর্থিকভাবে দায়িত্ব না নেওয়ার বিষয়টি সরকারের দায়িত্বহীনতার পরিচয় বলে বিবেচনা করা যেতে পারে।

১৯৭৩ সালে বঙ্গবন্ধু প্রায় ৩৮ হাজার প্রাথমিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান জাতীয় করেছিলেন। মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিক ও কলেজ শিক্ষা তখনো অনেকটাই ব্যক্তিমালিকানাধীন বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হিসেবে শিক্ষা বোর্ড কর্তৃক কিছু নিয়ম-কানুনে পরিচালিত হতো। বঙ্গবন্ধুপরবর্তী সরকারগুলো ক্রমবর্ধমান মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষার চাহিদার গুরুত্ব উপলব্ধি করতে পারেনি। বিচ্ছিন্ন, বিক্ষিপ্তভাবে ও রাজনৈতিক বিবেচনায় কিছু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সরকারীকরণ, এমপিওভুক্তি, শিক্ষক ও কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন-ভাতার কিছু অংশ সরকারি কোষাগার থেকে দেওয়ার প্রথা চালু করে।

এর ফলে বেসরকারি এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান একদিকে যেমন অবহেলার শিকার হয়, অন্যদিকে শিক্ষক-কর্মচারী নিয়োগে স্বজনপ্রীতি, দুর্নীতি এবং অযোগ্য ব্যক্তিদের নিয়োগদানের ধারা সৃষ্টি হয়। সে কারণে প্রাথমিক, মাধ্যমিক শিক্ষা থেকে কলেজ শিক্ষা পর্যন্ত পুরো শিক্ষাব্যবস্থাই অনিয়ম ও মানহীনতার সংকটে পড়ে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোও নিজেদের সুবিধা বৃদ্ধির জন্য নানা সমিতি ও ফেডারেশনের মাধ্যমে আন্দোলন-সংগ্রাম করে সরকারের কাছ থেকে নিজেদের আর্থিক সুযোগ-সুবিধা আদায় করে নিতে থাকে। ফলে বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো রাজনৈতিক দলগুলোর এক ধরনের সমর্থক খুঁটি হিসেবে ব্যবহৃত হতে থাকে। একটি দেশে এত ব্যাপকসংখ্যক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে এভাবে ঠেলে দিয়ে মাধ্যমিক ও কলেজ শিক্ষাকে যে অবয়ব ও চরিত্র দান করা হয়েছে তার ফলে বেশির ভাগ স্কুল, কলেজ ও আলিয়া মাদরাসা মানসম্মত শিক্ষাদানের সক্ষমতা অর্জন করতে পারেনি। তবে প্রতিটি সরকারই বেসরকারি শিক্ষকদের বেতন-ভাতা কিছু কিছু করে বৃদ্ধি করেছে।

বেসরকারি এমপিওভুক্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে সবচেয়ে সহানুভূতি দেখিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।   এমপিওভুক্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষক ও কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মূল বেতনের শতভাগ ছাড়াও চিকিৎসা, আংশিক বাড়িভাড়া এবং উৎসবভাতা প্রদানের ব্যবস্থা তিনি করায় এখন আর এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে আন্দোলন করতে দেখা যায় না। তবে এভাবে অপরিকল্পিতভাবে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠার প্রবণতা রোধ করা যায়নি। যোগ্য শিক্ষকও এমপিওভুক্ত, রেজিস্টার্ড, নন-এমপিওভুক্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে আশানুরূপভাবে নিয়োগ প্রদান করা যায়নি। প্রতিষ্ঠানে নিয়োগ প্রদানে ক্ষমতার অপব্যবহার যথেচ্ছভাবে করা হয়েছে। অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নামমাত্র স্বল্পসংখ্যক শিক্ষার্থী নিয়ে এমপিওভুক্তি করার তদবির আন্দোলন করে সফল হয়েছে। এমনকি সরকারীকরণের ক্ষেত্রেও রাজনীতির প্রভাব, দুর্নীতি ব্যাপকভাবে ঘটেছে।

এসব এমপিওভুক্ত ও জাতীয়করণ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার মান বৃদ্ধি করার ক্ষেত্রে সরকার ভবন নির্মাণসহ নানা ধরনের আর্থিক অনুদান ও সুযোগ-সুবিধাও বৃদ্ধি করেছে। এখন দেখার বিষয় হলো যেসব বিদ্যালয়, মাধ্যমিক  কলেজ ও মাদরাসা এমপিওভুক্ত, জাতীয়করণসহ নানা ধরনের সুযোগ-সুবিধা পেয়েছে, সেগুলোর কত শতাংশ শিক্ষার মানোন্নয়নে ভূমিকা রাখতে পেরেছে। যারা পারেনি, কেন পারেনি—সেটিও খতিয়ে দেখা দরকার। এখন অবশ্য শিক্ষক নিয়োগের বিষয়টি অনেকটাই সরকারের হাতে নিয়ে আসা হয়েছে। এর পরও প্রধান শিক্ষক, সহকারী প্রধান শিক্ষক, অধ্যক্ষ, উপাধ্যক্ষ ও কর্মচারী নিয়োগের বিষয়টি পরিচালনা পরিষদের হাতে রেখে দেওয়া হয়েছে। এতেও অনিয়ম, দুর্নীতি এবং অদক্ষ ও অযোগ্যদের নিয়োগ লাভের সুযোগ ঘটেছে। সরকারি-বেসরকারি শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষা এবং চূড়ান্ত নিয়োগে দুর্নীতি কিছুটা কমলেও মেধাবী, দক্ষ ও প্রতিশ্রুতিশীল শিক্ষক আশানুরূপভাবে নিয়োগপ্রাপ্ত হচ্ছে না।

এমপিওভুক্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের আইন, নিয়মবিধি ব্যাপকভাবে পরিবর্তন করা প্রয়োজন। শিক্ষক-কর্মচারীদের প্রতিষ্ঠান বদলির নিয়ম অন্তর্ভুক্ত করা দরকার, অতিরিক্ত শিক্ষাগত যোগ্যতা, দক্ষতাসম্পন্ন শিক্ষকদের বেতন স্কেলে ভিন্নতা থাকা বাঞ্ছনীয়। প্রাথমিক শিক্ষায় শিক্ষকদের ন্যূনতম শিক্ষাগত যোগ্যতা ডিগ্রি পাস, মাধ্যমিক স্কুল ও সমমানের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে মাস্টার্স এবং স্নাতক (সম্মান) কলেজগুলোতে প্রভাষক পদে বিশ্ববিদ্যালয়ের সমমানের শিক্ষা ও গবেষণার যোগ্যতা আবশ্যকীয় করা প্রয়োজন। মানসম্মত শিক্ষক ছাড়া মানসম্মত শিক্ষা অর্জিত হবে না। মানসম্মত শিক্ষককে প্রাইভেট কোচিংমুক্ত শিক্ষকতার সুযোগ এবং পরিবেশ প্রদান করতে হবে। এ ধরনের বহুমাত্রিক উদ্যোগই কেবল শিক্ষাক্ষেত্রে বর্তমান হতাশার অবস্থানকে পরিবর্তন করতে পারবে।

লেখক : মমতাজউদ্দীন পাটোয়ারী, অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক, বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়

ছুটি না বাড়ালে বাড়ি যেতে হতে পারে ঈদের দিন - dainik shiksha ছুটি না বাড়ালে বাড়ি যেতে হতে পারে ঈদের দিন হাইস্কুলে কমেছে দশ লাখের বেশি শিক্ষার্থী - dainik shiksha হাইস্কুলে কমেছে দশ লাখের বেশি শিক্ষার্থী জালিয়াতি করে পদোন্নতি শিক্ষা ক্যাডার গ্যাঁড়াকলে - dainik shiksha জালিয়াতি করে পদোন্নতি শিক্ষা ক্যাডার গ্যাঁড়াকলে রুয়েটের সাবেক উপাচার্য-রেজিস্ট্রারের বিরুদ্ধে মামলা - dainik shiksha রুয়েটের সাবেক উপাচার্য-রেজিস্ট্রারের বিরুদ্ধে মামলা উপবৃত্তির জন্য সংখ্যালঘু কোটার তথ্য চেয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয় - dainik shiksha উপবৃত্তির জন্য সংখ্যালঘু কোটার তথ্য চেয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয় প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগে সতর্কীকরণ বিজ্ঞপ্তি - dainik shiksha প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগে সতর্কীকরণ বিজ্ঞপ্তি উপবৃত্তির জন্য সংখ্যালঘু কোটার তথ্য চেয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয় - dainik shiksha উপবৃত্তির জন্য সংখ্যালঘু কোটার তথ্য চেয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয় হাইস্কুলে কমেছে দশ লাখের বেশি শিক্ষার্থী - dainik shiksha হাইস্কুলে কমেছে দশ লাখের বেশি শিক্ষার্থী please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0031659603118896