মামুনুলের দখল থেকে মুক্ত হচ্ছে জামি'আ রাহমানিয়া আরাবিয়া মাদরাসা - দৈনিকশিক্ষা

মামুনুলের দখল থেকে মুক্ত হচ্ছে জামি'আ রাহমানিয়া আরাবিয়া মাদরাসা

নিজস্ব প্রতিবেদক |

মোহাম্মদপুরের জামি'আ রাহমানিয়া আরাবিয়া মাদরাসা ঘিরে প্রায় দুই দশকের বেশি সময় ধরে একটি দুষ্টচক্র গড়ে তুলেছেন হেফাজতে ইসলামের যুগ্ম মহাসচিব মামুনুল হক। ওই প্রতিষ্ঠানটিতে রাজনীতি ঢোকান মামুনুলের বাবা মাওলানা আজিজুল হক। তিনি বিএনপি নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোটের শরিক ছিলেন। বর্তমানে আজিজুলের চার ছেলে, নাতিসহ অন্তত ২০ আত্মীয় প্রতিষ্ঠানটিতে শিক্ষকতা করছেন। এটা যেন তাদের 'পারিবারিক সম্পত্তি'।

এই মাদরাসায় রাজনীতির বীজ বপনের বিরোধিতা করায় ৩৫ জন শিক্ষককে একযোগে প্রতিষ্ঠান থেকে বের করে দেওয়া হয়। পুরোনো পাঁচজন শিক্ষক আর মামুনুলদের পছন্দের লোক নিয়োগ দিয়ে চলছে এই প্রতিষ্ঠান। তবে মাদরাসা থেকে বিতাড়িতরা অনেক আগেই আদালতের শরণাপন্ন হন। গত বছর আদালত থেকে তাদের পক্ষে রায়ও হয়।

জেলা প্রশাসন ও আদালত থেকে তিন দফায় রায় বাস্তবায়নের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। মামুনুল গ্রেপ্তারের পর আবার নড়েচড়ে বসেছেন বিতাড়িত সেই শিক্ষকরা। গতকাল বৃহস্পতিবার তারা মাদরাসায় নিজেদের অধিকার প্রতিষ্ঠায় প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে পুলিশের তেজগাঁও বিভাগের ডিসি বরাবর লিখিত আবেদন করেন। সেখানে তারা আদালতের রায়ের অনুলিপি সংযুক্ত করে দেন।

এ ব্যাপারে জানতে চাইলে ঢাকা মহানগর পুলিশ কমিশনার মোহা. শফিকুল ইসলাম বলেন, মাদরাসার বিষয়ে আদালতের রায়ের ব্যাপারে করণীয় নির্ধারণে আইনজীবীর সঙ্গে পরামর্শ করা হবে। এরপর দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়া হবে। মামুনুল ও তার সাঙ্গোপাঙ্গদের মাধ্যমে কেউ হয়রানি ও প্রতারণার শিকার হলে তা নির্ভয়ে পুলিশকে জানানোর অনুরোধ করেন কমিশনার।

পুলিশের তেজগাঁও বিভাগের ডিসি হারুন অর রশিদ বলেন, মাদরাসাটি দখল করে রেখেছিলেন মামুনুল ও তাদের পরিবারের লোকজন। যারা এই চক্রের মাধ্যমে বঞ্চনার শিকার, তাদের পক্ষ থেকে একটি আবেদন পেয়েছি। আদালতের নির্দেশনার আলোকে যথাযথ কর্তৃপক্ষের কাছে এর নিয়ন্ত্রণ বুঝিয়ে দেওয়া হবে। উগ্রবাদী কায়দায় সেখানে যারা কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করেছিল, তাদের আইনের আওতায় নেওয়া হবে। মামুনুল ও তার লোকজন মাদরাসা দখলের ঘটনায় জড়িত হলে শাস্তির মুখোমুখি হতে হবে।

জামি'আ রাহমানিয়া আরাবিয়া মাদরাসার অন্তত সাতজন সাবেক শিক্ষকের সঙ্গে গতকাল কথা হয় এই প্রতিবেদকের। তাদের মধ্যে অন্যতম হলেন মুফতি হিফজুর রহমান। তিনি একসময় মাদরাসাটির অধ্যক্ষ ছিলেন। ২০০১ সালে তাকেসহ ৩৬ শিক্ষককে একযোগে প্রতিষ্ঠানটি থেকে অন্যায়ভাবে বের করে দেওয়া হয়। হিফজুর জানান, ১৯৮৬ সালে এই মাদরাসা প্রতিষ্ঠিত হয়। প্রতিষ্ঠাতা সদস্য ছিলেন ১০ জন। তাদের মধ্যে সিনিয়র ছিলেন শায়খুল হাদীস মাওলানা আজিজুল হক। তাই শুরুতে তাকে ঘিরেই এ মাদরাসা পরিচালিত হতো। ওয়াক্‌ফ সম্পত্তির ওপর এটি গড়ে ওঠে। হাজি মোহাম্মদ আলী ও নূর হোসেন এ সম্পত্তির মালিক ছিলেন। মাদরাসাটির প্রতিষ্ঠাতা সদস্য হিসেবে তাদেরও নাম রয়েছে।

কেন একসঙ্গে এতজন শিক্ষককে বের করে দেওয়া হয়- জানতে চাইলে তিনি জানান, প্রতিষ্ঠার সময় থেকেই এর আদর্শ ছিল- এখানে কোনো রাজনীতি করা যাবে না। তবে মামুনুল হকের বাবা প্রথম এ প্রতিষ্ঠানে রাজনীতি ঢোকান। শিক্ষকদের দু-চারজন বাদে প্রায় সবাই এর বিরোধিতা করেন। মিছিল-সমাবেশে মাদরাসা থেকে ছাত্রদের ডেকে নেওয়া হতো। বিভিন্ন সময় রাজনীতিতে জড়াতে গিয়ে মাদরাসার ছাত্ররা গ্রেপ্তারও হয়। মাদরাসা ঘিরে রাজনীতি করার বিরোধিতা করতে গিয়েও একসঙ্গে এতসংখ্যক শিক্ষককে বের করে দেওয়া হয়। মাদরাসায় ছাত্র মজলিস করার কারণে আজিজুল হকের ছেলে মামুনুল হককে ছাত্রাবস্থায় ওই প্রতিষ্ঠান থেকে বহিস্কারও করা হয়।

হিফজুর রহমান আরও বলেন, পরবর্তী সময়ে মাদরাসাটিকে একটি পারিবারিক সম্পত্তি হিসেবে রূপ দেন মামুনুল হক ও তার স্বজনরা। তারাই এটি নিয়ন্ত্রণ করে আসছিলেন। আদালত ও জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে তিন দফায় মামুনুল হকসহ অবৈধ দখলদারদের উচ্ছেদ করার নির্দেশনা দিলেও তা বাস্তবায়িত হয়নি।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, মামুনুলের আর ৪ ভাই ও ৮ বোন আছেন। এর মধ্যে মামুনুলসহ চার ভাই এ মাদরাসার শিক্ষক। অন্যরা হলেন- মাহফুজুল হক, মাহমুদুল হক ও মাহবুবুল হক। তাদের একাধিক ভাগিনা ও ভাতিজা সেই মাদরাসার শিক্ষক।

জানা গেছে, ২০০১ সালে বিএনপি নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট ক্ষমতায় আসার পর শহিদুল ইসলামের নেতৃত্বে মাদরাসাটির তৎকালীন অধ্যক্ষসহ পরিচালনা কমিটির অন্যদের উচ্ছেদ করা হয়। ওই উচ্ছেদে স্থানীয় বিএনপি ও জামায়াত-শিবির কর্মীদের জড়ো করা হয়েছিল। তৎকালীন প্রশাসনও এতে সহায়তা করে।

জানা গেছে, মামুনুল ও তার লোকজন মাদরাসায় নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার পর আশপাশের জমি দখল করে স্থাপনা নির্মাণ করেন। মাদরাসা  ভবনের উত্তরদিকে চাঁন মিয়া হাউজিং। ওই অংশের ৬০ ফুট দৈর্ঘ্য ও ১৫ ফুট প্রশস্ত খালি জায়গা দীর্ঘ দিন মাদরাসা প্রাচীরের মধ্যে খালি পড়ে ছিল। কিন্তু সেটা মাদরাসার সম্পদ নয়। সম্প্রতি মাদরাসার মূল অংশের সঙ্গে সংযুক্ত করে খালি জায়গাটিতে স্থাপনা নির্মাণের উদ্যোগ নেয় কর্তৃপক্ষ। চাঁন মিয়া হাউজিং কর্তৃপক্ষ জানায়, খালি ওই জয়গাটি খাসজমি। মাদরাসা কর্তৃপক্ষের ওই খাসজমি দখল করে স্থাপনা নির্মাণের বিরোধিতা করেন তারা।

মামুনুল ওই মাদরাসার নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার পর যারা প্রতিষ্ঠানটি ছেড়ে চলে যেতে বাধ্য হন, তাদের মধ্যে রয়েছেন- মুফতি হিফজুর রহমান, মুফতি মনসুরুল হক, ইব্রাহিম হেলাল, সাইদ, মিজানুর রহমান, রুহুল আমিন, ইদ্রিস, ফারুক, আবদুল কাইয়ুম, ওবায়দুল্লাহ, রেজওয়ানুর, আবদুর রাজ্জাক, হিলাল উদ্দিন, বোরহান উদ্দিন, মনিরুজ্জামান, আহমদ উল্লাহ, হাসান সিদ্দিকুর, ওমর ফারুক, আবদুর রহিম, হেলাল উদ্দিন, রুহুল আমিন, কামরুজ্জামান প্রমূখ।

মাদরাসার সাবেক শিক্ষক আবদুর রাজ্জাক বলেন, মাওলানা আজিজুল হক রাজনীতি করতে গিয়ে সর্বনাশ ডেকে আনেন। ২০০০ সালে মোহাম্মদপুরে নূর মসজিদের পাশে হরতালের দিন একজন পুলিশ হত্যার শিকার হন। ওই দিন মাদরাসা ছাত্রদের রাস্তায় জড়ো করেছিলেন আজিজুল হক ও তার লোকজন। তবে সব পরিস্থিতি তাদের অনুকূলে যায় ২০০১ সালের নির্বাচনের পর। হঠাৎ শত শত লোক লাঠিসোটা ও অস্ত্র নিয়ে মাদরাসা দখল করে। এর পর আর আমরা সেখানে ঢুকতে পারিনি।

মাদরাসার একাধিক শিক্ষক জানান, আদালত থেকে তাদের পক্ষে রায় দেওয়া হলেও এতকাল সরকারপন্থি স্থানীয় একটি প্রভাবশালী গ্রুপের কারণে তারা মাদরাসার নিয়ন্ত্রণ নিতে পারেননি। বারবার তাদের হস্তক্ষেপে প্রশাসন পিছু হটে। এটা না হলে অনেক আগেই অবৈধ দখলদারদের সেখান থেকে বিতাড়িত করা সম্ভব ছিল।

মুখোমুখি জিজ্ঞাসাবাদ :মামুনুলকে সাত দিনের রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করছে পুলিশ। এরই মধ্যে সংগঠনটির মোট ১৭ শীর্ষ নেতা গ্রেপ্তার হয়েছেন। মামুনুলকে তাদের অনেকের মুখোমুখি করে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। তবে নানা প্রশ্নের উত্তর এড়িয়ে যাচ্ছেন তিনি। আবার কিছু প্রশ্নের জবাব তার মতো করে দিচ্ছেন।

রোজায় স্কুল: শিক্ষার্থী উপস্থিতি কম, নজরদারিও ঢিলেঢালা - dainik shiksha রোজায় স্কুল: শিক্ষার্থী উপস্থিতি কম, নজরদারিও ঢিলেঢালা পেনশন প্রজ্ঞাপনে উদ্বিগ্ন ঢাবি উপাচার্য - dainik shiksha পেনশন প্রজ্ঞাপনে উদ্বিগ্ন ঢাবি উপাচার্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের গবেষণা অনুদান করমুক্ত - dainik shiksha শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের গবেষণা অনুদান করমুক্ত ব্রাজিলে তীব্র গরমে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ - dainik shiksha ব্রাজিলে তীব্র গরমে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ শিক্ষা সহায়তা ট্রাস্টের নামে প্রতারণা, সতর্কীকরণ বিজ্ঞপ্তি - dainik shiksha শিক্ষা সহায়তা ট্রাস্টের নামে প্রতারণা, সতর্কীকরণ বিজ্ঞপ্তি উচ্চ মাধ্যমিকের সমমান পেলো ‘হেট’ - dainik shiksha উচ্চ মাধ্যমিকের সমমান পেলো ‘হেট’ আটকের ১৩ দিন পরেও বরখাস্ত হননি অধ্যক্ষ - dainik shiksha আটকের ১৩ দিন পরেও বরখাস্ত হননি অধ্যক্ষ please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0069730281829834