৩ মে বিশ্ব মুক্ত গণমাধ্যম দিবস। ১৯৯১ খ্রিষ্টাব্দে ইউনেস্কোর ২৬তম সাধারণ অধিবেশনের সুপারিশে ১৯৯৩ খ্রিষ্টাব্দে জাতিসংঘের সাধারণ সভায় ৩ মে তারিখটিকে ‘ওয়ার্ল্ড প্রেস ফ্রিডম ডে’ হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া হয়। এবছর ২০২০ খ্রিষ্টাব্দে দিবসটি পালন করা হচ্ছে ‘ভয় বা পক্ষপাতিত্ববিহীন সাংবাদিকতা’ এই স্লোগানে।
সাংবাদিকতার স্বাধীনতা ও মুক্ত গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠার মৌলিক নীতিমালা অনুসরণ, বিশ্বব্যাপী গণমাধ্যমের স্বাধীনতার মূল্যায়ন, স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ প্রতিহত করার শপথ গ্রহণ এবং পেশাগত দায়িত্ব পালনকালে ক্ষতিগ্রস্ত ও জীবনদানকারী সাংবাদিকদের স্মরণ ও তাদের স্মৃতির প্রতি সম্মান ও শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করার জন্যই এই দিবসটির সূচনা।
এ বছর ২০০০ খ্রিষ্টাব্দে আন্তর্জাতিক এক সংস্থার রিপোর্টে দেখা গেছে, বিশ্বের ১৮০টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের গণমাধ্যমের স্বাধীনতার অবস্থা ১৫১তম স্থানে।
আমাদের দেশে প্রতিদিনই সাংবাদিক নির্যাতনের খবর পাওয়া যায়। করোনা সংকটে সংবাদ সংগ্রহ করতে গিয়ে নির্যাতনের শিকার হয়েছেন দেশের বেশ কয়েকজন সাংবাদিক। চাল চুরির নিউজ প্রকাশ করায় দেশে দুই গণমাধ্যম সম্পাদক ও তার প্রতিবেদেকের বিরুদ্ধে মামলাও হয়েছে। নির্যাতন, মামলা-হামলা আর রক্তচক্ষুর রোষাণলের ভেতর প্রতিনিয়ত কাজ করতে হয় এদেশের অসংখ্য সাংবাদিককে।
এই করোনায় সারা পৃথিবীর সাথে বাংলাদেশেও একজন জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক দায়িত্ব পালনরত অবস্থায় করোনায় আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন। গত এক যুগে সাংবাদিক দম্পতি সাগর-রুনিসহ রাজধানী ও জেলায় খুন হয়েছেন অনেক সাংবাদিক। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই সাংবাদিক হত্যার বিচার হয়নি এ দেশে।
এছাড়া কর্মক্ষেত্রেও সাংবাদিকরা নিজ প্রতিষ্ঠানে স্বাধীন নন। বেতন ভাতা পাননা দেশের বেশির ভাগ সাংবাদিক। ঢাকায় মাসের পর মাস বেতন পান না, তার ওপর হঠাৎ করে বেতন ভাতা পরিশোধ না করেই বন্ধ করে দেয়া হয় গণমাধ্যম। মফস্বলে এ চিত্র আরও ভয়াবহ। দেশের বেশির ভাগ জেলা প্রতিনিধিকে একটি পরিচয়পত্র ধরিয়ে দেয় গণমাধ্যম কতৃপক্ষ। নেই কোনো নিয়োগপত্র। ফলে ওই পরিচয়পত্রের অপব্যবহার করতে বাধ্য হন কেউ কেউ। আর যারা বেতন-ভাতা পান তা কেবল নিজ প্রতিষ্ঠানে সংবাদ পাঠানোর খরচ মাত্র। সাংবাদিকের পরিবার কীভাবে চলবে তা ভাবার সময় নেই মিডিয়ার মালিক পক্ষের।
এই করোনা সংকটে সাংবাদিকরা প্রথম সারির ঝুঁকিতে থাকলেও সরকারের প্রণোদনা নেই। তারপরেও কিছু সাংবাদিক নেতারা বলেন, ‘সাংবাদিকরা টিসিবির পণ্য কিনবেন।’ টিসিবির পণ্য কিনতে বিশেষ কোনো যোগ্যতা লাগে না। রাস্তার পাগল ব্যক্তিটিও অর্থ দিলে তাকে টিসিবির পণ্য দেয়ার নিয়ম রয়েছে। আর তারচে বড় কথা করোনা সংকটে অনেক সাংবাদিকের বেতন-ভাতা বন্ধ হয়ে গেছে। লাইনে দাঁড়িয়ে টিসিবির পণ্য কেনার টাকাও নেই অনেকের। তবুও সাংবাদিক প্রণোদনার জন্য হাহাকার করে না। পেটে গামছা বেঁধে দায়িত্বের দায়বদ্ধতা থেকে করোনা ঝুঁকি মাথায় নিয়েই কাজ করে যাচ্ছেন। তবু প্রণোদনা দূরে থাক নেই তাদের সামান্যটুকু স্বীকৃতি।
এদিকে দেশের কিছু কিছু গণমাধ্যম পক্ষপাতিত্ব বা দলীয়করণের সাংবাদিকতায় যুক্ত হয়েছে। দেশের বিভিন্ন সরকার আমলে রাজনৈতিক বিচারে গণমাধ্যমকে সম্প্রচার বা মিডিয়া লিস্টেড করার রেওয়াজ শুরু হয়েছে। জেলায় জেলায় রয়েছে দলীয় সাংবাদিকতা। ফলে দেশ থেকে নিরপেক্ষ সাংবাদিকতা উঠে যাচ্ছে। তৈরি হচ্ছে চাটুকারিতা, তেলবাজিসহ অপসাংবাদিকতার ভয়াবহ অবস্থা। এছাড়া জেলায় জেলায় রয়েছে সাংবাদিকতার মোড়ল। গবেষণা করলে দেখা যাবে, দেশের বেশির ভাগ জেলায় ৪-৫ জনের বেশি প্রকৃত মাঠ পর্যায়ের সাংবাদিক নেই।তবে নামধারী বা কার্ডধারী সাংবাদিকের সংখ্যা কাকদেরও ছাড়িয়ে যাবে। জেলায় জেলায় সাংবাদিক সংগঠনের নামে চলে রাজদরবার। সেখানে রাজা তার সভাসদ গড়ে তোলেন। সরকারি-বেসরকারি সুযোগ সুবিধা যা পাওয়া যায় তা মোড়লদের পেটেই যায়। তবে মাঠ পর্যায়ের সাংবাদিকদের রক্তঘামে তৈরি করা সংবাদ সরবরাহ করতে হয় মোড়ল সাংবাদিকদের। নতুবা মাঠ পর্যায়ের ওই সাংবাদিকের সাংবাদিকতা থাকবেন। রাজনৈতিক, প্রশাসনিক এমনকি মিডিয়া মালিকদের মাধ্যমেও মাঠের সাংবাদিককে শায়েস্তা করার ক্ষমতা রাখেন ওই জেলা পর্যায়ের মিডিয়া মোড়লরা।
সাংবাদিকতার সুনির্দিষ্ট নীতিমালা কিংবা সাংবাদিকদের সুরক্ষায় সরকারের পক্ষ থেকে পদক্ষেপ নেই এদেশে। যদিও এর পেছেনে জাতীয় পর্যায়ের সাংবাদিক নেতারাই প্রধান অন্তরায়।
আর এ অবস্থায় বিশ্ব মুক্ত গণমাধ্যম দিবস বা ওয়াল্ড প্রেস ফ্রিডম ডে আমাদের সাংবাদিকতায় কতটা তাৎপর্যপূর্ণ সেটাই চরম বেদনাদায়ক প্রশ্ন!
লেখক : পলাশ রায়, গণমাধ্যমকর্মী, ঝালকাঠি থেকে।