লেখাটা যখন প্রথম পড়লাম, চোখে পানি এসে গিয়েছিল। সারা শরীরের লোমকূপ দাঁড়িয়ে গিয়েছিল অন্যরকম আবেগে। পৃথিবীতে এমন মা কয়জন আছেন, যিনি সব প্রতিকূলতাকে পেছনে ফেলে সন্তানকে এত দূর নিয়ে আসতে পারেন। গর্ভপাত করে সন্তানকে নষ্ট করে ফেলার নির্দেশ দিয়েছিল ডাক্তাররা। মা সেই নির্দেশ শোনেননি। সেরিব্রাল পালসি সেই সন্তানকে একা লালনপালন করেছেন। ছেলের ভালো স্কুলের ব্যয় নির্বাহ করতে গিয়ে এক সঙ্গে তিনটি চাকরি করেছেন। যত দুর্যোগময় আবহাওয়া হোক, ছেলেকে নিয়ে গেছেন থেরাপি সেন্টারে। এত কষ্টের ফল তিনি পেয়েছেন। মায়ের সেই ছেলে আজ হার্ভার্ডের ছাত্র। শুক্রবার (২৩ আগস্ট) প্রথম আলো পত্রিকায় প্রকাশিত এক নিবন্ধে এ তথ্য জানা যায়। নিবন্ধটি লিখেছেন মনিজা রহমান।
মায়ের ভালোবাসা পৃথিবীতে যে কত বিস্ময় সৃষ্টি করতে পারে, এই হৃদয়স্পর্শী ঘটনাটি তার আরেক প্রমাণ। যদি আপনি প্রতিবন্ধী সন্তানের পিতা-মাতা হন, তাহলে আপনাকে অন্যরকম শক্তি ও অনুপ্রেরণা জোগাবে এই ঘটনা। অসামান্য সেই মায়ের নাম জোউ হংগুয়ান। ১৯৮৮ খ্রিষ্টাব্দে মধ্য চীনের এক হাসপাতালে একমাত্র সন্তানের জন্ম দেন তিনি। কিন্তু সন্তান ডিংডংয়ের জন্মের সময়টা আনন্দদায়ক ছিল না। নানা ধরনের জটিলতার সৃষ্টি হয়। যে কারণে শিশুটি জন্মাবার সময় অক্সিজেনের অভাবে নিশ্বাস–প্রশ্বাসের সমস্যা হয়েছিল।
জন্মকালীন এই ধরনের জটিলতা থাকলে শিশুরা সাধারণত সেরিব্রাল পালসি রোগে আক্রান্ত হয়। তখন হুবেই প্রদেশের ডক্টররা শিশুটিকে পৃথিবীর আলো না–দেখানোর সিদ্ধান্ত নেয়। একটি সদ্যোজাত শিশুর প্রতি এমন নিষ্ঠুর আচরণের কারণ কি? কারণ এই শিশু বড় হওয়ার পরে হয় প্রতিবন্ধী, নয়তো বিচার–বুদ্ধিহীন অবস্থায় বেড়ে উঠবে।
দুর্ভাগ্যজনকভাবে ডাক্তারদের সিদ্ধান্তের সঙ্গে একমত হয়ে যায় শিশুটির বাবা। সেও মনে করে, বড় হয়ে তার এই সন্তান তাদের জন্য বোঝা হয়ে দেখা দেবে। কিন্তু মা জো দৃঢ় সংকল্পবদ্ধ ছিলেন, তিনি শিশুকে সে বড় করবেন। পরবর্তী সময়ে এই দম্পতির বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটে। জো একা মা হিসেবে সন্তানকে বড় করে তোলেন।
সন্তানের পড়াশোনা ও উন্নত চিকিৎসার জন্য মা জোউ এক সঙ্গে তিনটি চাকরি করতেন। এর মধ্যে ছিল হুয়ান কলেজে ফুল টাইম চাকরি। এর পাশাপাশি প্রটোকল ট্রেনার ও ইনস্যুরেন্স এজেন্টের পার্ট টাইম চাকরি করতেন তিনি। ছেলের জন্য মা এমন কোনো কাজ নেই যা তিনি করেননি। একাই সব বাধা–বিপত্তিকে মোকাবিলা করেছেন। একাই ছেলেকে তিনি রিহ্যাবিলিটেশন বা পুনর্বাসন কেন্দ্রে নিয়ে যেতেন। আবহাওয়া যত দুর্যোগময় হোক না কেন, ছেলেকে নিয়ে তিনি যাবেনই যাবেন। নিজেও তিনি ‘ম্যাসাজ’–এর প্রাথমিক নিয়মকানুন শিখে নেন। ছেলের শরীরের যে অংশে কোনো কার্যক্ষমতা ছিল না, সেখানে বাড়িতে ‘ম্যাসাজ’ করতেন তিনি। তারপর অবসরে সময় পেলে নানা ধরনের ‘পাজল’ খেলতেন ছেলের সঙ্গে। বুদ্ধিমত্তা বৃদ্ধি পায় এমন গেমগুলি খেলতেন ছেলের সঙ্গে।
ডিং চপস্টিক দিয়ে খাবার খেতে পারত না। তখন জোউয়ের আত্মীয়েরা বলল, দরকার নেই ওর চপস্টিক ব্যবহার করার। কিন্তু জোউ তাদের কথা না শুনে ধৈর্যের সঙ্গে ছেলেকে চপস্টিক দিয়ে খেতে শেখাল। এই নিয়ে জোউ বলেছে, ‘আমি কখনো চাইনি শারীরিক সীমাবদ্ধতার কারণে আমার ছেলে লজ্জিত হোক। এমনিতে সে অনেক ক্ষেত্রে অন্যদের চেয়ে পিছিয়ে আছে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে ছেলের প্রতি আমি কঠোর হয়েছি। যদিও তার পক্ষে চপস্টিক ধরা সহজ ছিল না। কিন্তু যেখানে তার সমস্যা আছে, আমি সেখানে সাহায্য করেছি।’
মায়ের সেই ত্যাগ ও পরিশ্রম বৃথা যাইনি। ডিং এখন বড় হয়েছেন। পড়াশোনায় ভালো করছেন। পিকিং বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘এনভায়রনমেন্টাল সায়েন্স ও ইঞ্জিনিয়ারিং স্কুল’ থেকে ২০১১ খ্রিষ্টাব্দে তিনি ব্যাচেলর ডিগ্রি শেষ করেছেন। এখন তিনি বিশ্বখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয় হার্ভার্ডের আইন বিভাগের ছাত্র। এখন সবাই ডিংয়ের মায়ের প্রশংসায় মুখর। কারণ তিনি সন্তানকে জন্মের সময় ত্যাগ করেননি। ডাক্তারদের বলেননি সন্তানকে মেরে ফেলতে।