সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে কর্মরত সহকারী শিক্ষক থেকে সিনিয়র শিক্ষক পদে পদোন্নতিতে ‘ভজঘট’ লেগে গেছে। প্রয়োজনীয় যোগ্যতা না থাকলেও কিছু শিক্ষককে পদোন্নতির তালিকায় রাখা হয়েছে। এছাড়া পদোন্নতির ক্ষেত্রে কিছু শর্তকে আমলেই নেয়া হচ্ছে না। পদোন্নতি ইস্যুতে শিক্ষা প্রশাসনে এ পর্যন্ত প্রায় ৫০ লাখ টাকার ঘুষ লেনদেন হয়েছে জানিয়ে দুদকে অভিযোগ জমা পড়েছে। সব মিলিয়ে যোগ্য শিক্ষকরা পদোন্নতি বঞ্চিত হতে পারেন বলে আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্টরা। বুধবার (১৭ ফেব্রুয়ারি) ভোরের কাগজ পত্রিকায় প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানা যায়। প্রতিবেদনটি লিখেছেন অভিজিৎ ভট্টাচার্য্য।
প্রতিবেদনে আরও জানা যায় ভুক্তভোগী শিক্ষকরা বলেছেন, মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের (মাউশি) খামখেয়ালির কারণে পদোন্নতির জন্য ত্রুটিপূর্ণ তালিকা হয়েছে। এই তালিকা করতে গিয়ে কিছু শিক্ষক নেতা ও মাউশির কয়েকজন কর্মকর্তা আর্থিকভাবে লাভবান হয়েছেন। এসব কারণ দেখিয়ে শিক্ষকদের একটি অংশ শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের সচিবের কাছে অভিযোগ দিয়েছেন।
সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এবার সরকারি মাধ্যমিকে সাড়ে ৫ হাজার শিক্ষক পদোন্নতি পাবেন। কিন্তু নিয়মনীতিকে উপেক্ষা করে এরই মধ্যে পদোন্নতি দিতে মাউশি ৭ হাজার ২৭৮ জনের তালিকা করেছে। শিক্ষকরা বলছেন, বেশি তালিকা করায় যোগ্যরা বাদ পড়ে যেতে পারেন। এছাড়া নীতিমালা ঠিকভাবে অনুসরণ না করায় পদোন্নতিতে জটিলতা তৈরি হয়েছে। এতে শর্ত পালনকারী সাধারণ শিক্ষকরা ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন বলে অভিযোগ রয়েছে।
জানতে চাইলে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের (মাউশি) অতিরিক্ত সচিব (সরকারি মাধ্যমিক) মো. নাজমুল হক খান বলেন, পদোন্নতির কাজ এখনো শেষ না হওয়ায় এ নিয়ে কথা বলার সময় আসেনি। পদোন্নতির সব শর্তই পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে মেনে চলা হবে।
মাউশির মহাপরিচালক প্রফেসর ড. সৈয়দ গোলাম ফারুক বলেন, নীতিমালা লঙ্ঘন করে আগেও শিক্ষকদের পদোন্নতি হয়েছে। নতুন করে যাতে এমনটি আর না ঘটে সে বিষয়ে কাজ চলছে। এটুকু বলতে পারি, আমাদের কারণে কোনো শিক্ষক তার প্রাপ্য থেকে বঞ্চিত হবেন না। পদোন্নতি সংক্রান্ত বিষয়ে আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করা হয়েছে।
বিভিন্ন নথি ঘেঁটে দেখা গেছে, বিধি অনুযায়ী সরকারি সহকারী শিক্ষক নিয়োগের অন্যতম শর্ত হলো নিয়োগ লাভের পাঁচ বছরের মধ্যে বিএড ডিগ্রি অর্জন করতে হবে। অনেকে ব্যক্তিগত কারণে এই শর্তটি ঠিক সময়ে অর্জন করতে পারেননি। আইনে আছে, যারা এই শর্ত পালন করবেন না, তারা কোনো সুবিধাও পাবেন না। কিন্তু পদোন্নতির তালিকায় এই শর্ত পালন না করা শিক্ষকরাও ঢুকে গেছেন। এর ফলেই বর্তমান পদোন্নতিতে জটিলতা তৈরি হয়েছে। সহকারী শিক্ষক নিয়োগ বিধিমালা-১৯৯১ ও কর্মচারী ও কর্মকর্তা (সহকারী শিক্ষক) নিয়োগ বিধিমালা ২০১৮ (সংশোধিত ১৯৯১) এর অধীন নিয়োগ বিজ্ঞপ্তিগুলোতে সহকারী শিক্ষক নিয়োগ লাভের পাঁচ বছরের মধ্যে বিএড ডিগ্রি অর্জন করার শর্ত রয়েছে। কিন্তু এখানে তা বেমালুম চেপে যাওয়া হচ্ছে। প্রায় দেড় হাজার শিক্ষক এই শর্ত পালন করেননি বলে অভিযোগ রয়েছে।
শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব নাজমুল হক খানের সভাপতিত্বে গত ১০ ফেব্রুয়ারি পাঁচ সদস্যের পদোন্নতি কমিটির বৈঠক হয়। ওই বৈঠকে আলোচনাগুলো নিষ্পত্তি হয়নি। শিক্ষক নেতারা বলেছেন, পদোন্নতি পেতে হলে নিয়োগ বিধির শর্ত পূরণ করতে হবে। অর্থাৎ সহকারী শিক্ষক হিসেবে নিয়োগের পাঁচ বছরের মধ্যে বিএড ডিগ্রি অর্জনের শর্ত পালনকে পদোন্নতির মাপকাঠি নির্ধারণ করতে হবে। এই শর্তকে কেন্দ্র করেই পদোন্নতিতে ভজঘট লেগেছে বলে জানা গেছে। কারণ মাউশির একটি অংশ এই শর্ত মানতে রাজি নয়। তারা যোগদানের তারিখ থেকে পদোন্নতির হিসাব করতে চায়।
এ বিষয়ে ভোলার তজমুদ্দিন সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ও শিক্ষক নেতা মো. মোফাজ্জল হোসেনবলেন, মাউশির উপপরিচালক মো. আজিজ উদ্দিন ও রাজধানী ঢাকার গভ. ল্যাবরেটরি হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক আবু সাঈদ ভ‚ঁইয়া ও আরো কয়েকজন শিক্ষক শর্ত অমান্যকারীদের পদোন্নতি করিয়ে দেয়ার নামে ঘুষ নিয়েছেন। এসব অভিযোগ উল্লেখ করে ময়মনসিংহের গফরগাঁওয়ের খায়রুল্লাহ সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষক মাহমুদুর রহমান দুদকে অভিযোগ করেছেন।
শিক্ষক মাহমুদুর রহমান বলেন, যারা পদোন্নতিযোগ্য নয়, তারাও যাতে পদোন্নতি পেতে পারে সেজন্য ঘুষ লেনদেন হয়েছে। সবমিলিয়ে প্রায় ৫০ লাখ টাকার ঘুষ লেনদেন হয়েছে বলে তিনি জানিয়েছেন। ঘুষ লেনদেনের প্রমাণ সম্পর্কে তিনি বলেন, যারা দিয়েছেন তারা এসে আমাদের কাছে বলেছেন। এর চেয়ে বড় প্রমাণের আর দরকার নেই।
ঘুষ নেয়ার কথা অস্বীকার করে সরকারি মাধ্যমিক শিক্ষক সমিতির সভাপতি ও গভ. ল্যাবরেটরি হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক আবু সাঈদ ভূঁইয়া বলেন, আমরা কোনো টাকা নেইনি, বরং শিক্ষকদের পদোন্নতির জন্য মাউশি মহাপরিচালকের অনুরোধে গ্রেডেশন তালিকা করতে গঠিত কমিটিতে আমি ছিলাম। তারমতে, শর্ত মোতাবেক নিয়োগের ৫ বছরের মধ্যে বিএড ডিগ্রি নেয়ার বিধান ছিল। এই বিধান মানতে গেলে বহু শিক্ষকের পদোন্নতি হবে না। এজন্য এই শর্তকে শিথিল করে যোগ দানের তারিখ থেকে গ্রেডেশন তালিকা করার কথা বলেছি। কিন্তু শিক্ষকরা আপনাদের দেয়া ‘থিওরি’ মানছেন না- এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, তাহলে শিক্ষকদের পদোন্নতি দেয়া কষ্ট হবে। মাউশির উপপরিচালক মো. আজিজ উদ্দিনের কয়েক দফা যোগাযোগ করেও কথা বলা সম্ভব হয়নি। তিনিও শিক্ষকদের কাছে অভিযুক্ত।