প্রাথমিকের শিক্ষক-কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের মধ্যে হতাশা ও অসন্তোষ দীর্ঘদিনের। বেতন বৈষম্য ও পদোন্নতি জটিলতাসহ আছে নানা কারণ। সরকার বিভিন্ন সময়ে শিক্ষকদের বেতন ও পদমর্যাদা বাড়ালেও তা প্রায় সবই বিচ্ছিন্ন পদক্ষেপ। সহকারী শিক্ষক থেকে মহাপরিচালক পর্যন্ত কোনো ‘পেশাগত সিঁড়ি’ (ক্যারিয়ার ল্যাডার) নেই। যোগদানের পর একই পদে চাকরি করে বেশিরভাগকে অবসরে যেতে হয়। ৩৬ বছরের বিধিমালায় চলছে এ খাত। অবশ্য সম্প্রতি এ বিধিমালা সংশোধনের প্রস্তাব করা হয়েছে। কিন্তু তাতে শিক্ষা ক্যাডারের পদে দেখানো হয়েছে প্রশাসনের হিসাবে। এ খাতের শিক্ষার উন্নয়নে পেশাদার জনগোষ্ঠী সৃষ্টির লক্ষ্যে নিজস্ব ক্যাডার সার্ভিস গঠনের দাবি দীর্ঘদিনের। এ নিয়ে ২০০৩ থেকে ২০০৯ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত কাজও হয়েছে। কিন্তু সেই ক্যাডার আজও হয়নি।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দেশে ১৫ লাখ সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীর মধ্যে ৪ লাখ ৭৭ হাজার ১২৫ জনই প্রাথমিক শিক্ষা খাতের। জনবলের বিচারে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা সবচেয়ে বড় মন্ত্রণালয়। অথচ এ মন্ত্রণালয়ের নিজস্ব কোনো ক্যাডার সার্ভিস নেই। মন্ত্রণালয়টির অধিদপ্তরগুলোর ঊর্ধ্বতন পদে আসীন অন্য ক্যাডারের কর্মকর্তারা। সরকারি চাকরি বিধি অনুযায়ী তারা সবাই প্রেষণে কর্মরত থাকায় মূল বেতনের সঙ্গে আরও ২০ ভাগ ভাতা নিচ্ছেন।
এ প্রসঙ্গে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের (ডিপিই) মহাপরিচালক আলমগীর মুহাম্মদ মনসুরুল আলম বলেন, প্রাথমিক শিক্ষার উন্নয়নে সর্বোচ্চ চেষ্টা করে যাচ্ছি। বিধিমালা তৈরির কাজ প্রায় শেষ পর্যায়ে। সরকারি কর্মকমিশনে (পিএসসি) বর্তমানে সেটি মতামতের অপেক্ষায় আছে। আর প্রাথমিক শিক্ষা ক্যাডার সৃষ্টি সংক্রান্ত বিষয়টি সরকারের সিদ্ধান্তের ব্যাপার। এটি অধিদপ্তরের কাজ নয়।
এদিকে পিএসসিতে একটি প্রাইমারি টিচার্স ট্রেনিং ইনস্টিটিউটের (পিটিআই) এক ইন্সট্রাক্টর অভিযোগপত্রে দাবি করেছেন, সহকারী উপজেলা বা থানা শিক্ষা কর্মকর্তা পদে নিয়োগ সংক্রান্ত ইস্যুতে একটি মামলার রায় জাল করা হয়েছে। প্রস্তাবিত বিধিমালার তফশিলে হাইকোর্টের রায়ের ভুল ব্যাখ্যা করে উপজেলা শিক্ষা অফিসারের ৮০ পদে সহকারী উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তাদের পদোন্নতির বিধান রাখা হয়েছে। প্রকৃতপক্ষে হাইকোর্টের রিটের রায়ে এ রকম কোনো আদেশ হয়নি। দৈনিক আমাদের বার্তার হাতে এ সংক্রান্ত দুটি রায়ের কপি এসেছে। যার একটিতে উল্লিখিত আদেশ (৮০ শতাংশ পদ পদোন্নতি) আছে, আরেকটিতে নেই। তবে কোনটি আসল রায় নিশ্চিত হওয়া সম্ভব হয়নি। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, রায় জালে জড়িতদের বিচার হওয়া উচিত।
জানা গেছে, এ অভিযোগ প্রাথমিক শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও ডিপিইতেও দিয়েছিলেন সংশ্লিষ্টরা। কিন্তু চাপের মুখে তা লিখিতভাবে তুলে নিতে বাধ্য হন।
এ প্রসঙ্গে পিএসসির চেয়ারম্যান সোহরাব হোসাইন জানান, সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়সহ একাধিক মন্ত্রণালয় ও সর্বোচ্চ পর্যায়ের কমিটির মাধ্যমে অনুমোদনের পর মতামতের জন্য কোনো আইন বা বিধি পিএসসিতে আসে। এ কারণে তারা সেটির মৌলিক পরিবর্তনের দিকে নজর দেন না। তারা কেবল সংবিধান আর প্রচলিত আইনবিধিপরিপন্থি কিছু আছে কিনা তা দেখেন। বিধিগত কোনো পরিবর্তন-পরিবর্ধন করতে হলে বা মামলার কোনো জালিয়াতির বিষয় থাকলে সেটি সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় দেখতে পারে। ডিপিইর বিধিমালাটি বর্তমানে একটি কমিটি নিরীক্ষা করছে।
ডিপিই মহাপরিচালক এ ব্যাপারে বলেন, যদি হাইকোর্টের রায় জালিয়াতি হয়ে থাকে তবে সেটা শাস্তিযোগ্য অপরাধ। অভিযোগ ও রায় দুটি পেলে তদন্ত করে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
জানা গেছে, প্রস্তাবিত বিধিমালা সম্পর্কে প্রাথমিক শিক্ষা সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা, শিক্ষক ও কর্মচারীদের সংগঠনগুলো পৃথক মতামত দিয়েছে। সেগুলো সমন্বয় করে গত বছরের জানুয়ারিতে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে হালনাগাদ বিধিমালা পাঠানো হয়। এদিকে প্রাথমিক শিক্ষা ক্যাডার করার ব্যাপারে দাতা সংস্থাগুলোরও চাপ আছে। দ্বিতীয় প্রাথমিক শিক্ষা উন্নয়ন কর্মসূচিতে (পিইডিপি-২) এ ব্যাপারে একটি কম্পোনেন্ট ছিল। কথা ছিল ক্যাডার করার পর তারাই প্রাথমিক শিক্ষার উন্নয়নে কাজ করবে। ওই কর্মসূচি শেষ হয়। পরের কর্মসূচিতে (পিইডিপি-৩) ‘ক্যাডার’ হয়ে যায় ‘ক্যারিয়ার পাথ’। কিন্তু সেটিও হয়নি। বর্তমানে চলছে পিইডিপি-৪। এতে ক্যারিয়ার পাথ রূপান্তর লাভ করে ‘ওডিসিসিজি’ (অর্গানাইজেশনাল ডেভেলপমেন্ট অ্যান্ড ক্যাপাসিটি বিল্ডিং গাইডলাইন) হিসেবে। ইতোমধ্যে এ কর্মসূচির চার বছর হতে চলল। এক বছর পর কর্মসূচি শেষ হয়ে যাবে। অন্যদিকে এ ‘ওডিসিসিজি’র রূপরেখা ২০০৩ সালেই একজন বিদেশি পরামর্শক করে দিয়েছেন। এখন তা কেবল বাস্তবায়নে গেলেই হয়। কিন্তু তাও হয়নি। প্রাথমিক শিক্ষা ক্যাডার করার দাবিতে দীর্ঘদিন আন্দোলন করে আসছে প্রাথমিক শিক্ষা সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশন।