কক্সবাজারের উখিয়ার বালুখালী রোহিঙ্গা ক্যাম্পের 'দারুল উলুম নাদুওয়াতুল উলামা আল-ইসলামিয়া' মাদ্রাসায় ঘুমাচ্ছিলেন ছাত্র-শিক্ষকসহ অন্তত ৩০ জন। রাত তখন ৩টা। হঠাৎ করে শতাধিক রোহিঙ্গা সন্ত্রাসী মাদ্রাসাটি ঘিরে ফেলে। তাদের প্রত্যেকের হাতে অস্ত্রশস্ত্র। সন্ত্রাসীদের কেউ বাইরে পাহারায়, কেউ বেড়ার দরজা ভেঙে প্রবেশ করে মাদ্রাসার ভেতরে। এরপর শুরু হয় নারকীয় তাণ্ডব। ঘুমন্ত শিক্ষার্থী ও শিক্ষকদের এলোপাতাড়ি কোপাতে থাকে সন্ত্রাসীরা। কেউ পালানোর চেষ্টা করলেই গুলি চালায় তারা। দেড় ঘণ্টা ধরে চলে এই নারকীয় তাণ্ডব। এতে সাতজন নিহত এবং অন্তত ১২ জন গুরুতর আহত হয়েছেন।
আক্রান্ত হতভাগ্য লোকগুলোর চিৎকারে আশপাশের অনেকে এগিয়ে এসেছিলেন। তবে সন্ত্রাসীদের কাছে তারা ছিলেন অসহায়। চোখের সামনে নির্মম এই হত্যাযজ্ঞ প্রত্যক্ষ করা ছাড়া তাদের কিছুই করার ছিল না। সন্ত্রাসীরা চলে গেলে হতাহতদের উদ্ধার করে নিয়ে যায় হাসপাতালে। ১৮ নম্বর ক্যাম্পের এইচ-৫২ নম্বর ব্লকে বৃহস্পতিবার ঘটেছে এ মর্মান্তিক ঘটনা। আলোচিত রোহিঙ্গা নেতা মুহিবুল্লাহর খুনের তিন সপ্তাহ পরই আবার রক্ত ঝরল ক্যাম্পে। গত ২৯ সেপ্টেম্বর রাতে উখিয়ার লাম্বাশিয়া শিবিরের ডি ব্লকের 'আরাকান রোহিঙ্গা সোসাইটি ফর পিস অ্যান্ড হিউম্যান রাইটস' (এআরএসপিএইচ) সংগঠনের কার্যালয়ে বন্দুকধারীদের গুলিতে নিহত হন মুহিবুল্লাহ। তিনি ওই সংগঠনের চেয়ারম্যান ছিলেন। হামলার জন্য মিয়ানমারের সশস্ত্র গ্রুপ 'আরাকান স্যালভেশন আর্মি' আরসা (আল-ইয়াকিন নামেও পরিচিত) দায়ী করা হয়েছিল।
তবে আরসা হত্যার দায় অস্বীকার করে।
প্রত্যক্ষদর্শীরা বলেছেন, নিরাপদ স্থানে পালিয়ে এসেও বাঁচতে পারছে না রোহিঙ্গারা। নির্বিচারে হত্যার শিকার হতে হচ্ছে স্বজাতির হাতে। তারা জানিয়েছেন, হামলাকারীদের সবাই রোহিঙ্গা ক্যাম্পের চিহ্নিত সন্ত্রাসী। মিয়ানমারের সন্ত্রাসী বাহিনী 'আলেখিন' নামে তারা ক্যাম্পে এই হত্যাযজ্ঞ শুরু করেছে। ক্যাম্পের নিয়ন্ত্রণ নিতেই এই হত্যাকাণ্ড।
রোহিঙ্গা ক্যাম্পে নিরাপত্তার দায়িত্বে নিয়োজিত আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নের (এপিবিএন) অধিনায়ক পুলিশ সুপার শিহাব কায়সার জানান, রাত আনুমানিক ৩টার দিকে মাদ্রাসায় রোহিঙ্গা দুস্কৃতকারীরা হামলা চালায়। হামলায় ছাত্র-শিক্ষকদের মধ্যে চারজন রোহিঙ্গা মারা যায়। পরে হাসপাতালে নেওয়ার পর আরও তিনজনের মৃত্যু হয়েছে। গুরুতর আহত ১২ জনকে ক্যাম্পের বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে।
এপিবিএন সাতজন নিহতের কথা জানালেও কক্সবাজার জেলা পুলিশ ছয়জন নিহত হওয়ার কথা জানিয়েছে। উখিয়া থানার ওসি আহমেদ সঞ্জুর মোরশেদ জানান, ছয়জনের লাশ ময়নাতদন্তের জন্য কক্সবাজার সদরে মর্গে পাঠানো হয়েছে। গুরুতর আহত অবস্থায় আরও একজনকে পাঠানো হয়েছে কক্সবাজার সদর হাসপাতালে।
এপিবিএনের সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, নিহতরা হলেন- মাদ্রাসা শিক্ষক হাফেজ মো. ইদ্রীস (৩২), মুফতি হাবিবুল্লাহর ছেলে মাদ্রাসার শিক্ষার্থী ইব্রাহীম হোসেন (২৪), নুরুল ইসলামের ছেলে মাদ্রাসার ছাত্র আজিজুল হক (২২), একই ক্যাম্পের ভলান্টিয়ার আবুল হোসেনের ছেলে মো. আমীন (৩২)। হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা গেছেন মোহাম্মদ নবীর ছেলে মাদ্রাসা শিক্ষক নুর আলম ওরফে হালিম (৪৫), রহিম উল্লাহর ছেলে মাদ্রাসা শিক্ষক হামিদুল্লাহ (৫৫) ও নুর মোহাম্মদের ছেলে মাদ্রাসার ছাত্র নুর কায়সার (১৫)।
গতকাল শুক্রবার সকালে সরেজমিনে দেখা যায়, মাদ্রাসাটি ঘিরে রেখেছেন এপিবিএনের সদস্যরা। মাদ্রাসার বাইরে সড়কে সেনাবাহিনীর পাশাপাশি আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সদস্যদের মোতায়েন করা হয়েছে। নিহতদের পরিবারগুলোয় চলছে শোকের মাতম। মাদ্রাসার মেঝেতে রক্ত ছড়িয়ে আছে। নিহতদের স্বজনরা সেখানে বিলাপ করছেন।
ক্যাম্পের লোকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, আলেখিন বা আল-ইয়াকিন নামের রোহিঙ্গাদের একটি সন্ত্রাসী বাহিনী পুরো ক্যাম্পে আধিপত্য বিস্তার করতে চায়। দারুল উলুম নাদুওয়াতুল উলামা আল-ইসলামিয়া মাদ্রাসার শিক্ষকরা রোহিঙ্গাদের অন্য একটি সংগঠনের নিয়ন্ত্রণে ছিল বলে এই হামলা হয়েছে। এর আগে তারা হুমকি-ধমকি দিয়ে আসছিল বলে অনেকে জানিয়েছেন।
বালুখালী-১৮ ক্যাম্পের মাঝি (রোহিঙ্গা নেতা) মো. ইউনুছ বলেন, 'এমন নৃশংসতা আর দেখিনি। যাদের হত্যা করা হয়েছে তাদের কারও হাত নেই, কারও পা নেই। কারও মাথা বিচ্ছিন্ন। কারও শরীরে গুলির ক্ষত রয়েছে।' তিনি বলেন, হত্যাকাণ্ডে ক্যাম্পের সন্ত্রাসী মো. আজিজ ওরফে অলি, জাবের, হাসিম, খালেক ওরফে হোসেন, আবদুল মালেক, মৌলভী আকিজ, ফজল কবির ওরফে আবু আনাস অংশ নিয়েছে। তারা আলেখিনের নামে ক্যাম্পে ভয়াবহ পরিস্থিতি তৈরি করেছে। তারা এর আগেও এই মাদ্রাসার সংশ্নিষ্টদের হুমকি দিয়েছে। তিনি বলেন, রাতে হয়তো আবার হামলা চালাতে পারে তারা।
নিহত আজিজুল হকের মা সাজেদা বেগম বলেন, 'আমার পুত্রকে সন্ত্রাসী আলেখিন বাহিনী হত্যা করেছে। আমার ছেলে নিরীহ ছিল। সন্ত্রাসী বাহিনীতে যোগ দেয়নি বলে তাকে কুপিয়ে হত্যা করা হয়েছে।'
নিহত নুর আলম ওরফে হালিমের স্ত্রী উম্মে হাবিবা জানান, তার স্বামী মাদ্রাসার শিক্ষক ছিলেন এবং ইমামতি করতেন। ঘটনার রাতে তিনি মাদ্রাসায় ছিলেন। সন্ত্রাসীরা তাকে মাদ্রাসায় ঢুকে ঘুমন্ত অবস্থায় হত্যা করেছে। সন্ত্রাসীরা আগেও একাধিকবার তার স্বামীকে হুমকি দিয়েছিল।
উম্মে হাবিবা বলেন, তার স্বামী মসজিদের ইমাম ছিলেন বলে সবাই তাকে সম্মান করতেন। এমন একজন নিরীহ লোককে কেন হত্যা করা হলো, বুঝতে পারছেন না। ৯ সন্তান নিয়ে এখন কোথায় যাব বলে কান্নায় ভেঙে পড়েন তিনি।
বালুখালী ১৮ নম্বর ক্যাম্পের 'এইচ' ব্লকের মাঝি মো. ইউসুফ বলেন, আমরা মিয়ানমারে সেনাদের হাতে মার খেয়ে আশ্রয়ের জন্য এ দেশে পালিয়ে এসেছিলাম। এখন এখানে এসেও রোহিঙ্গাদের হাতেই মার খেতে হচ্ছে। তিনি বলেন, সন্ধ্যার পর ক্যাম্পে এক বিভীষিকাময় পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। আজ সন্ধ্যার পর কী ঘটবে তাও আমরা জানি না। আমরা চরম নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছি। এখানে বিশেষ করে রাতে নিরাপত্তা ব্যবস্থা আরও জোরদার করা দরকার।
প্রত্যক্ষদর্শী মো. আমিন বলেন, মাদ্রাসায় প্রতি রাতে ২০ জন শিক্ষক ও তিন শতাধিক শিক্ষার্থী অবস্থান করেন। শুক্রবার মাদ্রাসা বন্ধ থাকে বলে বৃহস্পতিবার বিকেলে বেশিরভাগ শিক্ষার্থী তাদের বাড়ি ঘরে চলে যায়।
গতকাল সকালে ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন কক্সবাজারের জেলা প্রশাসক মো. মামুনুর রশীদ, অতিরিক্ত শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার সামছু দৌজা নয়ন, ১৬ এপিবিএনের অধিনায়ক নাঈমুল হক।
জেলা প্রশাসক বলেন, অপরাধীদের চিহ্নিত করে দ্রুত আইনের আওতায় আনা হবে। ভবিষ্যতে যাতে এ ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি না ঘটে সেজন্য ক্যাম্প প্রশাসন আরও কঠোর অবস্থানে থাকবে। তিনি বলেন, এ ঘটনায় কারা জড়িত তা তদন্তের পর বিস্তারিত জানা যাবে। অনুমান করে কিছু বলতে চাচ্ছি না।
সামছু দৌজা নয়ন বলেন, ক্যাম্পে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অতিরিক্ত সদস্য মোতায়েন করা হয়েছে। পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে তারা কাজ করছেন।
কক্সবাজারের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার রফিকুল ইসলাম জানান, ঘটনা জানতে পেরে সদস্যরা তাৎক্ষণিকভাবে ঘটনাস্থলে গিয়ে আহতদের উদ্ধার করে চিকিৎসার জন্য হাসপাতালে প্রেরণ করে। এ সময় পুলিশ হামলাকারীদের একজনকে একটি দেশীয় ওয়ান শুটার গান, ৬ রাউন্ড গুলি ও একটি ছুরিসহ হাতেনাতে গ্রেপ্তার করতে সক্ষম হয়েছে। হামলায় জড়িত সন্দেহে গ্রেপ্তার ব্যক্তির নাম মুজিবুর রহমান। তিনি বলেন, পুলিশ মাদ্রাসা ও আশপাশের এলাকায় ব্লক রেইড পরিচালনা করছে। ক্যাম্পের অন্যান্য এলাকায়ও ব্লক রেইড পরিচালনা করা হচ্ছে।
এদিকে গতকাল পুলিশ ক্যাম্পের সদস্যরা বিশেষ অভিযান চালিয়ে রোহিঙ্গা ক্যাম্পের চিহ্নিত ৪ সন্ত্রাসীকে অস্ত্রসহ আটক করেছে। তারা হচ্ছেন ১১নং বালুখালী ক্যাম্পের মৌলভী নুর হোসেন ওরফে মৌলভী মাজেদ (৪২), মো. গণি ওরফে ইউনুস ওরফে আব্দুল্লাহ (৩৫), ১২নং ক্যাম্পের মৌলভী করিমুল্লাহ (২৮) ও ৮নং ক্যাম্পের মৌলভী নুরুল বশর (৩০)।
কক্সবাজারের রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোতে এর আগেও বিভিন্ন সময়ে গোলাগুলি ও সংঘর্ষ হয়েছে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে সেগুলোকে 'রোহিঙ্গা ডাকাত' বা 'চোরাকারবারিদের' কাজ বলা হয়েছে পুলিশের পক্ষ থেকে। তবে রোহিঙ্গা নেতা মুহিবুল্লাহ খুন হওয়ার পর সন্ত্রাসী গ্রুপগুলোর বিষয় এখন আন্তর্জাতিক পর্যায়েও আলোচনায় আসছে।