গত বছর একটি বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেলে একটি টকশোতে দেখলাম, ঢাকার বাইরের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর সেই বিশ্ববিদ্যালয়ের র্যাগিং বিষয়ে কথা বলতে গিয়ে বললেন, ‘কালকেও এই বিশ্ববিদ্যালয়ে র্যাগ হয়েছে।’ সঞ্চালক জানতে চাইলেন, কয়জন র্যাগিংয়ের শিকার হয়েছেন এবং কারা র্যাগ দিয়েছিলেন? এর উত্তরে প্রক্টর বললেন, ‘সবাই তো তাতে ছিল। একটা ব্যাচের সবাই, মানে কালকে এই দিনই ছিল।’ এতক্ষণ বুঝতে পারা গেল বিষয়টি কী? আসলে সেদিন একটা ব্যাচের র্যাগ ডে ছিল। আজ বৃহস্পতিবার (৩ সেপ্টেম্বর) প্রকাশিত প্রথম আলো পত্রিকায় এই মতামতটি প্রকাশিত হয়। মতামতটি লেখেন জোবাইদা নাসরীন।
সে ঘটনা আবার মনে পড়ল বুধবার রাতে একটা সংবাদ দেখে। সব পত্রিকায় তা গুরুত্বসহকারেই ছেপেছে। সংবাদটি হলো, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে শিক্ষার্থীদের ‘র্যাগ ডে’ উদযাপন নিষিদ্ধের সিদ্ধান্ত নিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়ের ২ সেপ্টেম্বর অনুষ্ঠিত একাডেমিক কাউন্সিল। এর কারণ সম্পর্কে বলা হয়, এটি অমানবিক, নিষ্ঠুর ও নীতিবহির্ভূত উৎসব।
অনেকের মতো আমিও অবাক হয়েছি এ সংবাদ দেখে। কারণ, প্রকাশিত রিপোর্টেই দেখেছি, এ সভায় তিন শর মতো শিক্ষক উপস্থিত ছিলেন। তার মানে হলো, র্যাগিং ও র্যাগ ডে পালনকে এই ৩০০ শিক্ষক একই মনে করছেন এবং এ কথা বলার আর অপেক্ষা রাখে না যে তাঁদের কাছে নিপীড়ন করার পদ্ধতি হিসেবে র্যাগিং এবং শিক্ষার্থীদের শিক্ষা সমাপনী দিবস পালনের উৎসবকে একই মনে হয়েছে।
তবে বাংলাদেশের প্রায় সব পাবলিক ও বেশির ভাগ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে র্যাগিং ও র্যাগ ডে পালনের চল দুটোই আছে। তবে দুটোকে কোনোভাবে এক করা যাবে না। কোনো ব্যাচের শিক্ষা সমাপ্ত হওয়ার পর র্যাগ ডে পালনের রীতি বা উৎসব দেশ ও দেশের বাইরে অনেক বিশ্ববিদ্যালয়েই আছে। পালনের ধরনের পার্থক্য থাকতে পারে। বছরের একটি নির্দিষ্ট দিনে ব্যাচের সবাই অথবা বিভাগের সবাই মিলে উৎসবের মধ্য দিয়ে মজা করেন। তবে আমাদের দেশের চর্চা অনুযায়ী, সাধারণত এটি অনার্স অথবা মাস্টার্স শেষে হয়ে থাকে। এটিকে অনেকে শিক্ষা সমাপনী উৎসবও বলেন।
আমাদের সময় পর্যন্ত এই র্যাগ ডে নামের এ উৎসব ছিল বেশ আনন্দের এবং পাশাপাশি মন খারাপের। অনেক বন্ধুর সঙ্গে আর দেখা হবে না বলে দিনটিকে স্মরণীয় করে রাখতে বাদক দল নিয়ে র্যালি, ছবি তোলা, ঘোরাঘুরিসহ অনেক মজা করা হতো। উৎসব শেষে সন্ধ্যায় বিদায়ী শিক্ষার্থীদের জন্য উপাচার্যের পক্ষ থেকে একটি ডিনারের আয়োজন করা হতো। ডিনারের শুরুতে উপাচার্য শিক্ষার্থীদের উদ্দেশে তাঁদের ভবিষ্যতের দিকনির্দেশনা দিতেন।
বর্তমানেও বিশ্ববিদ্যালয়জীবনের শেষ দিন বা শিক্ষা সমাপনীকে শিক্ষার্থীরা স্মরণীয় করে রাখে র্যাগ ডের মাধ্যমে। তবে সেটি পালনে পরিবর্তন এসেছে। সব বিভাগের পরীক্ষা একই সঙ্গে শেষ হয় না বলে এখন র্যাগ ডে পালন হয় বিভাগ অনুযায়ী। এই পালনে এখন প্রাধান্য পাচ্ছে বন্ধুদের সঙ্গে রঙের ছোড়াছুড়ি, টি-শার্টে বিভিন্ন লেখা আর দিন শেষে একটা কনসার্টের আয়োজনের মাধ্যমে।
সব বিভাগের একসঙ্গে হয় না বলে কারও কারও র্যাগ ডে চলাকালে শব্দে অন্য বিভাগের শিক্ষার্থী ও শিক্ষকদের সমস্যা হতে পারে, বিরক্ত হতে পারেন। তাই বড় জানতে ইচ্ছা করে, কীভাবে এ উৎসব বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক কাউন্সিলের ৩০০ জন শিক্ষকের কাছে একটি অমানবিক নিষ্ঠুর ও নীতিবহির্ভূত উৎসব হিসেবে মনে হলো?
অন্যদিকে র্যাগিং মানে হলো নতুন আসা শিক্ষার্থীদের আদবকায়দা শেখানোর নামে নিপীড়ন করা। সেই নিপীড়ন অনেক ক্ষেত্রে শিক্ষার্থীদের আত্মহত্যা করতে কিংবা বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়তে বাধ্য করেছে। বিশেষ করে বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলোর গেস্টরুমে এই র্যাগিং–চর্চার মাত্রা ভয়াবহ।
ক্যামব্রিজ অভিধানে র্যাগ শব্দটার মানে একাধিক। সেখানে এক টুকরা পুরোনো কাপড়, নিম্নমানের সংবাদপত্র থেকে শুরু করে কাউকে মজার কিন্তু নিষ্ঠুর কিছু বলা কিংবা ছাত্রছাত্রী কর্তৃক আয়োজিত বার্ষিক আনন্দ অনুষ্ঠানকে বোঝানো হয়েছে। অর্থাৎ অর্থের ব্যবহারে ভিন্নতা রয়েছে। যে কারণে কোনোভাবেই একই শব্দ সব সময় একই অর্থ বহন করে না। তাই র্যাগিং ও র্যাগ ডে পালন কোনোভাবেই এক হয়ে ওঠে না। এই পার্থক্যগুলো বিশ্ববিদ্যালয়ের এতজন শিক্ষকের কাছে স্পষ্ট ছিল না, এই ভেবেই বিস্ময় জাগছে।
তাহলে কি আমরা ধরে নেব, র্যাগ ডে পালন বন্ধ করার মধ্য দিয়ে র্যাগিং বন্ধ হয়েছে বলে দাবি করবে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ? ওদিকে আসল র্যাগবাজসহ অন্যরা মুখ টিপে হাসছে...
পুনশ্চ: অবশেষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য মহোদয়ের আংশিক বোধোদয় হয়েছে। তিনি বলেন, ‘ক্যাম্পাসে র্যাগ ডে নিষিদ্ধ করা হয়নি। ভুল-বোঝাবুঝি ও অসাবধানতার কারণে বিশ্ববিদ্যালয়ের জনসংযোগ দপ্তর থেকে তথ্যটি ভুলভাবে গণমাধ্যমে গিয়েছিল৷...আসলে যেটি করা হয়েছে, তা হলো শিক্ষা সমাপনী অনুষ্ঠানকে কীভাবে আরও সুন্দর, নান্দনিক ও ভালো করা যায়, তার একটি নীতিমালা তৈরির জন্য আমরা একটি কমিটি করে দিয়েছি৷’
নিষিদ্ধ এখন নীতিমালায় এসে থামলেও, এর মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের উৎসবে কর্তৃপক্ষীয় নজরদারিরই আসলে ব্যবস্থা হলো।
লেখক: শিক্ষক, নৃবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যলয়।