শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবসে শ্রদ্ধাঞ্জলি - দৈনিকশিক্ষা

শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবসে শ্রদ্ধাঞ্জলি

আবদুল্লাহ আল মোহন |
১৪ ডিসেম্বর, শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস। দেশের শ্রেষ্ঠ সন্তানদের হারানোর দিন। বাঙালি জাতির ইতিহাসে সবচেয়ে বেদনাভারাক্রান্ত দিন। ১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দের  ডিসেম্বরে মুক্তিযুদ্ধের শেষ সময়ে বাঙালির বিজয় যখন সুনিশ্চিত তখন বাঙালি জাতিকে মেধাশূন্য করতে জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তানদের একের পর এক হত্যা করা হয়। শিক্ষক, সাহিত্যিক, চিকিৎসক, সাংবাদিকসহ বেছে বেছে জাতির মেধাবী সন্তানদের হত্যা করে বর্বর পাকিস্তানি বাহিনী ও তাদের এ দেশীয় দোসর আলবদর, রাজাকাররা।
 
দীর্ঘ ৯ মাসের সংগ্রামে মুক্তিযুদ্ধে চূড়ান্ত বিজয় তখন দ্বারপ্রান্তে। নিশ্চিত পরাজয় বুঝতে পেরে জাতিকে মেধাশূন্য করতে নিষ্ঠুর পরিকল্পনা সাজায় হানাদার বাহিনী। তারা স্বাধীনতাবিরোধীদের সহযোগিতায় একাত্তরের ১৪ ডিসেম্বর বহু গুণীজনকে ঘর থেকে ধরে নিয়ে নির্মমভাবে হত্যা করে। বুদ্ধিজীবীদের হত্যার ঠিক দুই দিন পর ১৬ ডিসেম্বর জেনারেল নিয়াজীর নেতৃত্বাধীন বর্বর পাক বাহিনী আত্মসমর্পণ করে এবং বিজয়ের মধ্য দিয়ে স্বাধীন দেশ হিসেবে বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটে। শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবসে জাতির মহান মানুষদের স্মৃতির প্রতি জানাই বিনম্র শ্রদ্ধাঞ্জলি।
 
২. শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবসের আলোচনায় শুরুতেই মনে নানা প্রশ্ন জাগে। Intellectual শব্দের বাংলা প্রতিশব্দ বুদ্ধিজীবী। বুদ্ধিজীবী বললে বোঝায় বুদ্ধি দিয়ে যারা জীবিকা নির্বাহ করেন। যেমন কৃষিজীবী কৃষি দিয়ে জীবিকা নির্বাহ করে। নিছক জীবিকা নির্বাহ করাই Intellectual-এর কাজ নয়। বুদ্ধিজীবী- ১. সমাজ ও সংস্কৃতি সচেতন এবং জ্ঞান-বিজ্ঞানে দক্ষ সুশিক্ষিত মানুষ, যারা বুদ্ধিমত্তার বলে জীবিকা নির্বাহ করেন। ২. জ্ঞান বা বুদ্ধিকৌশলে কাজ সম্পাদন করেন এমন। বুদ্ধিজীবীর প্রধান সম্পদ তাঁর বিবেক। বিবেকতাড়িত মানুষ অন্যায়ের প্রতিবাদ করেন। যদিও প্রতিবাদের ধরনে ভিন্নতা রয়েছে। 
 
৩. কোনো মৃত্যুর তাৎপর্য কিংবা মূল্য অন্য মৃত্যুর চেয়ে কোনো অংশে কম নয়। প্রতিটি জীবনই অমূল্য। বুদ্ধিজীবীরা কেন হানাদার বাহিনী ও তার এ দেশীয় দোসরদের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হলেন, তা বোঝার জন্য গভীর পাণ্ডিত্যের প্রয়োজন নেই। একাত্তরে ত্রিশ লাখ শহীদের মধ্যে বুদ্ধিজীবীদের বেছে বেছে হত্যার ঘটনা তাই বিশেষ তাৎপর্য বহন করে। বুদ্ধিবৃত্তিকভাবে নিঃস্ব করার দুরভিসন্ধি থেকে হানাদার বাহিনী তাদের পরাজয় আসন্ন জেনে বাঙালি জাতিকে মেধাশূন্য করতে বুদ্ধিজীবী নিধনের এই পরিকল্পনা করে। 
চরম বিপর্যয় আসন্ন, পরাজয় একেবারেই সন্নিকটে-তখনই তারা সেই পরিকল্পনা কার্যকর করে। তালিকাভুক্ত বুদ্ধিজীবীদের চোখ বেঁধে নিয়ে হত্যা করা হয়। 
 
৪. জাতির সূর্য সন্তান বুদ্ধিজীবীরা জাতিকে বুদ্ধি-পরামর্শ ও নির্দেশনা দিয়ে আমাদের বিজয়কে দ্রুততম সময়ে নিশ্চিত করেছিলেন। পাকিস্তান আমলে এ অঞ্চলের বুদ্ধিজীবীদের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ বুঝতে পেরেছিলেন, পাকিস্তান রাষ্ট্র এ অঞ্চলের জনগণকে ভাগ্যবিড়ম্বিত করে রেখেছে। নতুন রাষ্ট্র সৃষ্টির মধ্য দিয়ে সেই সময় জনগণ যে স্বপ্ন দেখেছিলেন, তা অচিন্তনীয়ভাবে স্বপ্নভঙ্গের কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে। পাকিস্তান রাষ্ট্রের গোয়েন্দা সংস্থাগুলো এদের লেখালেখি ও বলাবলির ওপর গভীর নজর রেখেছে। তাই দেখা গেল ’৭১-এর ২৫ মার্চের কালরাতে সেনা অভিযান শুরু হলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পাড়ায় নাম-ঠিকানা ধরে প্রগতিশীল শিক্ষকদের কয়েকজনকে বেছে বেছে হত্যা করা হল। পাক সামরিক বাহিনীর হত্যাকাণ্ডের অভিযান শুধু ২৫ মার্চের কালরাতেই সীমাবদ্ধ থাকেনি। মুক্তিযুদ্ধের ৯ মাস ধরেই দেশের বিভিন্ন এলাকায় খ্যাতনামা শিক্ষক, প্রকৌশলী, চিকিৎসক ও চিন্তাশীল মানুষকে খুঁজে খুঁজে হত্যা করা হয়েছে। 
হত্যার এ অভিযান অত্যন্ত ভয়াবহ রূপ ধারণ করতে থাকে ৭১-এর ১০ ডিসেম্বর থেকে। ততদিনে পাকিস্তানিরা বুঝে ফেলেছিল তাদের পরাজয় অত্যাসন্ন। যে জনপদ দখলে রাখা যাবে না, সেই জনপদ জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে ছারখার করে দেয়াই হচ্ছে অত্যাসন্ন পরাজয়ের মুখোমুখি শত্রু পক্ষের কাজ। ব্যাপারটি অবশ্য এমন নয় যে, এই ‘পোড়ামাটি’ নীতি কেবল যুদ্ধের শেষ সময় গ্রহণ করা হয়েছিল। কার্যত ৯ মাস ধরেই তারা ধ্বংসলীলা চালিয়েছে। কিন্তু জাতির মননের সম্পদকে ধ্বংস করা হলে তা সহজে পূরণ করা সম্ভব নয়। 
 
৫. একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের তখন চূড়ান্ত পর্যায়। হানাদার পাকিস্তানি বাহিনী তখন প্রায় পর্যুদস্ত। তখনই ১০ থেকে ১৪ ডিসেম্বর পর্যন্ত পরিকল্পিতভাবে তালিকা ধরে বুদ্ধিজীবী হত্যার ঘৃণ্যতম নীল নকশার বাস্তবায়ন করে ঘাতক চক্র। তাদের উদ্দেশ্য ছিল, বিজয়ী বাঙালি জাতি যাতে মেধাশূন্যতার কারণে ভবিষ্যতে আর মাথা তুলে দাঁড়াতে না পারে। এ সময় সান্ধ্য আইনের মধ্যে রাতের আঁধারে তালিকাভুক্ত বুদ্ধিজীবীদের বাসা থেকে অপহরণ  করে চোখ বেঁধে রায়ের বাজার বধ্যভূমিতে নিয়ে গুলি করে ও বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। 
 
৬. ১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দের ১৪ ডিসেম্বর চারদিকে যখন পাকিস্তানি বাহিনীর আত্মসমর্পণের প্রস্তুতি নিচ্ছে- ঠিক তখনই  ঘাতকরা মুনীর চৌধুরী, ড. জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতা, শহীদুল্লাহ কায়সার, সিরাজুদ্দিন হোসেন, আবুল খায়ের, গিয়াসউদ্দিন আহমেদ, মনিরুজ্জামান, আনোয়ার পাশা, নিজাম উদ্দিন আহমেদ, রশিদুল হাসান, সিরাজুল হক খান, ডা. আলীম চৌধুরী, ডা. ফজলে রাব্বি, নাজমুল হক, খন্দকার আবু তালেব, ডা. আমির উদ্দিন, সাইদুল হাসান প্রমুখ বুদ্ধিজীবীকে হত্যা করে। এ ছাড়া অনেক বুদ্ধিজীবীকে তুলে নিয়ে যায় হানাদাররা। যাদের আজ পর্যন্ত কোনো খোঁজ মেলেনি। 
 
৭. একাত্তরে শহীদ বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে ৯৯১ জন শিক্ষাবিদ, ১৩ জন সাংবাদিক, ৪৯ জন চিকিৎসক, ৪২ জন আইনজীবী, ১৬ জন শিল্পী, সাহিত্যিক ও প্রকৌশলী। প্রতি বছরের মতো এবারও ১৪ ডিসেম্বর শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস পালিত হচ্ছে। ১৯৭২ খ্রিষ্টাব্দে জাতীয়ভাবে প্রকাশিত বুদ্ধিজীবী দিবসের সঙ্কলন, পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদ ও আন্তর্জাতিক নিউজ ম্যাগাজিন ‘নিউজ উইক’-এর সাংবাদিক নিকোলাস টমালিনের লেখা থেকে জানা গেছে, শহীদ বুদ্ধিজীবীর সংখ্যা মোট ১ হাজার ৭০ জন। ১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দের ২৯ ডিসেম্বর গঠিত বুদ্ধিজীবী তদন্ত কমিটির রিপোর্টে বলা হয়েছে, রাও ফরমান আলী এদেশের ২০,০০০ বুদ্ধিজীবীকে হত্যার পরিকল্পনা করেছিলেন। কিন্তু এই পরিকল্পনা মতো হত্যাযজ্ঞ চালানো সম্ভব হয়নি। কারণ, ফরমান আলীর টার্গেট ছিল শীর্ষ বুদ্ধিজীবীদেরকে গভর্নর হাউজে নিমন্ত্রণ করে নিয়ে মেরে ফেলা।
 
৮. বুদ্ধিজীবী নিধন তদন্ত কমিশন প্রণীত একটি দলিল থেকে জানা গেছে, বুদ্ধিজীবী হত্যায় যারা ঘৃণ্য ভূমিকা রাখেন, তাদের মধ্যে রয়েছে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ব্রিগেডিয়ার রাজা, ব্রিগেডিয়ার আসলাম, ক্যাপ্টেন তারেক, কর্নেল তাজ, প্রফেসর ড. সৈয়দ সাজ্জাদ হোসাইন, ড. মোহর আলী, আল বদরের এবিএম খালেক মজুমদার, আশরাফুজ্জামান চৌধুরী ও মাইনুদ্দিন। এদের নেতৃত্ব দেন মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলী। 
স্বাধীনতার পর বুদ্ধিজীবীদের তালিকা প্রণয়নের লক্ষ্যে কাজ শুরু করে তৎকালীন সরকার। বাংলাদেশের অস্থায়ী সরকারের প্রথম প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমেদ বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ড বিষয়ে একটি তদন্ত কমিশন গঠনের সিদ্ধান্ত নেন। একাত্তরের ১৮ ডিসেম্বর মতান্তরে ২৯ ডিসেম্বর বেসরকারিভাবে গঠিত হয় ‘বুদ্ধিজীবী নিধন তদন্ত কমিশন’। এরপর গঠিত হয় ‘বুদ্ধিজীবী তদন্ত কমিটি’। কিন্ত তাঁর এ সিদ্ধান্ত কার্যকর হয়নি। বুদ্ধিজীবী তদন্ত কমিশনের আহবায়ক ছিলেন চলচ্চিত্রকার জহির রায়হান, যিনি নিখোঁজ হন ১৯৭২ খ্রিষ্টাব্দের ৩০ জানুয়ারি। জহির রায়হান বলেছিলেন, এরা নির্ভুলভাবে বাংলাদেশের গণতন্ত্রমনা বুদ্ধিজীবীদেরকে বাছাই করে আঘাত হেনেছে।
 
৯. দেশের শ্রেষ্ঠ সন্তান বুদ্ধিজীবীদের হাত-পা-চোখ বাঁধা ক্ষতবিক্ষত লাশ আজও অশ্রু ঝরায় স্বজনহারানো পুরো বাংলাদেশের চোখে। 
 
১০. বিজয় দিবসের প্রাক্কালে আজকের এই দিনে আমরা আবারো জাতির এই মহান সন্তানদের শ্রদ্ধাবনতচিত্তে স্মরণ করি। কিন্তু যাঁরা নিজেদের জ্ঞান-মনীষা ও অধ্যবসায়ের মাধ্যমে জাতিকে পথ দেখিয়েছেন, আলোকিত করেছেন, তাঁদের বছরের একটি দিন স্মরণ করাই যথেষ্ট নয়। আমাদের অনুধাবন করতে হবে কেন এই মহৎপ্রাণ মানুষগুলো জীবন দিয়েছেন। যাদের আত্মত্যাগে অর্জিত হয়েছে স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ, আমরা পেয়েছি স্বাধীন মানচিত্র। 
 
লেখক : সহকারী অধ্যাপক, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, ভাসানটেক সরকারি কলেজ, ঢাকা
 
স্কুল-কলেজ খুলছে রোববার, ক্লাস চলবে শনিবারও - dainik shiksha স্কুল-কলেজ খুলছে রোববার, ক্লাস চলবে শনিবারও নারীদের আইসিটিতে দক্ষ হতে হবে: শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী - dainik shiksha নারীদের আইসিটিতে দক্ষ হতে হবে: শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী ডিগ্রি তৃতীয় শিক্ষকদের এমপিওভুক্তির সভা ৩০ এপ্রিল - dainik shiksha ডিগ্রি তৃতীয় শিক্ষকদের এমপিওভুক্তির সভা ৩০ এপ্রিল সনদের কাগজ কীভাবে পায় কারবারিরা, তদন্তে নেমেছে ডিবি - dainik shiksha সনদের কাগজ কীভাবে পায় কারবারিরা, তদন্তে নেমেছে ডিবি কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে বুয়েটে সিসিটিভি ফুটেজে ধরা পড়লো হিজবুত তাহরীরের লিফলেট বিতরণ - dainik shiksha বুয়েটে সিসিটিভি ফুটেজে ধরা পড়লো হিজবুত তাহরীরের লিফলেট বিতরণ সাংবাদিকদের ঘুষ বিষয়ক ভাইরাল ভিডিও, ইরাব কোনো বিবৃতি দেয়নি - dainik shiksha সাংবাদিকদের ঘুষ বিষয়ক ভাইরাল ভিডিও, ইরাব কোনো বিবৃতি দেয়নি ফাঁসপ্রশ্নে প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগ, নজরদারিতে যারা - dainik shiksha ফাঁসপ্রশ্নে প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগ, নজরদারিতে যারা এইচএসসির ফল জালিয়াতির অডিয়ো ফাঁস - dainik shiksha এইচএসসির ফল জালিয়াতির অডিয়ো ফাঁস please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.007606029510498