ধর্ষক ও নারী নির্যাতনকারীদের দ্রুত বিচার ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি, উত্তরাধিকারে নারী-পুরুষের সমঅধিকার, সভা-সমাবেশে নারীবিদ্বেষী বক্তব্য শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবে গণ্য করাসহ ১১ দফা দাবিতে শাহবাগে ‘নারী গণসমাবেশ’ করেছে বামধারার নারী সংগঠনগুলো।
‘সারা দেশে অব্যাহত ধর্ষণ, নারী-শিশু নিপীড়ন ও বিচারহীনতার বিরুদ্ধে প্রতিরোধ জোরদার করুন’ আহ্বানে শুক্রবার বিকালে শাহবাগের জাতীয় জাদুঘরের সামনে এই সমাবেশ হয়।
দেশব্যাপী অব্যাহত ধর্ষণ ও নারী নিপীড়নের প্রতিবাদে শুক্রবার বিকালে শাহবাগে ‘নারী গণসমাবেশে’ ধর্ষণ ও নারী নির্যাতনবিরোধী প্ল্যাকার্ড হাতে নারীরা। ছবি: আসিফ মাহমুদ অভিদেশব্যাপী অব্যাহত ধর্ষণ ও নারী নিপীড়নের প্রতিবাদে শুক্রবার বিকালে শাহবাগে ‘নারী গণসমাবেশে’ ধর্ষণ ও নারী নির্যাতনবিরোধী প্ল্যাকার্ড হাতে নারীরা। ছবি: আসিফ মাহমুদ অভিসমাবেশে সভাপতিত্ব করেন বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি-সিপিবির নারী সেলের আহ্বায়ক লক্ষ্মী চক্রবর্তী এবং সমাবেশ পরিচালনা করেন সমাজতান্ত্রিক মহিলা ফোরামের সাধারণ সম্পাদক শম্পা বসু।
সমাবেশে ১১ দফা দাবি তুলে ধরেন লক্ষ্মী চক্রবর্তী। দাবিগুলো হল-
# সারা দেশে অব্যাহতভাবে ধর্ষণ ও নারীর প্রতি সহিংসতার সাথে যুক্তদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে।
# পাহাড়-সমতলে আদিবাসী নারীদের ওপর সামরিক-বেসামরিক সকল প্রকার যৌন ও সামাজিক নিপীড়ন বন্ধ করতে হবে।
# হাই কোর্টের নির্দেশ অনুযায়ী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসহ সরকারি, বেসরকারি সকল প্রতিষ্ঠানে নারী নির্যাতনবিরোধী সেল কার্যকর করতে হবে।
# সম্পত্তির উত্তরাধিকারে নারী-পুরুষের সমান অধিকার নিশ্চিত করতে হবে। ইউনিফর্ম সিভিল কোড চালু করতে হবে। বাংলাদেশকে সিডো সনদের ২ এবং ১৬-১ (গ) ধারা স্বাক্ষর করে সিডো সনদের পূর্ণ অনুমোদন ও বাস্তবায়ন করতে হবে। নারীর প্রতি বৈষম্যমূলক সকল আইন ও প্রথা বিলোপ করতে হবে।
# ধর্ষণ মামলার ক্ষেত্রে সাক্ষ্য আইন-১৮৭২-১৫৫(৪) ধারাকে বিলোপ করতে হবে এবং মামলার ডিএনএ আইনকে সাক্ষ্য প্রমাণের ক্ষেত্রে কার্যকর করতে হবে।
# অপরাধ বিজ্ঞান ও জেন্ডার বিশেষজ্ঞদের নারী ও শিশু নির্যাতন দমন মামলা দ্রুত নিষ্পন্ন করতে হবে।
# তদন্তকালে ভিকটিমকে মানসিক নিপীড়ন-হয়রানি বন্ধ করতে হবে। ভিকটিমের আইনগত ও সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে।
# ধর্মীয়সহ সব ধরনের সভা-সমাবেশে নারী বিদ্বেষী সংবিধানবিরোধী বক্তব্য শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবে গণ্য করতে হবে। সাহিত্য, নাটক, সিনেমা, বিজ্ঞাপনে নারীকে পণ্য হিসেবে উপস্থাপন করা বন্ধ করতে হবে। পর্নোগ্রাফি নিয়ন্ত্রণে বিটিসিএলের কার্যকর ভূমিকা পালন করতে হবে। সুস্থ ধারার সাংস্কৃতিক চর্চা সরকারিভাবে পৃষ্ঠপোষকতা করতে হবে।
# সারা দেশে মাদক বন্ধে সরকারিভাবে কার্যকর ভূমিকা গ্রহণ করতে হবে।
# পাঠ্যপুস্তকে বিদ্যমান নারীর প্রতি অবমাননা ও বৈষম্যমূলক যে কোনো প্রবন্ধ, নিবন্ধ, পরিচ্ছদ, ছবি, নির্দেশনা ও শব্দ চয়ন পরিহার করতে হবে।
# গ্রামীণ সালিশের মাধ্যমে ধর্ষণের অভিযোগ ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টাকে শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবে গণ্য করতে হবে।
সারা দেশে অব্যাহত ধর্ষণ, নারী-শিশু নিপীড়ন ও ‘বিচারহীনতার’ বিরুদ্ধে প্রতিরোধ জোরদারের আহ্বান জানিয়ে শুক্রবার বিকালে শাহবাগে ‘নারী গণসমাবেশ’। ছবি: আসিফ মাহমুদ অভিসারা দেশে অব্যাহত ধর্ষণ, নারী-শিশু নিপীড়ন ও ‘বিচারহীনতার’ বিরুদ্ধে প্রতিরোধ জোরদারের আহ্বান জানিয়ে শুক্রবার বিকালে শাহবাগে ‘নারী গণসমাবেশ’। ছবি: আসিফ মাহমুদ অভিসিপিবি নেত্রী লক্ষ্মী চক্রবর্তী বলেন, “আমরা খুব সুস্পষ্টভাবে মনে করি, গণতন্ত্রহীনতা, বিচারহীনতা ও নারীর প্রতি সমাজ ও রাষ্ট্রের প্রচলিত দৃষ্টিভঙ্গির কারণে আজকে এ ভয়াবহ পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে।”
চলতি বছরে নারী নির্যাতনের পরিসংখ্যান তুলে ধরে তিনি বলেন, “এ বছরের ২৫ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ৯৭৫টি ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে। ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে ৪৩ জন নারীকে, আত্মহত্যা করেছেন ১২ জন নারী।
“শুধু ধর্ষণ নয়, বহুমাত্রিক উপায়ে নারী-শিশুকে নির্যাতন নিপীড়ন করছে এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তা ছড়িয়ে দিয়ে চূড়ান্ত ঔদ্ধত্য দেখাচ্ছে। মাত্র ৩ শতাংশ নারী নির্যাতন ও ধর্ষণের বিচার হচ্ছে বলে গণমাধ্যমে প্রকাশ, বিচার না হওয়ার কারণে অপরাধীরা আরও বেপরোয়া হয়ে ওঠে এবং অপরদিকে আক্রান্ত মানুষেরা ও তাদের পরিবার চরম নিরাপত্তাহীনতার মধ্যে পড়ে।”
নারীর অধিকার আদায়ে বিভিন্ন সময়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখা নারীদের ছবি হাতে মিছিল নিয়ে শুক্রবার ঢাকার শাহবাগে ‘নারী গণসমাবেশে’ যোগ দেন একদল নারী। ছবি: আসিফ মাহমুদ অভিনারীর অধিকার আদায়ে বিভিন্ন সময়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখা নারীদের ছবি হাতে মিছিল নিয়ে শুক্রবার ঢাকার শাহবাগে ‘নারী গণসমাবেশে’ যোগ দেন একদল নারী। ছবি: আসিফ মাহমুদ অভিদাবির মুখে ধর্ষণের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ডের বিধান রেখে সম্প্রতি আইন সংশোধন করেছে সরকার।
তবে ধর্ষণের বিচার প্রক্রিয়া নিয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করে লক্ষ্মী চক্রবর্তী বলেন, “আমরা মনে করি, ৯৭ শতাংশ ধর্ষণের বিচার প্রক্রিয়াকে অকার্যকর রেখে এবং অপরাধ প্রমাণ করার পদ্ধতিসহ আক্রান্ত নারী ও তার পরিবারের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার ব্যবস্থা না করে এ ধরনের একটি সিদ্ধান্ত নেওয়া লোকদেখানো বা মূল ঘটনাকে অন্যদিকে দৃষ্টিপাত করানোর একটি অপকৌশল মাত্র।”
তিনি বলেন, “ধর্ষণবিরোধী আন্দোলন একটি রাজনৈতিক ও মতাদর্শিক লড়াই, ধর্ষণ বন্ধ করতে হলে একইসাথে বিদ্যমান সমাজ ব্যবস্থা পরিবর্তন করতে হবে। তার সাথে এ অপরাধের সুষ্ঠু ও দ্রুত বিচার নিশ্চিত করতে হবে।”
দেশব্যাপী অব্যাহত ধর্ষণের প্রতিরোধে শুক্রবার বিকালে শাহবাগে ‘নারী গণসমাবেশে’ ধর্ষণ ও নারী নির্যাতনবিরোধী প্ল্যাকার্ড হাতে এক শিশু। ছবি: আসিফ মাহমুদ অভিদেশব্যাপী অব্যাহত ধর্ষণের প্রতিরোধে শুক্রবার বিকালে শাহবাগে ‘নারী গণসমাবেশে’ ধর্ষণ ও নারী নির্যাতনবিরোধী প্ল্যাকার্ড হাতে এক শিশু। ছবি: আসিফ মাহমুদ অভিসিপিবির নারী সেল ছাড়াও সমাজতান্ত্রিক মহিলা ফোরাম, শ্রমজীবী নারী মৈত্রী, নারী সংহতি, বাংলাদেশ নারী মুক্তি কেন্দ্র, বিপ্লবী নারী ফোরামের নেতকর্মীরা এই সমাবেশে যোগ দেন।
কর্মসূচির শুরুতে বাংলাদেশ উদীচী শিল্পী গোষ্ঠী ও চারণ সাংস্কৃতিক কেন্দ্রের পরিবেশনায় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হয়। এরপর শ্লোগানে শ্লোগানে মুখরিত এক বর্ণাঢ্য মিছিল শাহবাগ থেকে শুরু হয়ে কাঁটাবন ও বাটা সিগন্যাল মোড় ঘুরে শাহবাগে এসে শেষ হয়। মিছিল শেষে সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়।
সারা দেশে অব্যাহত ধর্ষণ, নারী-শিশু নিপীড়ন ও ‘বিচারহীনতার’ বিরুদ্ধে প্রতিরোধ জোরদারের আহ্বান জানিয়ে শুক্রবার বিকালে শাহবাগে আয়োজিত ‘নারী গণসমাবেশে’ মিছিল নিয়ে যোগ দেন সিপিবির নারী সেলের নেতাকর্মীরা। ছবি: আসিফ মাহমুদ অভিসারা দেশে অব্যাহত ধর্ষণ, নারী-শিশু নিপীড়ন ও ‘বিচারহীনতার’ বিরুদ্ধে প্রতিরোধ জোরদারের আহ্বান জানিয়ে শুক্রবার বিকালে শাহবাগে আয়োজিত ‘নারী গণসমাবেশে’ মিছিল নিয়ে যোগ দেন সিপিবির নারী সেলের নেতাকর্মীরা। ছবি: আসিফ মাহমুদ অভিসমাবেশে অন্যদের মধ্যে শ্রমজীবী নারী মৈত্রীর সভাপতি বহ্নিশিখা জামালী, বাংলাদেশ নারীমুক্তি কেন্দ্রের সভাপতি সীমা দত্ত, নারী সংহতির ভারপ্রাপ্ত সভাপতি তাসলিমা আখতার এবং বিপ্লবী নারী ফোরামের সহ-সাধারণ সম্পাদক আমেনা আক্তার বক্তব্য দেন।
সমাবেশ থেকে আগামী মাসব্যাপী সারা দেশের জেলায় জেলায় নারী সমাবেশের কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়।