বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে আবারো প্যাটার্নের অতিরিক্ত ভুল পদে ও নারী কোটার পদে সুপারিশপ্রাপ্ত হয়েছেন শতশত প্রার্থী। গতমাসে প্রকাশিত চূড়ান্ত সুপারিশ পত্র নিয়ে শিক্ষক হিসেবে যোগদান করতে গেলে প্রার্থীরা এসব বিষয় জানতে পারছেন। এমন পরিস্থিতিতে যোগদান করলেও তারা এমপিওভুক্ত হতে পারবেন না। তারা শিক্ষা প্রশাসনের কাছে জটিলতা নিরসনের দাবি জানিয়েছেন। প্রার্থীরা চাচ্ছেন তাদের নিজ জেলার স্কুল-কলেজ ও মাদরাসায় নতুন করে সুপারিশ করা হোক।
এর আগে ২০১৯ খ্রিষ্টাব্দের দ্বিতীয় নিয়োগচক্রেও সারাদেশে দুই হাজার পাঁচশ’র বেশি প্রার্থী মহিলা কোটা ও প্যাটার্ন অতিরিক্ত পদে সুপারিশ পেয়ে ১৫ মাসের বেশি সময় এমপিওভুক্ত হতে পারেননি। এই সময় তারা কোষাগার থেকে বেতন-ভাতাবঞ্চিত ছিলেন। বিষয়টি নিয়ে দৈনিক আমাদের বার্তার সহযোগী প্রতিষ্ঠান দেশের শিক্ষাবিষয়ক একমাত্র ডিজিটাল পত্রিকা দৈনিক শিক্ষাডটকমে একাধিক প্রতিবেদন প্রকাশ হয়েছিল। পরে নিয়োগ সুপারিশের ১৫ মাস পর শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে তাদের নতুন প্রতিষ্ঠানে সুপারিশ করে বেসরকারি শিক্ষক নিবন্ধন ও প্রত্যয়ন কর্তৃপক্ষ (এনটিআরসিএ) এবং সে প্রার্থীরা এমপিওভুক্ত হতে পেরেছিলেন। এদিকে দ্বিতীয় নিয়োগ চক্রের প্যাটার্ন জটিলতা ও মহিলা কোটায় সুপারিশপ্রাপ্ত প্রার্থীদের দুঃসহ স্মৃতি নতুন সুপারিশপ্রাপ্তদের ভাবাচ্ছে। যদিও এনটিআরসিএর কর্তারা এ জটিলতা নিরসনের আশ্বাস দিয়েছেন। তারা বলছেন, ভুল পদে ও মহিলা কোটার প্রার্থীদের নতুন প্রতিষ্ঠানে সুপারিশ করার বিষয়ে চিন্তাভাবনা করা হচ্ছে।
এমপিওভুক্তি নিয়ে শঙ্কায় প্রার্থীরা :
শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে জনবল কাঠামোর প্যাটার্নের অতিরিক্ত ও মহিলা কোটার পদে সুপারিশপ্রাপ্ত প্রার্থীরা দৈনিক আমাদের বার্তাকে তাদের দুশ্চিন্তার কথা জানিয়েছেন। কয়েকজন প্রার্থীর কাছ থেকে তথ্য উপাত্ত সংগ্রহ করেছে দৈনিক আমাদের বার্তা।
জামালপুরের মাদারগঞ্জ উপজেলার মোজাম্মেল মমতাজ টেকনিক্যাল মহিলা কলেজে প্রভাষক সুপারিশ পাওয়া নিবন্ধিত প্রার্থী পলি রায় ভুল পদে সুপারিশপ্রাপ্ত হয়েছেন। তিনি বলেন, ওই প্রতিষ্ঠানের অধ্যক্ষ বলেছেন তার প্রতিষ্ঠানে শূন্যপদের চাহিদা দেয়া হয়নি, কিন্তু এনটিআরসিএ সুপারিশ করেছে। এখন কী করব, বুঝতে পারছি না।
সহকারী শিক্ষক পদে সুপারিশ পাওয়া প্রার্থী আবদুল্লাহ জানান, তিনি জামালপুরের বাহাদুরপুর হাই স্কুল নামের একটি প্রতিষ্ঠানে সুপারিশ পেয়েছেন। কিন্তু এমপিও পদ নেই। তবুও তারা এমপিও পদের চাহিদা দিয়েছেন, এখন বলছে এ পদে এমপিও হবে।
দিনাজপুরের চিরিরবন্দর উপজেলার ভূষিরবন্দর জমির উদ্দিন সরকার মেমোরিয়াল বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ে সহকারী শিক্ষক পদে সুপারিশপ্রাপ্ত প্রার্থী রেজিনা পারভীন জানান, প্রতিষ্ঠানপ্রধান ভুল চাহিদা দেয়ায় তিনি সুপারিশ পেয়েছেন। এখন যোগদান করতে গিয়ে দেখছেন ভুল চাহিদা দেয়া হয়েছে।
নাটারের বাগাতিপাড়ার পেড়াবাড়িয়া দাখিল মাদরাসায় সহকারী শিক্ষক পদে সুপারিশপ্রাপ্ত প্রার্থী আবদুর রাজ্জাক দৈনিক আমাদের বার্তাকে জানান, আমাকে যে পদে সুপারিশ করা হয়েছে তা একটা সৃষ্ট পদ। ২০২১-২২ অর্থবছরে এটি সৃষ্ট হওয়ার কথা। কিন্তু প্রতিষ্ঠান থেকে আগেই এ পদের চাহিদা দিয়েছেন। যেহেতু আমাদের সার্কুলার হয়েছে ২০২০-২০২১ অর্থবছরে, সেহেতু এমপিওভুক্তির জন্য এ পদের প্রাপ্যতা নেই বলে জানিয়েছেন মাদরাসা শিক্ষা অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা। এই পদের এমপিও হবে না। এখন আমি কী করব বুঝতে পারছি না।
মাহমুদুল হাসান রাসেল নামের অপর এক প্রার্থী বলেন, ঝালকাঠির কাঠালিয়া উপজেলায় বানাই স্কুল এন্ড কলেজে তিনি নিয়োগ সুপারিশ পেয়েছেন। কিন্তু প্রতিষ্ঠান প্রধান ভুল চাহিদা দিয়েছেন। যোগদান করতে গিয়ে বিষয়টি জানতে পেরেছেন তিনি।
প্রার্থীরা আরো জানান, দ্বিতীয় নিয়োগচক্রে প্রায় আড়াই হাজার প্রাথী প্যাটার্ন জটিলতা ও নারী কোটার পদে সুপারিশ পেয়ে দীর্ঘ দিন এমপিওভুক্ত হতে পারেননি। ১৫ মাস পরে তাদের এমপিওর জটিলতা সমাধানে তাদের নতুন প্রতিষ্ঠানে সুপারিশ করা হয়। আমরা দীর্ঘদিন অপেক্ষা করে নিয়োগ সুপারিশ পেয়েছি। স্বপ্ন ছিল দ্রুত এমপিওভুক্ত হবো। কিন্তু সুপারিশ জটিলতায় সে স্বপ্ন নষ্ট হতে বসেছে।
এদিকে এনটিআরসিএর কার্যালয়ে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, তারা এখন পর্যন্ত তৃতীয় চক্রের শিক্ষক নিয়োগে প্যাটার্ন জটিলতা ও নারী কোটার ভোগান্তিতে থাকা বেশ কয়েকজন প্রার্থীর তথ্য পেয়েছেন। বিষয়টি নিশ্চিত করে গতকাল সোমবার একজন কর্মকর্তা দৈনিক আমাদের বার্তাকে জানান, ১৩০ জন প্রার্থীর অভিযোগ যৌক্তিক শনাক্ত করেছি। প্রতিদিনই অভিযোগ আসছে। তবে সব অভিযোগ সব সময় ঠিক হয় না। আমরা যাচাই বাছাই করে দেখছি। তবে, দ্বিতীয় চক্র থেকে তৃতীয় চক্রে এ ধরণের জটিলতা কিছুটা কম।
তিনি আরও বলেন, যেসব প্রার্থী এ সংক্রান্ত জটিলতায় আছেন, তাদের এনটিআরসিএতে আবেদন জানানোর অনুরোধ জানাচ্ছি।
জটিলতা নিরসনের আশ্বাস :
এনটিআরসিএর চেয়ারম্যান এনামুল কাদের খান দৈনিক আমাদের বার্তাকে বলেন, আমরা বেশ কয়েকজন প্রার্থীর তথ্য পেয়েছি। তাদের অভিযোগ যাচাই বাছাই করা হচ্ছে। যারা জটিলতায় আছেন তাদের নিজ নিজ বাড়ির কাছের নতুন প্রতিষ্ঠানে সুপারিশ করতে চাচ্ছি। এ বিষয়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে আমরা চিঠি লিখেছি। তারা অনুমতি দিলে আমার এসব জটিলতা নিরসনের কাজ শুরু করব।
আগের নিয়োগ চক্রে প্রার্থীদের ১৫ মাস বিনা বেতনে শিক্ষকতা করতে হয়েছে। তৃতীয় ধাপের নিয়োগের কত সময় লাগতে পারে তা জানতে চাইলে চেয়ারম্যান আরও জানান, আশা করছি এবার দ্রুত জটিলতা নিরসন হবে। আমরা মার্চ মাসের মধ্যে তৃতীয় চক্রের সব কাজ শেষ করে এপ্রিল চতুর্থ নিয়োগ চক্রের কাজ শুরু করতে চাচ্ছি। এর মধ্যেই জটিলতা নিরসন হবে বলে আশা করেন তিনি।
ভুল তথ্য পাঠানো প্রতিষ্ঠান প্রধানদের এমপিও বন্ধ হবে :
২০২১ খ্রিষ্টাব্দে জারি হওয়া এমপিও নীতিমালা ও জনবল কাঠামোতে শূন্যপদের ভুল চাহিদা দেয়া প্রতিষ্ঠান প্রধানদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার বিধান রাখা হয়েছে। স্কুল কলেজের নীতিমালার ১৮ এর (ঘ) ধারায় বলা হয়েছে, প্রতিষ্ঠান থেকে এনটিআরসিএতে শিক্ষক-প্রদর্শকের চাহিদা দিলে ওই পদে সুপারিশকৃত শিক্ষক বা প্রদর্শককে নিয়োগ দিতে হবে। চাহিদা দেয়ার সময় পদটি এমপিও বা নন-এমপিও তা সুস্পষ্ট করে লিখতে হবে। প্যাটার্ন অতিরিক্ত চাহিদা দিলে ওই শিক্ষক বা প্রদর্শকের শতভাগ বেতন-ভাতা প্রতিষ্ঠান থেকে নির্বাহ করতে হবে। এ শর্তের ব্যত্যয় ঘটলে প্রতিষ্ঠান প্রধানের বেতন-ভাতা স্থগিত বা বাতিল করা হবে এবং কমিটির সভাপতির পদ শূন্য ঘোষণা করা হবে। একইসঙ্গে তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
ভুল তথ্য পাঠানো প্রতিষ্ঠান প্রধানদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে সুপারিশ করা হবে বলেও জানান এনটিআরসিএর চেয়ারম্যান। এনামুল কাদের খান বলেন, আমরা গত নিয়োগের ভুল তথ্য পাঠানো প্রতিষ্ঠান প্রধানদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার সুপারিশ করেছিলাম। সে অনুযায়ী শিক্ষা মন্ত্রণালয় তাদের এমপিও কয়েকমাসের জন্য বন্ধ করেছিল। এবারও আমরা শিক্ষা মন্ত্রণালয়কে বিষয়টি লিখবো। তারা এ বিষয়ে ব্যবস্থা নেবেন।
জটিলতার দায় আছে শিক্ষা কর্মকর্তাদেরও :
জানা গেছে, ২০১৯ খ্রিষ্টাব্দের শূন্যপদের তথ্য সংশোধনের পর তা জেলা ও উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তাদের মাধ্যমে যাচাই করা হয়। দীর্ঘ কয়েকমাস যাচাই বাছাই শেষে শূন্যপদের তথ্য চূড়ান্ত করা হয়। কিন্তু তার পরেও ভুল পদে সুপারিশ করা হয়েছে।
কেন এ জটিলতা জানতে চাইলে এনটিআরসিএর চেয়ারম্যান জানান, আমার যা মনে হয়েছে প্রতিষ্ঠান প্রধানরা প্রযুক্তিগত দিক থেকে অনেকটা পিছিয়ে। তাই অনেকে কর্মচারী বা দোকানির মাধ্যমে শূন্যপদের চাহিদা পাঠিয়েছেন। এজন্য জটিলতা সৃষ্টি হতে পারে।
তিনি আরও বলেন, জেলা-উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তারা শূন্যপদের তথ্য যাচাই করে দিয়েছেন। তবুও ভুল আছে। যারা যাচাই করেছেন তাদের অবহেলা আছে বলেই মনে হচ্ছে।