শিক্ষক নিয়োগ: যে আদালত এখন আর বসে না - দৈনিকশিক্ষা

শিক্ষক নিয়োগ: যে আদালত এখন আর বসে না

বোরহানুল হক সম্রাট |

একজন বিচারপতি যেদিন পশ্চিমবঙ্গের হাই স্কুলের এক হাজার ৯১১ জন অশিক্ষক কর্মীর চাকরি বাতিলের নির্দেশ দিয়েছিলেন, সেদিন শুধু কলকাতাতেই নয়, সবার চোখ কপালে ওঠার দশা হয়েছিল ভারতবর্ষ জুড়েই। সেই আদেশে চাকরি চলে যায় নিয়ম-বহির্ভূতভাবে নিয়োগ পাওয়ার অভিযোগ থাকা অনেক প্রাথমিক ও হাই স্কুল শিক্ষকেরও। বিচারপতির পর্যবেক্ষণ ছিলো, নিয়োগ পরীক্ষার উত্তরপত্রের ৩ নম্বর স্কুল সার্ভিস কমিশনের সার্ভারে নম্বর বেড়ে দঁড়িয়েছিল ৫৩!  কিভাবে তা সম্ভব হয়েছে এজলাসে বসেই সেই কমিশনের আইনজীবীর কাছে জানতে চান তিনি। যাকে বাদ দিয়ে মন্ত্রিকন্যা নিজে নিয়ে নিয়েছিলেন চাকরি, সেই বিচারপতি তা পাল্টে দেন। যোগ্য মেয়েটিকে চাকরি দিয়ে মন্ত্রী কন্যাকে বেকার করে দেন।

একদিন আরো ওপর থেকে নির্দেশ আসে। বিচারপতির ‘বিচার’ হয় দিল্লি থেকে। গত শুক্রবার দুপুরে সেই বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়ের এজলাস থেকে নিয়োগ সংক্রান্ত মামলা সরানোর নির্দেশ দেন সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি ডিওয়াই চন্দ্রচূড়। গতকাল মঙ্গলবারের খবর অনুযায়ী, তার কাছ থেকে নিয়ে প্রাথমিকের দুটি মামলা দেয়া হয় বিচারপতি অমৃতা সিনহাকে।   

এমন দুর্নীতির খতিয়ান দেখে ওই মামলা সম্পর্কে সিটিং জাজ হয়েও একটি টেলিভিশনে সাক্ষাৎকার দেয়ার দায়ে সুপ্রিম কোর্ট বিচারপতি অভিজিৎকেই ওই মামলা পরিচালনা থেকে সরিয়ে দেন।  

এ ঘটনার শুরু হয়েছিল রাজ্যের স্কুলে স্কুলে নিয়োগে দুর্নীতি হয়েছে অভিযোগ এনে বহু মামলাকারী কলকাতা হাই কোর্টের দ্বারস্থ হওয়ার পর থেকে। বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায় এজলাসে মন্তব্য করেছিলেন, রাজ্যে স্কুল নিয়োগে যে দুর্নীতি প্রকাশ্যে এসেছে তা ‘শিউরে’ ওঠার মতো।

এই যে শিউরে ওঠার মতো ব্যাপার-স্যাপার, সেসব আমাদের দেশের প্রেক্ষিতে যদি চিন্তা করা যায় তাহলে ঠিক কোন শব্দটি যথাযথ হবে। ২০০৪ খ্রিষ্টাব্দের ৬ নভেম্বর প্রথম আলো পত্রিকায় প্রকাশিত আমার লেখা লিড স্টোরির প্রথম লাইনটি এমন-‘এক মিনিটেরও কম সময়ের মৌখিক পরীক্ষার ভিত্তিতে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে এক বছরে সহস্রাধিক নিয়োগ দেওয়া হয়েছে।’

বিচারপতি অভিজিৎ তার পর্যবেক্ষণে নম্বর বেড়ে যাওয়ায় বিষয়ে বলেছেন, জাদুকর পিসি সরকারের ছোঁয়ায় হঠাৎ এতো নম্বর বেড়ে গেলো। তার সামনে যদি দেখানো হয়, নভেম্বর থেকে মার্চ মাত্র ৪ মাসে কীভাবে ৭শ লোক নিয়োগ দেয়া হয়েছে অথবা যে পত্রিকায় নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি দেয়া হয়েছে তার সবগুলো কপি ছাপাখানা থেকেই কিনে ফেলা হয়েছে যাতে নিয়োগকৃতরা ছাড়া আর কেউ তা দেখতেই না পারেন-সেটাকে তিনি কোন জাদুকরের কাজ বলবেন। 

জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি প্রয়াত অধ্যাপক আফতাব আহমাদের মতো অবশ্য বোকামি করে পরে যারা এসেছেন তারা এভাবে নিয়োগ করেননি, বরং বছরজুড়ে সেই নিয়োগ ছড়িয়ে দিয়েছেন। বলা হয়, গত দশ বছরে এমন কোনো সপ্তাহ ছিলো না যে সময়ে নিয়োগ থেমে ছিলো। এভাবে নিয়োগপ্রাপ্ত বহুজন ‘আসি যাই বেতন পাই’ এর পুরনো জনদের উত্তরাধিকার হয়েছেন। এখন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের মান নিয়ে আর কথা হয় না খুব একটা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের নামের যে ডায়েরি তা বছর বছর যে মাত্রায় মোটা হয়েছে, তাতে বোঝা যায় থেমে নেই নিয়োগযন্ত্র। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে মনের মতো উপাচার্য নিয়োগ দেয়া হয়, কোনো জ্ঞান গরিমার কথা ভেবে নয়, রাষ্ট্রের টাকায় নিজের দলের লোকদের কর্মসংস্থানের কথা মাথায় রেখেই। তাইতো ২ দশক ধরেই অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বলে যাচ্ছেন- শিক্ষক নয়, ভোটার নিয়োগ দেয়া হয়েছে। ফলে এই ভোটার এক সময় এতোটাই ব্যবধান বাড়িয়ে ফেলেছেন যে বিবেকের বাতিঘর বলে পরিচিত শিক্ষক সমিতিতেও এখন আর নির্বাচন হয় না। শুধু শিক্ষক নন, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে অদ্ভূত সব উচ্চপদ তৈরি হয় প্রিয় ও দলীয় লোকদের জন্য। নামের আগে যারা লেখেন ডিরেক্টর বা পরিচালক। সেই পরিচালক মহোদয়ের কাজ কী বা গত এক বছরে তিনি কী করেছেন বিশ্ববিদ্যালয়ে, বিচারপতি অভিজিৎ যদি তাকে জিজ্ঞাসা করেন তবে উত্তর দিতে তাদের অনেক কষ্ট হবে। যেহেতু তেমন হবার কোনো সুযোগ-ই নেই, ফলে এ নিয়ে তারা নির্ভার।    

নিয়োগ দুর্নীতি মামলার শুনানিতে বিচারপতি অভিজিৎ রাজ্যের প্রাথমিক এবং মধ্যশিক্ষা পর্ষদকেও একাধিক কড়া নির্দেশ দিয়েছিলেন। কতো জন অযোগ্য চাকরিপ্রার্থীকে নিয়ম ভেঙে চাকরি দেওয়া হয়েছিল, সেই খতিয়ানও আদালতে পেশ করতে বলেন তিনি। শুধু তাই নয়, সরকারের মাদরাসা নিয়ে ওঠা নিয়োগ দুর্নীতির অভিযোগের তদন্তভারও তিনি কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থার হাতে তুলে দেন। নবম-দশমে নিয়োগ দুর্নীতি মামলায় সিবিআই অনিয়মের তথ্যপ্রমাণ আদালতে পেশ করার পর স্কুল সার্ভিস কমিশন (এসএসসি)-এর বক্তব্য জানতে চেয়েছিলেন বিচারপতি। কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থার সেই তদন্তে দেখা যায়, অনেক চাকরিপ্রার্থী উত্তরপত্রে (ওএমআর শিট) ১-২ করে নম্বর পেলেও কমিশনের সার্ভারে সেই নম্বরই বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৫০-এরও বেশি।
একবার ভাবুন তো আমাদের প্রাথমিকের কথা। প্রাথমিকে সবচেয়ে বড় নিয়োগ প্রক্রিয়ায়  লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষা শেষে সহকারী শিক্ষক পদে ৩৭ হাজার ৫৭৪ জনকে চূড়ান্তভাবে নির্বাচিত করা হয়।  প্রায় দুই বছরের বেশি সময় ধরে চলা সেই কার্যক্রম শেষ হয় গত জানুয়ারিতে। অবশ্য এর মধ্যে ২ হাজার ৫৫৭ জন চাকরিতে যোগ দেননি। আমরা বিশ্বাস করতে চাই, এই নিয়োগ প্রক্রিয়া যথাযথ হয়েছে। কিন্তু বাস্তবতা সেই ৩৫ হাজার শিক্ষক জানেন, তারা স্থানীয় এমপি, মন্ত্রী, প্রভাবশালী রাজনীতিবিদ, ছাত্রনেতার কাছে টাকার থলি নিয়ে ধরনা দিয়েছিলেন কী না। অথবা একেকটা নিয়োগের লিখিত পরীক্ষার নম্বর বণ্টনে কলকাতার মতো জাদুকর পিসি রায়ের ভূমিকা কতটুকু ছিলো। 

যাই হোক, যদি তাদের অনেকেই আগামী ৩৫ বছর ধরে পড়াতে না পারেন, শিক্ষার্থীরা তাদের মুখের দিকে তাকিয়ে তাদের অপারগতায় বিস্মৃত হন, তাহলে দেশের বড় ক্ষতি হয়ে যাবে। স্কুল আর কলেজের গভর্নিং বডির চেয়ারম্যান অথবা সদস্য হওয়া নিয়ে স্থানীয় রাজনীতিবিদদের যে লড়াই তার পেছনে কোন সূত্র কাজ করে সেটা দিনের আলোর মতো পরিষ্কার। 

কলকাতা হাইকার্টের বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায় নবম-দশমে নিয়োগ দুর্নীতি মামলায় সিবিআইয়ের পাশাপাশি ইডিকেও যুক্ত করার নির্দেশ দিয়েছিলেন। আমাদের দেশের স্কুল-কলেজের গভর্নিং বডির সদস্যদের ভাগ বাটোয়ার খবর তার কাছে গেলে, আর তার কিছু করার থাকলে তিনি কাকে কাকে নির্দেশ দিতেন সেই ভাবনা মনে আসে। ভাবি আসলে কী আমাদের কেউ নেই যিনি এই প্রকাশ্য এই গোপন এই মিনিটে মিনিটে নিয়োগ, এই সবকিছুর অধপতনের স্রোত ঠেকিয়ে দেয়ার চেষ্টা করবেন। এটা করতে কী শুধু আদালতের বিচারপতিই হতে হবে। বলা হয়, পৃথিবীর সবচেয়ে সব আদালত মানুষের বিবেক। সেই আদালত কী কোথাও আর বসে না?
 

 

 

স্কুল-কলেজ শিক্ষকদের এপ্রিল মাসের এমপিওর চেক ছাড় - dainik shiksha স্কুল-কলেজ শিক্ষকদের এপ্রিল মাসের এমপিওর চেক ছাড় শ্রেষ্ঠ শিক্ষকের মানদণ্ড কী? - dainik shiksha শ্রেষ্ঠ শিক্ষকের মানদণ্ড কী? অবসর-কল্যাণে শিক্ষার্থীদের দেয়া টাকা জমার কড়া তাগিদ - dainik shiksha অবসর-কল্যাণে শিক্ষার্থীদের দেয়া টাকা জমার কড়া তাগিদ কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে সুপ্রিম কোর্টের ফতোয়ার রায় পাঠ্যপুস্তকে নিতে হবে - dainik shiksha সুপ্রিম কোর্টের ফতোয়ার রায় পাঠ্যপুস্তকে নিতে হবে সরকারি কলেজ মসজিদের ইমাম, মুয়াজ্জিন ও খাদিমের চাকরি জাতীয়করণ দাবি - dainik shiksha সরকারি কলেজ মসজিদের ইমাম, মুয়াজ্জিন ও খাদিমের চাকরি জাতীয়করণ দাবি শিক্ষকের বেতন ও শিক্ষার্থীদের ঝরে পড়া রোধে কাজ চলছে: শিক্ষামন্ত্রী - dainik shiksha শিক্ষকের বেতন ও শিক্ষার্থীদের ঝরে পড়া রোধে কাজ চলছে: শিক্ষামন্ত্রী বিএসসি মর্যাদার দাবিতে ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ারদের মাসব্যাপী কর্মসূচি - dainik shiksha বিএসসি মর্যাদার দাবিতে ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ারদের মাসব্যাপী কর্মসূচি please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0068240165710449