মানবাত্মার সঠিক বিকাশের প্রধান উপায় হল শিক্ষা লাভের মাধ্যমে জ্ঞান বৃদ্ধি করে নিজের সত্তা উপলব্ধির মধ্য দিয়ে জীবন সমস্যার সমাধানে দক্ষতা অর্জন করা। শিক্ষার মধ্য দিয়ে মানুষ সত্যকে উপলব্ধি, ধারণ ও লালন করতে পারে। সক্রেটিস বলেছেন, শিক্ষা হল মিথ্যার বিনাশ আর সত্যের বিকাশ। শিক্ষার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যই হল মানুষকে প্রকৃত মানুষ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা। শিক্ষা মানুষকে জ্ঞানের আলোয় প্রজ্বলিত করে, মানব আচরণের কাক্সিক্ষত পরিবর্তন ঘটায়।
চীনের বিপ্লবী নেতা মাও সেতুং বলেছিলেন, ‘তুমি যদি এক বছরের জন্য কোনো পরিকল্পনা করো তবে ধানের বীজ রোপণ করো, দশ বছরের জন্য হলে গাছ লাগাও আর সারা জীবনের জন্য হলে শিক্ষিত মানুষ তৈরি করো।’ শিক্ষা মানুষকে বাস্তববাদী, যুক্তিবাদী এবং অধিকার ও কর্তব্য সচেতন হিসেবে গড়ে তুলতে সহায়তা করে। মানুষ মূলত দেখে-শুনে, পড়ে, অনুকরণ-অনুসরণ এবং অভিজ্ঞতা অর্জনের মধ্য দিয়ে এই শিক্ষা লাভ করে।
আনুষ্ঠানিকভাবে শিক্ষা লাভের ক্ষেত্রে শিক্ষক সহায়তাকারীর ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়ে শিক্ষার্থীদের পথনির্দেশনা দিয়ে থাকেন। এ ক্ষেত্রে শিক্ষকের প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য। শিক্ষকরা হৃদয়বৃত্তিকে গুরুত্ব দিয়ে কেবল পঠন-পাঠন কার্যক্রমই পরিচালনা করেন না, তারা শিক্ষার্থীদের জ্ঞানার্জনের প্রতি আগ্রহী করে তোলেন, জ্ঞানার্জনে সহায়তা করেন, নৈতিকতা ও মূল্যবোধসম্পন্ন মানুষ হিসেবে গড়ে তোলেন। এ কারণেই পিতা-মাতার পরই শিক্ষকের মর্যাদা দেয়া হয়। শিক্ষকতাকে মহান পেশা হিসেবে অভিহিত করা হয়। যুগ যুগ ধরে তাই হয়ে আসছে।
এ দেশে শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে ভার্নাকুলার শিক্ষাব্যবস্থা প্রচলিত ছিল। গুরুগৃহ, টোল, মক্তব ও মাদ্রাসার মতো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান মূলত ধর্মের ওপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছিল। ধর্ম, রীতিনীতি, কৃষ্টি ও সংস্কৃতি, ভাষা, সমাজব্যবস্থা ইত্যাদি সম্পর্কে শিক্ষা দেয়া হতো। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ১৮১৩ সালে চার্টার অ্যাক্টের মাধ্যমে শিক্ষা খাতে সরকারিভাবে অর্থ বরাদ্দ দিয়ে শিক্ষা ক্ষেত্রে পরিবর্তন আনার চেষ্টা করলেও ১৮৩৫ সালে লর্ড উইলিয়াম বেন্টিক সর্বপ্রথম এ দেশের শিক্ষা সংস্কারের পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। শুরু হয়ে যায় কেরানি তৈরির প্রক্রিয়া।
বিভিন্ন ডেসপাচ ও কমিশন গঠন এবং বাস্তবায়নের মধ্য দিয়ে সেই প্রক্রিয়াকে ত্বরান্বিত করা হয়। সেই সঙ্গে শিক্ষক ও শিক্ষার্থী উভয়ের কাছেই অপার্থিব উদ্দেশ্যের পরিবর্তে পার্থিব চাওয়া-পাওয়া বড় হয়ে দেখা দিতে থাকে। ক্রমান্বয়ে সেই চাওয়া-পাওয়ার হিসাব-নিকাশ কতটা ভয়াবহ যে হতে পারে, তা বর্তমান সময়ের কিছু নৈতিকতাস্খলিত শিক্ষকের কর্মকাণ্ড দেখলে সহজেই উপলব্ধি করতে পারি। তবে এখনও অধিকাংশ শিক্ষকেরই নৈতিক অবস্থান দৃঢ়। তারা নিরলসভাবে আলোকিত তরুণ প্রজন্ম সৃষ্টি করার কাজ করে যাচ্ছেন। তাই যখন গুটিকয়েক নৈতিকতাবর্জিত শিক্ষকের জন্য সমগ্র শিক্ষক সমাজের আদর্শিক অবস্থানকে প্রশ্নবিদ্ধ করা হয়, তখন ভীষণ ব্যথিত হই।
একটা সময় ছিল যখন বিশ্বের অন্যান্য দেশের শিক্ষকদের মতো এ দেশের শিক্ষকরাও তাদের মননের পরিকর্ষণার উচ্চমানের কারণে জ্ঞানের সমগ্রতাকে ধারণ ও উপস্থাপনের মাধ্যেমে কেবল পাঠ্যক্রমের ব্যাখ্যাদাতা নন, দার্শনিক সিদ্ধান্তের প্রস্তাবক হিসেবে, আর্দশিক গুরু হিসেবে বিবেচিত হতেন। এখনও যে বিবেচিত হচ্ছেন না তা নয়। তবে এখন সেটা কমে গেছে। এটাই বাস্তবতা। এর কারণ, অনেক শিক্ষকই তাদের মূল লক্ষ্য থেকে সরে গেছেন, প্রাধান্য দিচ্ছেন বৈষয়িক চিন্তাকে; যা কাম্য নয়। আবার এই সমাজব্যবস্থায় যেভাবে শিক্ষকগণকে চাওয়া-পাওয়ার বাইরের বস্তু জগতের মানুষরূপে কল্পনা করা হয়ে থাকে তাও যৌক্তিক নয়। শিক্ষকগণ তপোবনবাসী কিংবা নির্জন ঋষী ব্রতী হবেন, কালের পরিক্রমায় এমন প্রত্যাশা ফুরিয়েছে বহু আগেই। আগের মতো শিক্ষকগণকে সমাজের বাইরের কেউ হিসেবে বিবেচনা করা তাই সমীচীন নয়। শিক্ষকগণ সমাজের বাসিন্দা, অন্য দশজন মানুষের মতো তারও জীবনযাপনের অধিকার আছে, চাহিদা আছে।
চাহিদার সঙ্গে প্রাপ্তির রফা না হলেই সৃষ্টি হয় সংঘর্ষ। এ কারণে আশরাফ সিদ্দিকী তার ‘তালেব মাস্টার’ কবিতায় লিখেছিলেন, আমি যেন সেই ভাগ্যাহত বাতিওয়ালা/ পথে পথে আলো দিয়ে বেড়াই/ কিন্তু নিজের জীবনেই অন্ধকার মালা। এমন পরিস্থিতি বহুকাল বিরাজ করছিল শিক্ষকগণের জীবনে। হতাশা, ক্ষোভ, দুঃখ-দুর্দশা নিয়েই তাদের শিক্ষার আলো ছড়াতে হয়েছিল। এমন পরিস্থিতির উন্নয়ন ঘটাতে পদক্ষেপ নিয়েছিলেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। কুদরত-ই-খুদা শিক্ষা কমিশন গঠনসহ তিনি শিক্ষার উন্নয়ন, শিক্ষকগণের মান-মর্যাদা এবং আর্থিক অবস্থার উন্নয়নের জন্য ব্যাপক পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিলেন। জাতির দুর্ভাগ্য যে, সপরিবারে বঙ্গবন্ধুর নৃশংস হত্যার পর সেই শিক্ষা কমিশন রিপোর্টের সুপারিশ বাস্তবায়ন না করে হিমাগারে পাঠিয়ে দেয় সামরিক এবং গণবিরোধী সরকার। ওই সময়গুলোতে শিক্ষাব্যবস্থায় কলুষিত রাজনীতির বীজ ঢুকিয়ে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের ভ্রান্ত পথের দিকে ধাবিত করার প্রয়াস আমরা যেমন দেখতে পেয়েছি, তেমনি প্রলোভনের ফাঁদে পড়ে অনেক শিক্ষক-শিক্ষার্থীকে লক্ষ্যচ্যুত হতেও দেখেছি।
কিন্তু দুঃখের সঙ্গে বলতে হয়, এখনও এ দেশের কিছুসংখ্যক শিক্ষক তাদের মূল লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য থেকে সরে আছেন, বৈষয়িক চিন্তায় মশগুল হয়ে শ্রেণীকক্ষে ঠিকমতো পাঠদান করার পরিবর্তে অর্থের পিছনে ছুটছেন। এই সরকার তাদের আর্থিক অবস্থার যথেষ্ট উন্নয়ন ঘটালেও তারা কোচিং বাণিজ্যসহ এ ধরনের বিভিন্ন কর্মকাণ্ড থেকে নিজেদের বিরত রাখছেন না। শিক্ষকদের মধ্যে অবশ্যই কমিটমেন্ট টু টিচিং থাকা খুবই জরুরি। কিন্তু কিছু শিক্ষকের কার্যক্রম দেখলে মনে হয় তাদের কমিটমেন্ট কেবল টাকা-পয়সা ও ক্ষমতা অর্জনের প্রতি। তবে এই ধরনের শিক্ষকের সংখ্যা বেশি নয়। যাদের টিচিং কমিটমেন্টে ঘাটতি রয়েছে তারা আসলে শিক্ষক হয়েছেন বাই চান্সে, বাই চয়েসে নয়; অনেকে আবার বিপুল পরিমাণ ডোনেশন দিয়ে কিংবা স্বজনপ্রীতি কিংবা রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে। মেধার পরিবর্তে ডোনেশনে বা অন্য অসাধু উপায়ে যখন অযোগ্য লোক শিক্ষকতার মতো পেশায় নিয়োগ পান তখন তার কাছ থেকে ভালো ফল আশা করা যায় না।
যার ফলে আমরা গণমাধ্যমে মাঝে মাঝে শিক্ষক কর্তৃক ছাত্রী নিপীড়ন, প্রশ্ন ফাঁস ও নকলে সহায়তা, মেধাহীনদের শিক্ষক হিসেবে নিয়োগে সহায়তাসহ বিভিন্ন নৈতিক স্খলনজনিত কর্মকাণ্ডের সংবাদ পাই যা পুরো শিক্ষক সমাজকেই লজ্জায় ফেলে দেয়, ভূ-লণ্ঠিত করে তাদের মর্যাদা। অথচ অধিকাংশ শিক্ষকই শিক্ষকতাকে মহৎ পেশা হিসেবে হৃদয়ে ধারণ করে শিক্ষার্থীদের মাঝে ছড়িয়ে যাচ্ছেন শিক্ষার আলো। সব শিক্ষকই এমন মনোভাবসম্পন্ন হবেন সেটাই আমাদের কাম্য। অনৈতিক কাজে জড়িয়ে পড়া শিক্ষকগণের বিরুদ্ধে এবং শিক্ষাক্ষেত্রে দুর্নীতির যে ডামাডোলের কথা আমরা প্রায়ই শুনি, সেসব বিষয়ে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ জোরদারকরণ, মেধা ও যোগ্যতার ভিত্তিতে শিক্ষক নিয়োগে তত্ত্বাবধান জোরদারকরণসহ শিক্ষকদের একাডেমিক প্রশিক্ষণের পাশাপাশি নৈতিকতা ও মূল্যবোধ সংক্রান্ত প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা জোরদারকরণ এখন সরকারের কাছে সময়ের দাবি। আর শিক্ষকগণের কাছে প্রত্যাশা স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনার ভিত্তিতে একটি ন্যায়ভিত্তিক, আধুনিক বিজ্ঞানসম্মত, অসাম্প্রদায়িক, বৈষম্যহীন শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে তোলার জন্য নিত্যনতুন জ্ঞান আহরণের মাধ্যমে এবং নৈতিক শক্তিতে বলীয়ান হয়ে শিক্ষণ-শিখন কার্যক্রমের মধ্য দিয়ে তারা গড়ে তুলবেন আলোকিত প্রজন্ম।
বাহালুল মজনুন চুন্নু : সিনেট ও সিন্ডিকেট সদস্য, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং সাবেক সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ ছাত্রলীগ
সূত্র: যুগান্তর