শিক্ষক হওয়ার জন্য চাই জ্ঞান ও গবেষণামুখী চিন্তা - দৈনিকশিক্ষা

শিক্ষক হওয়ার জন্য চাই জ্ঞান ও গবেষণামুখী চিন্তা

দৈনিকশিক্ষা ডেস্ক |

কিছুদিন আগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আমার এক সাবেক সহকর্মীর ফেসবুক পেজে তাঁর একটি পোস্ট দেখলাম। তিনি লিখেছেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় মেধাবী শিক্ষার্থীদের শিক্ষকতা পেশায় আকর্ষণে ব্যর্থ হচ্ছে। মেধাবীরা যাঁরা বিভিন্ন পরীক্ষায় মেধাতালিকায় ওপরের দিকে স্থান পেয়েছেন, তাঁরা শিক্ষকতায় না এসে বিভিন্ন ক্যাডারভিত্তিক সরকারি চাকরির দিকে ঝুঁকে পড়ছেন। এসব সরকারি চাকরি হাল আমলে বেশ লাভজনক, কেননা এর ফলে একদিকে যেমন ক্ষমতার কাছাকাছি থাকা যায়, তেমনি অতিরিক্ত আয়ের সুযোগ থাকে। নৈতিকতার বিবেচনায় এটা অনেকের কাছে গ্রহণযোগ্য না হলেও বৈষয়িক বিবেচনায় একে উপেক্ষা করার সুযোগ নেই। আমার সহকর্মীর আশঙ্কা, মেধাবীদের এই আচরণ এবং এর সঙ্গে রাজনৈতিক প্ররোচনা অদূর ভবিষ্যতে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থাকে ধ্বংসের দিকে নিয়ে যাবে। বুধবার (১৩ জানুয়ারি) প্রথম আলো পত্রিকায় প্রকাশিত এক নিবন্ধে  তথ্য জানা যায়। 

নিবন্ধে  আরও জানা যায়,  এই আশঙ্কার বাস্তবতা রয়েছে এবং আমাদের এ বিষয়ে গভীরভাবে ভাবা উচিত। তবে আমাদের বিষয়টি সামগ্রিক প্রেক্ষাপটে দেখতে এবং চিন্তা করতে হবে। আবার পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন ক্ষেত্রে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপের জন্য শুধু রাজনীতিকদের ঢালাও সমালোচনাও সমীচীন নয়। রাজনীতির মূল লক্ষ্য সমাজসেবা হলেও এখন এটি পেশা হিসেবে দাঁড়িয়ে গেছে। কিন্তু এই পেশা অন্যান্য পেশার মতো নয়। এ পেশায় সফলতা পেতে হলে অন্যান্য পেশার সাহায্য খুবই জরুরি, তাই রাজনীতি সব সময় সব পেশার লোকদের প্রভাবিত করতে চায়। আর এর জন্য রয়েছে বিভিন্ন স্বার্থ ও লোভের হাতছানি। এসব কারণে এখন প্রায় সব পেশার মানুষ রাজনীতিকদের সঙ্গে সখ্য গড়ে তুলতে ব্যস্ত। প্রশাসনিক কাজে যেহেতু রাজনৈতিক যোগাযোগ বেশি, তাই সবাই এখন সেই দিকেই ছুটছে। এরই ধারাবাহিকতায় মেধাবীরাও যদি সেই পথ ধরে, তবে তাদের কি খুব বেশি দোষ দেওয়া যায়? তবে এতে উচ্চশিক্ষা ধ্বংস হবে, তা-ও হয়তো ঠিক নয়।

প্রথমে আমাদের চিন্তা করা প্রয়োজন, শিক্ষক হওয়ার জন্য পরীক্ষায় প্রথম, দ্বিতীয় বা তৃতীয় হওয়া কি খুব জরুরি? না তা নয়। শিক্ষক হওয়ার জন্য চাই জ্ঞান ও গবেষণামুখী চিন্তা এবং শিক্ষকতা পেশাকে ভালোবাসা। মেধা জ্ঞানের জন্য প্রয়োজন হলেও অপরিহার্য নয়। মেধার প্রয়োজন যেমন উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে রয়েছে তেমনি এর চাহিদা রয়েছে অন্যান্য পেশার ক্ষেত্রেও। দেশের উন্নয়নের কথা বিবেচনা করলে মেধার প্রয়োজন রয়েছে সব ক্ষেত্রেই। পেশাগত জীবন শুরুর পর্যায়ে মেধার যেমন প্রয়োজন তেমনি পেশাগত জীবনে উন্নতির জন্য প্রয়োজন রয়েছে জ্ঞানের। তবে আমাদের মনে রাখতে হবে, জ্ঞান কোনো স্থির বিষয় নয়। এটা এমন নয় যে প্রাথমিক শিক্ষা থেকে উচ্চশিক্ষা পর্যন্ত প্রথম, দ্বিতীয় হলেই জ্ঞানী হওয়া যাবে। 

এটা ঠিক যে স্কুল-কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়ে আমরা তাত্ত্বিক জ্ঞান লাভ করি এবং এটা আমাদের কর্মজীবনে প্রায়োগিক জ্ঞানলাভকে সহজ করে। তাই তাত্ত্বিক জ্ঞান লাভের পর মেধাভিত্তিক অবস্থান যা-ই হোক না কেন, পেশাগত জীবনে চেষ্টা করলে পেশাভিত্তিক জ্ঞানের বিকাশ ঘটানো সম্ভব। এই পেশাভিত্তিক জ্ঞানই সমাজ ও দেশের উন্নয়নের চাবিকাঠি। কেউ যখন শিক্ষকতা পেশায় যোগ দেবেন, তখন পেশার প্রয়োজনে আরও পড়াশোনা করবেন, গবেষণা করবেন। এই নিয়মিত চর্চায় তাঁর জ্ঞানভান্ডার সমৃদ্ধ হবে এবং এর থেকে দেশ উপকৃত হবে।

আইনস্টাইন কিংবা রবিঠাকুর বা হালের কোনো বিজ্ঞানী বা উদ্যোক্তা সফল হয়েছেন তাঁদের প্রথম জীবনের অর্জিত মেধার মাধ্যমে নয় বরং বেছে নেওয়া পেশায় কঠিন মনোযোগ প্রয়োগের মাধ্যমে। দুঃখের বিষয় হচ্ছে, আমরা এই বিষয়টি বোঝার চেষ্টা করি না। আমি যখন শিক্ষক, তখন আমি সিনিয়র সচিবের পদমর্যাদা পাওয়ার স্বপ্ন দেখি, অথবা কোনো রাজনৈতিক দলের অঙ্গসংগঠনের সদস্য বা নেতা হতে চাই। আবার আমি যখন সচিব, তখন স্বপ্ন দেখি উচ্চশিক্ষার সনদ জোগাড়ের। কিন্তু একজন শিক্ষকের যেমন সচিবের পদমর্যাদা পাওয়ার আশা করা অর্থহীন, তেমনি সরকারি টাকায় সচিবের উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করা অনেক ক্ষেত্রে অপ্রয়োজনীয় এবং অর্থের অপচয়।

আমরা জানি, ক্ষমতার লোভ এবং ভবিষ্যৎকে নিশ্চিত করার জন্যই আমরা এসব দিকে মনোযোগ দিই। কিন্তু এই যে পরস্পরের সীমা আমরা অতিক্রম করতে চাই, এটা কি অপরাধ? না, তা হয়তো অপরাধ নয়, তবে অবশ্যই নৈতিকতার লঙ্ঘন। ক্ষমতা বা সম্পদের লোভ মানুষের চিরাচরিত প্রবৃত্তি। কিন্তু এই প্রবৃত্তির স্বেচ্ছাচার চলতে দেওয়া হলে তা পেশাদারত্বকে ক্ষুণ্ন ও সম্পদের বণ্টনের অসমতা তৈরি করবে। রাষ্ট্রযন্ত্র যেমন রাজনৈতিক প্রয়োজনে এই সীমা অতিক্রমকারীদের পৃষ্ঠপোষকতা করে, তেমনি রাষ্ট্রই পারে এই প্রবণতা রোধ করতে।

আমাদের দেশের সামাজিক সুরক্ষা ব্যবস্থা বেশ দুর্বল। তাই ব্যক্তিপর্যায়ে সম্পদ অর্জন ও তা জমা করার চেষ্টা ও প্রবণতা ব্যাপক। এই প্রবণতা রোধ করতে রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে সামাজিক সুরক্ষা ব্যবস্থা সুসংহত করা তাই খুবই জরুরি। এই ব্যবস্থা শুধু বিশেষ কিছু শ্রেণি বা পেশার লোকদের জন্য নয় বরং সব পেশার মানুষের জন্য করা দরকার। এটা নিশ্চিত করা গেলে বিশেষ কোনো পেশার প্রতি বাড়তি মোহ দূর হবে। পেশার চাহিদা পূরণ হবে পেশার প্রতি ব্যক্তির আগ্রহের ভিত্তিতে, আর্থিক লোভের কারণে নয়।

তবে সামাজিক সুরক্ষাই যে এর সমাধান দেবে তা নয়। মানুষের লোভ, চাওয়া বা আকাঙ্ক্ষার যেহেতু কোনো মাত্রা নেই, তা সামাজিক সুরক্ষা ব্যবস্থা অনেকের কাছে যথেষ্ট মনে না-ও হতে পারে। সে জন্য প্রয়োজন একটি অত্যন্ত কার্যকর অর্থনৈতিক ব্যবস্থা। ক্ষমতা হচ্ছে অবৈধ সম্পদ অর্জনের সহজ পথ। তাই কার্যকর নীতিনির্ধারণের মাধ্যমে যদি সেই অতিরিক্ত সম্পদের প্রান্তিক উপযোগ নিয়ন্ত্রণ করা যায়, তবে হয়তো আমরা নিজ পেশার গণ্ডি পার হওয়ার অযৌক্তিক উৎসাহ হারাব।

যা-ই হোক, ফিরে আসি আমার সেই সহকর্মীর কথায়। আমার সহকর্মী বিশ্ববিদ্যালয়ের ভবিষ্যৎ রক্ষায় রাজনীতিবিদদের নৈতিক সহযোগিতা কামনা করেছেন। আমরাও তা-ই আশা করি। কিন্তু নৈতিকতা আশা বা আদায় করার বস্তু নয়। ব্যক্তিপর্যায়ে নৈতিকতা আশা করা যায়, কিন্তু সাংগঠনিক, সামাজিক বা রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে নৈতিকতা আশা করা ঠিক নয়। নিয়মনীতি ও আইনের সমন্বয় থাকলেই অনেক কিছু নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। আমাদের প্রয়োজন যথাযথ নীতিনির্ধারণের মাধ্যমে কোনো বিশেষ কাজ বা পেশার অন্যায্য আকর্ষণকে সীমিত করা। সেটাই হবে যুক্তিসংগত ও দীর্ঘ মেয়াদে টেকসই। বর্তমান রাজনৈতিক নেতৃত্ব চাইলেই এই কাজটি করতে পারেন। রাজনৈতিক কারণে হয়তো বর্তমান নেতৃত্ব কিছু শ্রেণি বা পেশার প্রতি অতিরিক্ত যত্নশীল। কিন্তু রাজনৈতিক দর্শন যখন অকার্যকর হয় তখন অর্থনৈতিক দর্শন তার পরিপূরক হিসেবে কাজ করতে পারে।

লেখক : ড. মোশফিক উদ্দিন, যুক্তরাজ্যের লিডস বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক।

ভিকারুননিসায় ৩৬ ছাত্রী ভর্তিতে অভিনব জালিয়াতি - dainik shiksha ভিকারুননিসায় ৩৬ ছাত্রী ভর্তিতে অভিনব জালিয়াতি ‘চার আনা’ উৎসব ভাতা: প্রধানমন্ত্রী ও শিক্ষামন্ত্রী সমীপে - dainik shiksha ‘চার আনা’ উৎসব ভাতা: প্রধানমন্ত্রী ও শিক্ষামন্ত্রী সমীপে মাকে ভরণপোষণ না দেয়ায় শিক্ষক গ্রেফতার - dainik shiksha মাকে ভরণপোষণ না দেয়ায় শিক্ষক গ্রেফতার ছুটি না বাড়ালে বাড়ি যেতে হতে পারে ঈদের দিন - dainik shiksha ছুটি না বাড়ালে বাড়ি যেতে হতে পারে ঈদের দিন হাইস্কুলে কমেছে দশ লাখের বেশি শিক্ষার্থী - dainik shiksha হাইস্কুলে কমেছে দশ লাখের বেশি শিক্ষার্থী জালিয়াতি করে পদোন্নতি শিক্ষা ক্যাডার গ্যাঁড়াকলে - dainik shiksha জালিয়াতি করে পদোন্নতি শিক্ষা ক্যাডার গ্যাঁড়াকলে রুয়েটের সাবেক উপাচার্য-রেজিস্ট্রারের বিরুদ্ধে মামলা - dainik shiksha রুয়েটের সাবেক উপাচার্য-রেজিস্ট্রারের বিরুদ্ধে মামলা উপবৃত্তির জন্য সংখ্যালঘু কোটার তথ্য চেয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয় - dainik shiksha উপবৃত্তির জন্য সংখ্যালঘু কোটার তথ্য চেয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয় প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগে সতর্কীকরণ বিজ্ঞপ্তি - dainik shiksha প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগে সতর্কীকরণ বিজ্ঞপ্তি উপবৃত্তির জন্য সংখ্যালঘু কোটার তথ্য চেয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয় - dainik shiksha উপবৃত্তির জন্য সংখ্যালঘু কোটার তথ্য চেয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয় হাইস্কুলে কমেছে দশ লাখের বেশি শিক্ষার্থী - dainik shiksha হাইস্কুলে কমেছে দশ লাখের বেশি শিক্ষার্থী please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0036759376525879