ক্রমেই আঁটোসাটো হয়ে আসছে পৃথিবী। সাড়ে সাতশ’ কোটি মানুষই বলতে গেলে ঘরবন্দি। করোনাভাইরাসের (কোভিড-১৯) হানায় ব্যস্ত পৃথিবী স্তব্ধ এখন।
করোনা মোকাবেলায় ঘরবন্দির বিকল্প নাকি নেই । অন্তত যতদিন মানুষ তেমন কোন কার্যকর ওষুধ বা প্রতিষেধক খুঁজে না পাচ্ছে। ঘরবন্দি করেই করোনা আগ্রাসন রুখে দিয়েছে চীন, যেখানে এর শুরু। চীনের নিকট প্রতিবেশীরাও ঘরবন্দি করেই সাময়িকভাবে হলেও রুখে দিতে পেরেছে এই অতিমারি। হংকং, তাইওয়ান, দক্ষিণ কোরিয়ার সাফল্য এই ঘরবন্দি নিদানে। যেসব দেশ ঘরবন্দি করতে দেরি করেছে তাদের দিতে হচ্ছে কঠিন মূল্য। ইরান তো আছেই। ইউরোপের উন্নত, ধনী দেশগুলোও তার নিষ্ঠুর শিকার এখন। ইতালি, স্পেন, ফ্রান্স, জার্মানি, যুক্তরাজ্য সকল দেশেরই ত্রাহি অবস্থা। বাদ যাচ্ছে না সুইজারল্যান্ড, নরওয়ে, সুইডেনের মত উন্নত ও ধনী দেশ বা মহাপরাক্রমশালী যুক্তরাষ্ট্রও।
ইতালি, ইরান, স্পেন, ফ্রান্স, জার্মানি, যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র সবাই স্বীকার করছে, অতিমারি করোনার আগে আগে ছুটতে না পারলে মৃত্যুই পরিণতি। কিন্তু আমরা নির্বিকার। বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থাসহ সকলেই বারবার সতর্ক করে বলছে, দক্ষিণ এশিয়া করোনার প্রেতনৃত্যের অভয়ভূমি হতে যাচ্ছে। ‘আমরা পথ চেয়ে বসে আছি, ফাগুনেরও গান গেয়ে’।
চীনা সরকারের দাবি অনুযায়ী, তাদের দেশে করোনা প্রথম অজ্ঞাত রোগ হিসেবে ধরা পড়ে ৩১ ডিসেম্বর। তারপর প্রায় ৮০ দিনের বেশি কেটে গেছে। বাংলাদেশ নির্বিকার থেকেছে। এখনও কেউ জানে না, আমাদের ভবিষ্যৎ কী? মানুষের মাঝে আতংক আছে, অভয় দেবার কেউ নেই; পাশে দাঁড়ানোর কেউ নেই। দেশে রাজনীতি কার্যত অচল। যে কোন রাজনৈতিক তৎপরতার বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্সে নিরংকুশ জনপ্রিয় সরকার। ছাত্র সংগঠনগুলোর অবস্থাও একই। এমন কি সামাজিক ও সাংস্কৃতি্ক সংগঠনগুলোও যেন নির্জীব, অস্তিত্বহীন। আর্ত মানবতার সেবায় যাদের সব সময় সরব দেখেছি তাদের কারো দেখা নেই, কোন বক্তব্য নেই, কোন উদ্যোগ আয়োজন নেই! এমন বিমূঢ়তা আমরা আগে কখনও দেখি নি।
ভোগবাদী সমাজে সবাই হাত গুটিয়ে নিচ্ছে। ভাবখানা যেন, নিজে বাঁচলে বাপের নাম। সারা পৃথিবী আত্মগত জীবন নিয়ে ব্যস্ত। ব্যস্ত দিনগত পাপ ক্ষয়ে। একমাত্র কিউবা এগিয়ে এসেছে মানবতার আলো হাতে নিয়ে। আর্ত মানবতার ডাকে সাড়া দিয়ে তারাই ঘোষণা করেছে, পৃথিবীতে এখনও মানুষ আছে মানুষের জন্যই। দীর্ঘ একটা উদ্ধৃতি দিতে চাই, “সংক্রামক রোগ প্রতিরোধের জন্য বিশ্বমানবতার বিকল্প হয় না। এই প্রসঙ্গে সকলেরই কিউবার অতি সাম্প্রতিক ঘটনাটি হতে শিক্ষাগ্রহণ দরকার। ব্রিটেনের একটি জাহাজে ৭০০ জন যাত্রী ছিল। তাদের মধ্যে পাঁচজনের করোনা ভাইরাস সংক্রমণ হয়েছিল। আমেরিকা, বাহামা এবং বার্বাডোজের কোনো বন্দর জাহাজটিকে নোঙর করতে দেওয়া দূরের কথা তাদের বন্দর সীমার কাছাকাছিও ঘেঁষতে দেয়নি। কিউবা জাহাজটিকে শুধু ভিড়তেই দেয়নি, সাদর সম্ভাষণ জানিয়েছে। যাত্রীদের বন্দরেও নামতে দিয়েছে। প্রত্যেক যাত্রী প্রয়োজনীয় চিকিৎসাসেবা পেয়েছে। যাত্রীদের করোনা আশঙ্কামুক্তি নিশ্চিত হওয়ার পর ১৯ মার্চ জাহাজটি ব্রিটেনে ফিরে যাওয়ার যাত্রা শুরু করে দিয়েছে।
ঘটনাটি উল্লেখ করার কারণ কিউবা কর্তৃপক্ষ সারা বিশ্বে মানুষকে মনে করিয়ে দিয়েছে যে বিশ্বের প্রতিটি মানুষই স্বাস্থ্য-সুরক্ষার অধিকার রাখে। এই অধিকার স্থান-কাল-পাত্র-গোত্র-বর্ণনির্বিশেষে পৃথিবীর সব মানুষের বৈশ্বিক অধিকার। ভাইরাস যেহেতু পৃথিবীর কোনো সীমান্ত মানে না,আক্রান্ত ব্যক্তির চিকিৎসা পাওয়ার ক্ষেত্রে সীমান্ত কেন বাধা হয়ে উঠবে?” (হেলাল মহিউদ্দীন, প্রথম আলো, ২১ মার্চ, ২০২০)
মানুষ মহত্তম প্রাণী। আমরা লক্ষ্য করেছি ধস্ত সমাজবাদের অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে আসা চীন, (সাবেক) সোভিয়েত রাশিয়া, পূর্ব ইউরোপ, ভিয়েতনাম, কিউবা এই মহাসংকটকে অসীম মানবিক মূল্যবোধে উজ্জ্বীবিত হয়েই মোকাবেলা করতে পেরেছে। তাদের পাশে জ্বল জ্বল করছে তাইওয়ান, সিঙ্গাপুর ও দক্ষিণ কোরিয়ার নাম। ভুটানের ভূমিকাও প্রশংসনীয়।
বাংলাদেশের মত গরিব দেশে ঘরবন্দি করা একেই খুব কঠিন। ছোট্ট দেশে সতেরো কোটি মানুষ। গোটা দেশে মানুষ গিজগিজ করে। তাদের ৮০ ভাগ মানুষেরই কাজের নিশ্চয়তা নেই। দিন এনে দিন খাওয়াই তাদের নিয়তি। এই বিপুল সংখ্যক মানুষ কোথায়, কীভাবে নিজেদের ঘরবন্দি করবে? যদি বা তা সম্ভব, কী খাবে তারা? নিত্য সর্দি কাশিতেও কোথায় পাবে সামান্য চিকিৎসা সেবা?
না ঘরবন্দি মানুষ আমরা কেউই জানি না, আমরা কী খাব। আমাদের মহাপরাক্রমশালী মন্ত্রী প্রবর বলছেন, তারা নাকি করোনার চেয়ে শক্তিশালী, ক্ষমতাশালী। আল্লাহ তাদের সে শক্তি দান করে থাকলে আমরা খুসি হব। শুধু বলুন, আমরা কী খেয়ে বেঁচে থাকব?
প্রবল জনদাবির মুখে স্কুল কলেজ ছুটি ছুটি দেয়া হল। কিন্তু শিক্ষক, শিক্ষার্থী কোথায় কীভাবে সময় কাটাবে, কী করবে তার কোন নির্দেশনা নেই। মানুষকে ঘরবন্দি থাকার পরামর্শ দিচ্ছে সবাই। কিন্তু কেউ বলছে না, সেখানে নিত্যসেবা কীভাবে পৌঁছানো হবে? কে পৌঁছাবে? কীভাবে পৌঁছাবে? কীভাবে কোথায় জানাবে চাহিদার কথা?
দোকানপাট বন্ধ, নিত্যপণ্যের আকাল। দাম বাড়চ্ছে হু হু করে। দেখার কেউ নেই। গত কয়েকদিনে রাজধানী ঢাকায় অসুস্থ রোগীদের বিড়ম্বনা বেড়েছে। যানবাহনের স্বল্পতা, বেশি ভাড়া, যেতে অস্বীকৃত ইত্যাদি তো আছেই। অনেক প্রাইভেট হাসপাতাল বন্ধ, ডাক্তাররা রোগী দেখা বন্ধ করে দিয়েছেন। তাদের কথা, আমাদের স্বাস্থ্য নিরাপত্তা নেই। কাকে সেবা করব? কীভাবে সেবা করব? সরকারি অনেক হাসপাতালও নাকি অনেক রোগীই ভর্তি করছে না। এ্যাম্বুলেন্স করোনাসন্দেহে রোগী পরিবহণ করছে না। কারণ একটাই; নিরাপত্তা নেই। ড্রাইভার, সহকারী, ডাক্তার, নার্স কারো স্বাস্থ্য নিরাপত্তা নেই। শনাক্তকরণের সরঞ্জাম (কিট), চিকিৎসাকর্মীদের ব্যক্তিগত সুরক্ষা সরঞ্জামের (পিপিই) অভাব প্রকট। মাস্ক, গ্লাভস, স্যানিটাইজার, এমন কি হাত ধোবার সাবানেরও নাকি অভাব! কেন নেই? কার দায়িত্ব এ নিরাপত্তা দেবার? কেউ দায়িত্ব নিচ্ছে না। নার্সদের অবস্থা আরও খারাপ। বোঝাই যাচ্ছে করোনা করুণা না করলে কেউ কারোর সামান্য সহানুভূতিও আশা করতে পারবে না।
তবে কি আমাদের লাশ কাক-শকুনের ভোজেই লাগবে? কিন্তু বাংলাদেশে এখন মড়া খেয়ে পরিবেশ দূষণমুক্ত করা কাক-শকুনের বড় আকাল। আছে কিছু মানুষরূপী কাক-শকুনের পাল।
লেখক : আমিরুল আলম খান, সাবেক চেয়ারম্যান , যশোর মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ড