দীর্ঘ ১০ বছর ঝুলে থাকা শিক্ষা আইনের খসড়াটি গত ৫ জুলাই চূড়ান্ত করা হয়েছে বটে তবে কোচিং বাণিজ্যকে বৈধতা দিয়ে। শিক্ষামন্ত্রী ড. দিপু মনির সভাপতিত্বে ভার্চুয়াল বৈঠকে ছোটখাটে কিছু ভুল সংশোধন করে এই খসড়াটি চূড়ান্ত করা হয়েছে। যতো দ্রুত সম্ভব এটি গণমাধ্যমের সামনে উপস্থাপন করবেন শিক্ষামন্ত্রী। পুরো খসড়াটি গণমাধ্যমে এলে হয়তো আরও কিছু পরিবর্তন-পরিবর্ধন ও সংযোজনের পরামর্শ আসতে পারে। তবে সেগুলো আমলে নেয়া হবে কি না সে ব্যাপারে সন্দেহ রয়েছে। তার পূর্বেই হয়তো যেটি সংসদে উঠবে এবং সংখ্যাধিক্য ভোটে পাস হবে। কিন্তু আইনটি যেন পুনরায় বিতর্কিত না হয়ে উঠে সে বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে ভাবতে হবে। রোববার (২৬ জুলাই) সংবাদ পত্রিকায় প্রকাশিত এক নিবন্ধে এ তথ্য জানা যায়।
নিবন্ধে আরও জানা যায়।, শিক্ষা নিয়ে আন্দোলনের ইতিহাস, বিতর্ক, মতামত প্রায় অর্ধশত বছরের। এ জন্য ১৯৬২ থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত অন্ততপক্ষে ৭ বার শিক্ষানীতি প্রণয়ন ও পরিবর্তন করা হয়েছে। তারপরও বিতর্কের শেষ হয়নি। সর্বসম্মত না হলেও যুগোপযোগী শিক্ষানীতি প্রণয়নে ব্যর্থ হয়েছে শিক্ষা কমিশনগুলো। কমিশনগুলোর মূল লক্ষ্য যদি হতো সুস্থ শিক্ষার বিকাশ সাধন তাহলে কোনোভাবেই বাণিজ্যিকিকরণকে সুযোগ দেওয়া হতো না। কোচিং বাণিজ্য একটি বিশাল বাণিজ্য। সাবেক শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ বিভিন্ন অনুষ্ঠানে বলতেন প্রতি বছর সারা দেশে ৩২ হাজার কোটি টাকার কোচিং বাণিজ্য হয়। শুধু মুখে নয় কার্যক্ষেত্রেও তিনি কোচিং সেন্টারগুলোতে বড় ধরনের অভিযান চালান। ফলে কোচিং সেন্টারের মালিকরা বাড়িঘর ছেড়ে পালিয়ে বেড়িয়েছে। আজকে এ কোচিং বাণিজ্যকে বৈধতা দান সাবেক শিক্ষামন্ত্রীকে বিব্রত করেছে অবশ্যই। আর কোচিং সেন্টারের মালিকদের বিজয়ী করা হয়েছে। তাহলে এই আইনটি কি কোচিং বাণিজ্যের কাছে আত্মসমর্পণ করলো না?
শিক্ষা আন্দোলনের অন্যতম বিদগ্ধ নেতা সাবেক অধ্যক্ষ সাইদুর রহমান বলেন, কোচিং বাণিজ্য শিক্ষার সুস্থ ও সমান্তরাল বিকাশের অন্তরায়। যারা স্বচ্ছল পরিবারের সন্তান তাদের অভিভাবকরা টাকা ব্যয় করে কোচিংয়ে দিতে পারবেন কিন্তু সাধারণ গরিব ঘরের সন্তানরা বা তাদের অভিভাবকরা তা পারবেন না। এমনকি তারা শিক্ষার একটা স্তর পার হতে না হতেই লেখাপড়া বন্ধ করতে বাধ্য হবে, হচ্ছে এবং ইতিপূর্বেও হয়েছে। কোচিং বাণিজ্যকে যেভাবেই বৈধতা দেওয়া হোক না কেন (সকালে বা বিকেলে) আসলে শিক্ষাকে বাণিজ্যিকীকরণ করা হলো। তিনি স্পষ্টতই বলেন, এটি একদিকে রাজনৈতিক দেউলিয়াত্ব প্রমাণ করেছে এবং অন্যদিকে আমলাতন্ত্রের বিজয় হয়েছে। যে শিক্ষকরা কোন স্কুল বা কলেজের শিক্ষক তিনি একই সঙ্গে কোচিংয়ের শিক্ষক হলে তিনি কোচিংয়ের ছাত্রছাত্রীদের প্রতি অধিক মনোযোগ দিবেন কারণ সেখানে থাকছে তার অতিরিক্ত অর্থপ্রাপ্তি। আর তার নিজস্ব প্রতিষ্ঠানের বেতন তো তিনি পাবেনই। সুতরাং নিজ প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের প্রতি মনোযোগ দিলেও হবে না দিলেও হবে। অর্থাৎ ওই শিক্ষক তার পেশাদারিত্ব হারালেন। ব্যবসায়িক হয়ে গেলেন। অন্যদিকে ছাত্রছাত্রীরাও স্কুলের শিক্ষকের কাছে কোচিং করতে বেশি উৎসাহী হবে বিশেষ সুবিধা পাওয়ার আশায়। তাই এমনটা যদি হতো কোন স্কুল-কলেজের শিক্ষক কোচিংয়ে শিক্ষক হতে পারবেন না তাহলে অন্ততপক্ষে এসব শিক্ষকদের পেশাদারিত্বটা ঠিক থাকত। কোচিং সেন্টারে শিক্ষকতা করবেন শিক্ষিত বেকার যুবকরা। তাহলে একই সঙ্গে বেকারত্ব দূর হতো এবং তাদের কিছু অর্থপ্রাপ্তি হতো। কোচিং সেন্টার যেহেতু বৈধতা পেতে যাচ্ছে সেহেতু তারা ইচ্ছেমতো কোচিং ফি আদায় করবে সেক্ষেত্রেও লাগাম টানা দরকার এখনই এবং কোচিং সেন্টারে ছাত্রছাত্রীর সংখ্যাও নিয়ন্ত্রিত হতে হবে। সেগুলো যেন স্কুলে পরিণত না হয়।
শিক্ষা আন্দোলনের বিষয় তো শুধু কোচিং আর নোট গাইডের বিরুদ্ধে ছিল না। ছিল ক্যাডেট শিক্ষা, সেনাবাহিনী ও প্রশাসন পরিচালিত শিক্ষা, ইংরেজি ও অভিজাত শিক্ষা, সরকারি শিক্ষাকে একিভূত করা। কারণ এ সব শিক্ষা ব্যবস্থায় যে অর্থ ব্যয় করা হয় তার ৫ ভাগের একভাগও ব্যয় করা হয় না বেসরকারি শিক্ষা, কারিগরি শিক্ষা ও মাদরাসা শিক্ষায়। এ বৈষম্য খুবই উলঙ্গভাবে সমাজে বিদ্যমান। শুধু তাই নয় প্রায় দু’দশক ধরে বেসরকারি বিশ^বিদ্যালয়, মেডিকেল কলেজ, ইঞ্জিয়ারিং কলেজগুলো মোটা অঙ্কের অর্থ নিয়ে বিবিএ, এমবিএ, ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ার করে দেয়ার লাইসেন্স পেয়ে গেছে। অথচ এসব ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ারের চেয়ে অনেক বেশি মেধাসম্পন্ন ছাত্রছাত্রী শুধু অর্থাভাবে লেখা পড়াই বন্ধ করতে বাধ্য হচ্ছে। এসব বিষয়ের সুষ্ঠু সমাধান এই শিক্ষা আইনে আছে বলে মনে হয় না। সব সরকারের আমলেই ধনীদের শিক্ষার পক্ষেই কাজ করেছে। গরিবদের উচ্চশিক্ষার জন্য কোন ব্যবস্থাই গ্রহণ করেনি। এ ব্যবস্থা শুধু শিক্ষাঙ্গনেই নয়, সর্বত্রই। ক’দিন আগেই বলা হয়েছে উচ্চবিত্তের জন্য বিশেষ হাসপাতাল নির্মিত হবে। সেখানে গরিবদের কোন ঠাঁই হবে না। প্রমাণ করেছে চলমান সরকারি হাসপাতালগুলো উচ্চবিত্তের জন্য উপযোগী নয়। এমনকি উচ্চ শ্রেণীর জন্যও মসজিদে প্রথম কাতারের জায়গা ছেড়ে রাখতে হবে এমন কথাও উঠেছে। বৈষম্যের রূপ কতো ভয়াবহ তা খুব সহজেই অনুমান করা যায়।
শিক্ষা আইনে নোট গাইড বই থাকবে না বলেই জানা গেছে। কিন্তু খুবই সত্য কথা যে কোচিংয়ের সঙ্গে নোট গাইড বাণিজ্যের যোগসূত্র আছে। আর পড়াশোনার জন্য যদি বাণিজ্যিক কোচিংকেই উৎসাহিত করা হয় তবে স্কুল-কলেজের শিক্ষকদের কাজটা কি হবে? বলা হয় সৃজনশীল শিক্ষা ব্যবস্থায় নোট গাইড বইয়ের প্রয়োজন হয় না। আর দেশের প্রায় সব স্তরের মানুষ বিশিষ্ট নাগরিক, শিক্ষাবিদ, শিক্ষক অভিভাবক সবাই নোট গাইডের বিরুদ্ধে। তারাও শিক্ষার্থীদের সৃজনশীল শিক্ষার উপরই নির্ভরশীল করাতে চান। শিক্ষা প্রশাসনের কর্মকর্তারাও বলেন নোট, গাইড ও কোচিংয়ের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য কথা যে শিক্ষা কমিশনেও এই নোট গাইড ও কোচিং ব্যবসায়ীরা প্রভাবশালী লবিস্ট নিয়োগ করতে পেরেছে বলেই কোচিং বৈধতা পেয়েছে। শুধু তাই নয় ইতোমধ্যে তারা অভিভাবকদেরও বিভক্ত করতে পেরেছে। ফলে সচ্ছল অভিভাবকদের সমর্থন পেয়েছে। ইংরেজদের ডিভাইড অ্যান্ড রুল পদ্ধতিকে তারা ভালোভাবেই কাজে লাগিয়েছে। এরপর নোট গাইডের ব্যবসা পুষিয়ে নেয়ার মতো বুদ্ধি তাদের আছে। সেক্ষেত্রে প্রতি বছর নতুন নতুন সিলেবাস যুক্ত বই, একই বিষয়ে ডজন ডজন লেখকের অনুমোদনকৃত বই ছাপানোর সুযোগ তো থেকেই গেল। আর এ কাজে সহযোগিতা করার জন্য রয়েছে এনসিটিবি বা বোর্ড কর্তৃপক্ষ। সুতরাং নোট গাইড বই ছাপানোর প্রয়োজন পড়বে না। নোট গাইড বই ছাপানোর ক্ষেত্রে কিছুটা লুকোচুরি ছিল কিন্তু নতুন বই ছাপানোর ক্ষেত্রে সেটা থাকবে না। বরং সেটা হবে একেবারে বৈধ।
দুঃখের সঙ্গে বলতে হচ্ছে আমরা যে বই পড়েছি সেটাই পর্যায়ক্রমে পরবর্তী ছাত্ররা পড়েছে অন্ততপক্ষে ৩/৪ বছর। সিলেবাস পরিবর্তন করলেও ওই বই থেকেই করা হয়েছে। পরীক্ষা শেষে ওই বই আমার পরের ছাত্রদের কাছে বিক্রি করেছি অর্ধেক দামে। তখনো নতুন বই ছাপানো হয়েছে। কিন্তু সেটাও বর্ধিত ছাত্রসংখ্যা অনুযায়ী। আমার মনে হয় ১৯৭০ সাল পর্যন্ত এভাবেই চলেছে। তখন কি আমাদের মেধা কম ছিল বর্তমানকালের শিক্ষার্থীদের চেয়ে? আনুমানিক ১৯৭৫ সালের পর নোট বইয়ের সঙ্গে গাইড বইয়ের ব্যবসা শুরু হলো। সেই যে গাইড বইয়ের রমরমা ব্যবসা শুরু হলো তা বিস্তৃত হলো গাণিতিক হারে। সেই নোট গাইড বাণিজ্যের মধু খেলো বই ব্যবসায়ী বোর্ড কর্তৃপক্ষ, শিক্ষা বিভাগের কর্মকর্তা এবং বেশকিছু লেখক। এই ভয়ঙ্কর লোভ গ্রস করল পুরো শিক্ষা বিভাগকে। প্রায় একই সঙ্গে শুরু হয় কোচিং বাণিজ্য, যা আগে ছিল প্রাইভেট টিউশনি (ক্ষুদ্রকারে) ব্যক্তি পর্যায়ে। আর এখন সেটার পরিধি হয়েছে স্কুলের সমান এবং যৌথ ব্যবসা। সকাল থেকে রাত পর্যন্ত শিক্ষার্ধীদের এক কোচিং থেকে অন্য কোচিং নিয়ে যেতে ব্যস্ত থাকে অভিভাবকরা। আর শিক্ষার্থীরাও দিনরাত পুঁথিগত বিদ্যা নিয়ে এতো ব্যস্ত হয়ে পড়ে যে ঠিকমতো খাবারটাও খেতে পারে না আর বাইরের জগৎ ও জ্ঞান, খেলাধুলা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। আসলে কাজের কাজ কিছুই হয়নি। এদের টাকার প্রভাবে পুরো শিক্ষা ব্যবস্থাটাই নষ্ট হয়ে গেছে। শুধু ছাত্রছাত্রীরাই নয় শিক্ষকরা পর্যন্ত নোট গাইড বইয়ের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে। এর বড় কুফল হচ্ছে শিক্ষার্থীদের নিজস্ব মেধা থেকে কোন সৃষ্টিশীলতা বেরিয়ে আসবে না। নোট ও গাইডের বাণিজ্যে ভেসে যাবে।
এক সময় অভিভাবকসহ শিক্ষাবিদদের পক্ষ থেকে আওয়াজ উঠেছিল, প্রাথমিক শিশুদের বইয়ের ভার কমানো হোক। তাদের পড়ার জন্য এত বেশি বই ও গাইড নির্ধারণ করা হয়েছে যে সেগুলো তাদের কাছে বহনযোগ্য হয় না। প্রায়শই অভিভাবককে বহন করতে দেখা যায়। দাবি উঠেছিল শিক্ষার্থীর টিফিন ও বইসহ ব্যাগের ওজন যেন তার শরীরের ওজনের ১০ ভাগের এক ভাগ হয়। এ সমস্যার সমাধান আজও হয়নি। অন্যদিকে উচ্চ মাধ্যমিক শ্রেণীর কলা, বাণিজ্য ও বিজ্ঞান বিভাগের জন্য ইংরেজি ও বাংলা বইয়ের সংখ্যা ঠিক থাকলেও ওই ৩টি বিভাগের আরও ২০টি বিষয়ের ৪০টি পেপার আছে। যার প্রত্যেকটি পেপারের জন্য ১০/১৫ জন লেখকের লেখা বইয়ের অনুমোদন দিয়ে রেখেছে এনসিটিবি। শিক্ষকরা বলেন, এই বইগুলোর কোনটাই পূর্ণাঙ্গ নয়। কোথাও না কোথাও তথ্যের ঘাটতি আছে, ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের ভিন্নতা আছে। ফলে শিক্ষার্থীরা কোন বইটি পড়বে তা স্থির করতে পারে না। আর অভিভাবকরাও ১০/১৫টি করে বই কেনার ক্ষমতা রাখেন না। প্রশ্ন হচ্ছে এনসিটিবি নির্দিষ্ট একটি বা দুটি নির্দিষ্ট করে দিলেই তো পারে শিক্ষার্থীদের জন্য কিন্তু কেন তা করবেন? কারণ লেখকদের বইয়ের অনুমোদনের জন্য সেলামি পেয়ে থাকেন। সুতরাং শিক্ষার্থী ও অভিভাবকের কি সমস্যা হলো তা দেখার প্রয়োজন মনে করেন না। আমরাও তো উচ্চ মাধ্যমিকে পড়েছি। যে কোন পেপারের ১টি অথবা ২টির বেশি বই পড়িনি। অনেকে ১টা বই পড়েই পরীক্ষা দিয়েছে। ভালো ফল করেছে। এখন এত বইয়ের ভার দিয়ে এনসিটিবি কি শিক্ষার্থীদের বেশি মেধাবী বেশি বিদ্বান করতে পেরেছে, না তাদের বাণিজ্যিক সুবিধা হাসিল করেছে। এ বিষয়গুলো ভাববার ও সিদ্ধান্ত নেয়ার সময় এখনই। এই আইন পাশের আগেই।
লেখক : সামসুল ইসলাম টুকু, সাংবাদিক।