আবারো শিক্ষা ক্যাডার কর্মকর্তাদের ওপর চড়াও হয়েছেন রাজশাহী শিক্ষাবোর্ডের স্থায়ী কর্মচারীরা। চেয়ারম্যান, সচিবসহ গুরুত্বপূর্ণ পদগুলোতে বিসিএস সাধারণ শিক্ষা ক্যাডারভুক্ত সরকারি কলেজ শিক্ষকদের পদায়ন দেওয়ার হয়। কিন্তু অর্থ ও স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিষয়ে দ্বন্দ্ব দেখা দিলেই নিজস্ব কর্মচারীরা চড়াও হন শিক্ষা ক্যাডার কর্মকর্তাদের ওপর। কয়েক বছর আগে রাজশাহী শিক্ষা বোর্ডের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যে সংঘর্ষের সময় এক কর্মকর্তার নাক ফেটে গিয়েছিল। সেই ঘটনায় দোষীদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়নি কর্তৃপক্ষ। আবারও ঘটল এরকম অপ্রীতিকর ঘটনা।
দৈনিক শিক্ষার অনুসন্ধানে জানা যায়, অপ্রীতিকর ঘটনার পেছনে শিক্ষা ক্যাডার কর্মকর্তাদের মধ্যকার দ্বন্দ্ব ও একে অপরের বিরুদ্ধে কর্মচারীদের উসকানি দেওয়ার অভিযোগ দীর্ঘদিনের। আবার বছরে ছয়টা বোনাস, জিপিএ ফাইভ বিক্রি, নিম্নমানের স্কুল-কলেজকে পছন্দমতো পরীক্ষার সেন্টার দিয়ে আর্থিকভাবে লাভবান হওয়ার আশায় অনেক শিক্ষা ক্যাডার কর্মকর্তা শিক্ষা বোর্ডে পদায়ন চান। নিজস্ব কর্মচারীরা বোর্ডগুলোকে নিজেদের সম্পদ ভাবেন।
সম্প্রতি অফিসার্স কল্যাণ সমিতির কয়েকজন নেতা বোর্ড সচিব প্রফেসর ড. মোয়াজ্জেম হোসেনহ তিন কর্মকর্তাকে অবরুদ্ধ করে করেন। পরে বোর্ডের অন্য কর্মকর্তারা পুলিশ নিয়ে ঘটনাস্থলে গিয়ে তাদের উদ্ধার করেন। এ বিষয়ে অফিসার্স কল্যাণ সমিতির সাধারণ সম্পাদক ওয়ালিদ হোসেনসহ কয়েকজনের বিরুদ্ধে চেয়ারম্যান বরাবর লিখিত অভিযোগ দিয়েছেন ঘটনার শিকার তিন কর্মকর্তা।
রাজশাহী মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ডের একজন প্রেষণ কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, রোববার সন্ধ্যার আগে বোর্ড সচিব প্রফেসর ড. মোয়াজ্জেম হোসেন, হিসাব বিভাগের উপপরিচালক বাদশা হোসেনসহ তিন কর্মকর্তা সচিবের কক্ষে সংক্ষিপ্ত সভা করছিলেন।
এ সময় অফিসার্স কল্যাণ সমিতির সাধারণ সম্পাদক ওয়ালিদ হোসেন, মানিক চন্দ্র সেনসহ কয়েকজন কর্মকর্তা জোর করে সচিবের কক্ষে প্রবেশ করেন। অফিসার্স সমিতির নেতারা প্রথমে হিসাব বিভাগের উপপরিচালক বাদশা হোসেনের ওপর চড়াও হন-এই অভিযোগে যে, তিনি (বাদশা হোসেন) কয়েকজন কর্মকর্তার সার্ভিস ফাইলের কাগজপত্র গোপনে ফটোকপি করেছেন।
এ নিয়ে কর্মকর্তাদের সঙ্গে কল্যাণ সমিতির কর্মকর্তাদের চরম বাগ্বিতণ্ডা হয়। একপর্যায়ে কল্যাণ সমিতির নেতারা সচিবসহ তিন কর্মকর্তাকে টেনে-হিঁচড়ে শারীরিকভাবে হেনস্তা করেন। তাদেরকে ভবনের ওপর থেকে নিচে নিক্ষেপ করার জন্য দরজা খুলে দপ্তরের বাইরে নেওয়ার চেষ্টা চালায়। খবর পেয়ে অন্য কর্মকর্তারা ঘটনাস্থলে পুলিশ নিয়ে গিয়ে সচিবসহ তিন কর্মকর্তাকে উদ্ধার করেন।
অভিযোগ সম্পর্কে জানতে চাইলে অফিসার্স কল্যাণ সমিতির সাধারণ সম্পাদক ওয়ালিদ হোসেন সাংবাদিকদের বলেন, আমরা কোনো কিছুই করিনি। বরং সচিব সাহেব ও হিসাব বিভাগের ডিডি তার কক্ষে আমাদেরকে আটকে রেখে মারধর করেন। অকথ্য ভাষায় গালাগাল দিয়েছেন। আমরা প্রতিবাদ করেছিলাম মাত্র। আমরাও সচিবের বিরুদ্ধে বোর্ড চেয়ারম্যানের কাছে লিখিত অভিযোগ দিয়ে প্রতিকার চেয়েছি।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বোর্ডের আরেক কর্মকর্তা বলেন, রাজশাহীসহ সব শিক্ষা বোর্ড অভিন্ন আইন ও অ্যাক্টের মাধ্যমে পরিচালিত হয়। কিছু কর্মকর্তা দুই-তিন বছরের জন্য প্রেষণে আসেন বিভিন্ন সরকারি কলেজের শিক্ষকতা থেকে। আর বোর্ডের নিজস্ব কর্মকর্তারা তৃতীয় শ্রেণির কর্মচারী থেকে পদোন্নতি নিয়ে বিভিন্ন গ্রেডের অফিসার হন। বোর্ডের প্রেষণ ও নিজস্ব কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যে এ নিয়ে চলমান দ্বন্দ্ব রাজশাহী শিক্ষা বোর্ডে দীর্ঘদিনের।
সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা আরও জানান, রাজশাহী শিক্ষা বোর্ডে চেয়ারম্যানসহ আছেন মাত্র ৬ জন। নিজস্ব কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বাধাসহ নানা প্রতিবন্ধকতার কারণে রাজশাহী শিক্ষা বোর্ডে আসা প্রেষণ কর্মকর্তারা মাঝেমাধ্যে নিজস্ব কর্মকর্তা-কর্মচারীদের হাতে হেনস্তার শিকার হন। কোনো প্রতিকার হয় না বলে এখানে তারা (নিজস্ব কর্মকর্তা-কর্মচারী) অনিয়ম-দুর্নীতির রাজত্ব কায়েম রেখেছেন। তাদের কারণে প্রেষণ কর্মকর্তারা কোনো কাজই ঠিকমতো করতে পারেন না।
জানা যায়, রাজশাহী শিক্ষা বোর্ডের আইনানুযায়ী বোর্ডের নিজস্ব কর্মকর্তা-কর্মচারীরা উচ্চপদে পদোন্নতির মাধ্যমে জাতীয় বেতন স্কেলের সর্বোচ্চ সপ্তম গ্রেড পর্যন্ত বেতন স্কেল পেতে পারেন। কিন্তু কয়েক বছর আগে দায়িত্বে থাকা একজন বোর্ড চেয়ারম্যান ৯ জন কর্মচারীকে বিভিন্ন উচ্চপদে পদোন্নতি দিয়ে ষষ্ঠ বেতন স্কেল প্রদান করেন।
এদিকে বর্তমান বোর্ড চেয়ারম্যান প্রফেসর ড. মোকবুল হোসেনও ৬ জন নিজস্ব কর্মচারীকে পদোন্নতি দিয়েছেন। তাদের উচ্চ গ্রেডের বেতন স্কেল অনুমোদন না করে আটকে রেখেছেন শিক্ষা ক্যাডারেরই কর্মকর্তা ও বোর্ড সচিব। এ নিয়েই মূলত বোর্ড সচিব প্রফেসর ড. মোয়াজ্জেম হোসেন ও হিসাব বিভাগের উপপরিচালকের সঙ্গে কল্যাণ সমিতির নেতাদের দ্বন্দ্ব চলে আসছে। সর্বশেষ গত রোববার সন্ধ্যায় সার্ভিস বুকের কাগজ ফটোকপির অজুহাত তুলে প্রেষণ কর্মকর্তাদের ওপর চড়াও হন কল্যাণ সমিতির নেতারা।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে রাজশাহী শিক্ষা বোর্ডের সচিব প্রফেসর ড. মোয়াজ্জেম হোসেন বলেন, ওইদিন খুব খারাপ ঘটনা ঘটেছে আমাদের সঙ্গে। এ বিষয়ে চেয়ারম্যানকে লিখিতভাবে অভিযোগ দিয়েছি। চেয়ারম্যান এর প্রতিকার করবেন বলে আশা করি।