প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও সাধারণ শিক্ষায় চলমান তিনটি সার্ভিস এবং শিক্ষা সংক্রান্ত সব শ্রেণির শিক্ষক ও অশিক্ষক কর্মকর্তাদের নিয়ে বিসিএস সাধারণ শিক্ষা ক্যাডার গঠিত। সরকারি কলেজের শিক্ষকরা এই ক্যাডারের মূল স্রোতধারা হলেও এন্ট্রি লেভেলে আরও কয়েকটি পদের কর্মকর্তা যেমন- সরকারি হাই স্কুলের প্রধান শিক্ষক, বিদ্যালয় পরিদর্শক, জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা, প্রাইমারি ট্রেনিং ইনস্টিটিউটের সুপার ইত্যাদি এই তালিকার অন্তর্ভুক্ত। আমাদের দেশে শিক্ষা সংক্রান্ত বিভিন্ন দপ্তর ও প্রকল্প থেকে বিসিএস সাধারণ শিক্ষা ক্যাডারের কর্মকর্তাদের পরিবর্তে প্রশাসন ক্যাডার কর্মকর্তাদের শিক্ষা প্রশাসনে অগ্রাধিকার দেয়া হয়ে থাকে। এটি কতোটা যুক্তিযুক্ত তা' আমার বোধগম্য নয়। প্রশাসন ক্যাডার কর্মকর্তারা শিক্ষা ব্যবস্থাপনার আগা-মাথা কতোটুকু বুঝেন, কে জানে?
শিক্ষক ও শিক্ষা বিশেষজ্ঞরা শিক্ষা প্রশাসনের শীর্ষ পদগুলোতে থাকবেন- এটিই স্বাভাবিক। এতে শিক্ষার বিকাশ যেমন ত্বরান্বিত হয়, তেমনি শিক্ষা ব্যবস্থাপনায় স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা প্রতিষ্ঠিত হওয়ার গ্যারান্টি থাকে। শিক্ষার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সবাই, বিশেষ করে শিক্ষক সমাজ যথাযথ সেবা ও উপকার পেয়ে থাকেন। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান দেশ স্বাধীন হওয়ার পরে এই সত্যটি উপলব্ধি করেছিলেন। এই ধারণাকে প্রাতিষ্ঠানিক ভিত্তি দিতে গিয়ে অধ্যাপক কবির চৌধুরীকে তিনি শিক্ষা সচিব নিয়োগ করেন। পরবর্তীতে খসড়া জাতীয় শিক্ষা নীতিগুলোর বিভিন্ন স্তরে শিক্ষা ক্যাডারের সর্বোচ্চ প্রশাসনিক পদগুলোতে শিক্ষক ও শিক্ষা বিশেষজ্ঞ ব্যক্তিদের নিয়োগের বিষয়টি স্বীকৃত হলেও চুড়ান্ত নীতিমালায় তা কেন জানি অদৃশ্য থেকে যায়। এতে অন্যান্য ক্যাডারের অশিক্ষক কর্মকর্তাদের শিক্ষা প্রশাসনের শীর্ষ পদ দখলের সুযোগ সৃষ্টি হয়।
শিক্ষা বিষয়ক দেশের একমাত্র জাতীয় পত্রিকা দৈনিক আমাদের বার্তার সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদনে জানা যায়, উচ্চ ডিগ্রিধারী বেসরকারি কলেজ শিক্ষকদের সরকারি কলেজে চাকরির সুযোগ তৈরি করার জন্য বঙ্গবন্ধু ১৯৭২ খ্রিষ্টাব্দে বিসিএস সাধারণ শিক্ষা ক্যাডারে ২০ শতাংশ কোটা প্রবর্তন করেছিলেন। তিনি চেয়েছিলেন, মেধাবী ও যোগ্য বেসরকারি শিক্ষকরাও যেন শিক্ষা ক্যাডারে অন্তর্ভুক্ত হয়ে তাদের মেধা এবং প্রজ্ঞা দিয়ে দেশ ও জাতির সেবা করতে পারেন। তাঁরাও যেন এক সময় শিক্ষা প্রশাসনের শীর্ষ পদে আসীন হতে পারেন। শিক্ষায় বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনতে সহায়তা করতে পারেন। কিন্তু পরবর্তীতে জিয়াউর রহমান ও এরশাদ সরকারের শাসন আমলে তা কমিয়ে ১০ শতাংশ করা হয়। যা এখনো চলমান আছে। ফলে তাতে বেসরকারি কলেজের যোগ্যতা সম্পন্ন শিক্ষকদের সরকারি কলেজ তথা বিসিএস সাধারণ শিক্ষা ক্যাডারে অন্তর্ভুক্ত হওয়ার পথ সংকুচিত হয়ে পড়ে। এমনকি এক রকম বন্ধ হয়ে যায়। সরকারি কলেজের শিক্ষকরা ১০ শতাংশ কোটার সুযোগ গ্রহণ করতে পারতেন। বর্তমানে বেসরকারি শিক্ষকদের এই সুযোগ গ্রহণের অবকাশ নেই বললেই চলে। এ কোটায় নিয়োগ পাওয়া একজন মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালকও হয়েছিলেন। এরকম উদাহরণ আর জানা নেই। যাদের ভালো শিক্ষাগত যোগ্যতা যেমন, এমফিল, পিএইচডি ডিগ্রি, সব পরীক্ষায় ফার্স্ট ক্লাস অথবা প্রকাশনা থাকে তারাই কোটায় আবেদন করার যোগ্য বলে বিবেচিত হন।
বেসরকারি স্কুল-কলেজে অনেক মেধাবী ও প্রতিভাবান শিক্ষক আছেন, যারা সরকারি স্কুল-কলেজের শিক্ষকদের চেয়ে কোন অংশে কম নন। তাদের অনেকের এমফিল ও পিএইচডি ডিগ্রি আছে। সব পরীক্ষায় ফার্স্ট ক্লাস আছে। এক বা একাধিক প্রকাশনা রয়েছে। অথচ জাতির জনক প্রবর্তিত ২০ শতাংশ কোটায় নিয়োগ বন্ধ থাকায় দেশ ও জাতি এসব মেধাবীদের সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। অধিকন্তু যে ১০ শতাংশ কোটা চলমান আছে, তার একচেটিয়া সুযোগ নিচ্ছেন কেউ কেউ। যাচাই করলে দেখা যাবে, অনেকে মামুর জোরে সব যোগ্যতা পুরণ না করেও পদ বাগিয়ে নিয়েছেন। অথবা রাজনৈতিক পরিচয়ে কম যোগ্যতাসম্পন্নরা এসব শীর্ষ পদ দখল করে বসেছেন। রাজনৈতিক বিবেচনায় আজকাল আমাদের বিশ্ববিদ্যলয়গুলো ভিসিরাও নিয়োগ পেয়ে থাকেন। এভাবে শিক্ষা প্রশাসনের বিভিন্ন পর্যায়ে মামুর জোর এবং রাজনৈতিক বিবেচনা সব যোগ্যতাকে পেছনে ফেলে দিচ্ছে। এর ফলে শিক্ষা ব্যবস্থাপনা নানাভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। শিক্ষা থেকে জাতি কাঙ্ক্ষিত ফল পাচ্ছে না।
শিক্ষার রন্ধ্রে রন্ধ্রে অনিয়ম ও দুর্নীতি প্রবেশ করছে। শিক্ষা প্রশাসনের শীর্ষপদ যেমন মহাপরিচালক, পরিচালক, আঞ্চলিক পরিচালক, উপ-পরিচালক, শিক্ষাবোর্ডের চেয়ারম্যান, সচিব, পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক ইত্যাদি পদে কর্মরতরা বিভিন্ন সময়ে দুর্নীতিতে রেকর্ড রচনা করে চলেছেন। তাদের অনেকের বিরুদ্ধে বিস্তর অনিয়মের অভিযোগ। এদের লাগামহীন দুর্নীতি টেনে ধরার সাধ্য কারো নেই। শোনা যায়, বিএনপি শাসনামলে প্রবর্তিত ১০ শতাংশ কোটায় নিয়োগ পেয়ে সদ্য অবসরে যাওয়া মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তরের জনৈক মহাপরিচালক দুর্নীতি ও অনিয়মের পাহাড় গড়ে তুলেছিলেন। শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও অধিদপ্তরের অনেক পরিচালক, এমনকি তাদের ড্রাইভার-পিয়নরা পর্যন্ত সহজে টাকার কুমির বনে যান। অনেকে বিদেশের ব্যাংকে টাকা রাখেন, এমনকি বিদেশে বাড়ি-ঘর কেনেন। এজন্য শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে শুরু করে অধিদপ্তর, আঞ্চলিক কার্যালয়, জেলা শিক্ষা অফিস, শিক্ষাবোর্ড ইত্যাদি জায়গায় পদায়ন পেতে অনেকে মরিয়া হয়ে উঠেন। নিজের শিক্ষক পরিচয়ের আড়ালে কর্মকর্তা সেজে শিক্ষা ও শিক্ষক বিরোধী কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়েন। অনেকেই বাকি জীবনে আর কোনদিন শিক্ষকতায় ফিরে যেতে চান না। দুর্নীতির পাহাড় তৈরি করে অবশেষে অবসরে যান। কেউ কেউ আবার চাকরির বয়স শেষ হলে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ পাওয়ার প্রয়াস চালান। এরাই স্কুল-কলেজে প্রধান শিক্ষক বা অধ্যক্ষের অবসরের পর চুক্তিভিত্তিক নিয়োগকে অবৈধ বলে সার্কুলার জারি করেন।
জাতির জনক প্রবর্তিত বিসিএস সাধারণ শিক্ষা ক্যাডারে ২০ শতাংশ কোটা বাতিল করে বিএনপি সরকারের আমলে প্রবর্তিত ১০ শতাংশ কোটার সুযোগ নিয়ে যারাই শিক্ষা প্রশাসনের বিভিন্ন স্তরে আসীন হয়েছেন, তাদের বেশিরভাগ দুর্নীতিতে রেকর্ড সৃষ্টি করেছেন। মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তর, বিভিন্ন শিক্ষাবোর্ড, অধিদপ্তরের বিভিন্ন আঞ্চলিক কার্যালয়গুলোতে কত রকমের ঘুষ ও দুর্নীতি হয়, তার খবর অনেকে জানেন না।
দেশের শিক্ষা বিষয়ক একমাত্র ডিজিটাল পত্রিকা দৈনিক শিক্ষাডটকম এবং শিক্ষা বিষয়ক জাতীয় প্রিন্ট পত্রিকা আমাদের বার্তার অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে মাঝে মাঝে এসব অনিয়ম ও দুর্নীতির খবর বেরিয়ে আসে। সম্প্রতি দৈনিক আমাদের বার্তা ও দৈনিক শিক্ষাডটকমে এরকম একটি প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, জাতির জনক প্রবর্তিত শিক্ষা প্রশাসনে ২০ শতাংশ কোটায় গত ১৪ বছর যাবত কোনো নিয়োগ দেয়া হয়নি। এটি একটি দুঃখজনক বিষয়। যে কয়েকজন বা যারা নিয়োগ পেয়েছেন, তাদের বেশিরভাগই ১০ শতাংশ কোটায় নিয়োগ লাভ করা সরকারি কলেজের শিক্ষক। এরা আর কোনদিন শিক্ষকতায় ফিরে যাবেন বলে মনে হয় না। এসব পদে বসে তারা কেবলই শিক্ষকদের নানাভাবে হয়রানির পাঁয়তারা করেন। বিশেষ করে বেসরকারি শিক্ষকরা তাদের কাছে সময়ে সময়ে বলির পাঁঠা হয়ে থাকেন। এসবের প্রতিবাদ করার সাহস কারো নেই। কোনো শিক্ষক প্রতিবাদ করতে গেলে তাকে চাকরি হারাতে হয়। নানাভাবে হয়রানির শিকার হতে হয়। শিক্ষা প্রশাসনের দুর্নীতি এখন ওপেন সিক্রেট। এজন্য আমাদের দেশে সরকারের সবচেয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত খাতগুলোর মধ্যে শিক্ষা খাত শীর্ষে অবস্থান করছে।
দেশে বহু শিক্ষক সংগঠন আছে। শিক্ষক নেতাও অনেক। কিন্তু শিক্ষা প্রশাসনে ঘুষ, দুর্নীতির বিরুদ্ধে এতোটুকু সোচ্চার হতে কাউকে দেখিনা।
দীর্ঘ প্রায় তিনযুগের শিক্ষকতা জীবনে শিক্ষা প্রশাসনের বিভিন্ন স্তরে নানা অনিয়ম ও দুর্নীতি প্রত্যক্ষ করেছি। অনেক ভুক্তভোগী শিক্ষক-কর্মচারী বিভিন্ন অনিয়ম ও দুর্নীতির কথা বলেছেন। উপজেলা শিক্ষা অফিস থেকে মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তর পর্যন্ত ঘাটে ঘাটে শিক্ষকরা কতো যে হয়রানির শিকার হন, তা অনেকেই মুখ খুলে বলেন না। আমি ঢালাওভাবে সব জায়গার কথা বলি না। তবে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে এই বীভৎস অবস্থা! কোনো কোনো শিক্ষাবোর্ড দুর্নীতির আখড়ায় পরিণত হয়ে আছে। শিক্ষা বোর্ড থেকে কমিটি অনুমোদন করে আনতে টাকা লাগে। পাঠদানের অনুমতি ও স্বীকৃতিতে টাকা লাগে। বিভাগ কিংবা শ্রেণি শাখা খুলতে টাকা দিতে হয়। সার্টিফিকেটে নিজের নাম, বাবা-মায়ের নাম, জন্ম-তারিখ ইত্যাদি সংশোধনে টাকা লাগে। টাকা না দিলে পরীক্ষক হওয়া যায় না। টাকার বিনিময়ে নিজের বিষয় ছাড়া অন্য যে কোনো বিষয়ের প্রধান পরীক্ষকও হওয়া যায়। সব জায়গায় টাকার খেলা। টাকা ছাড়া কিচ্ছু হয়না। কোনো কোনো জেলা শিক্ষা অফিসে নিয়োগের জন্য ডিজির প্রতিনিধি আনতে গেলেও টাকা দিতে হয়। নিয়োগের অনলাইন ফাইল ডিডি অফিসে ফরওয়ার্ডিং করাতে টাকা লাগে। এখন এমপিওভুক্তির সব এখতিয়ার ডিডি অফিসের। তাই সেখানে বড় অংকের টাকা দিতে হয়। সৃষ্ট পদ কিংবা নতুন শ্রেণি শাখা পদে নিয়োগকৃত শিক্ষকের এমপিএভুক্তিতে কোনো কোনো ডিডি অফিস লাখ টাকার ওপরে চেয়ে বসে। মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তরের দুর্নীতির কথা আজ না হয় না-ই বললাম। অন্য আরেকদিন লিখবো। এসব ক্ষেত্রে সাধারণ শিক্ষকরা কত যে অসহায়, সে কেবল ভুক্তভোগীরাই জানেন।
আমরা চাই, শিক্ষা প্রশাসনের সর্বস্তরে শিক্ষক ও শিক্ষায় বিশেষজ্ঞ ব্যক্তিরা আসীন হোন। কেবল শিক্ষা অধিদপ্তরের ডিজি পর্যন্ত নন, শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সচিব ও শিক্ষাবিদরা অগ্রাধিকার পান। বিসিএস সাধারণ শিক্ষায় জাতির জনক প্রবর্তিত ২০ শতাংশ কোটার যথাযথ বাস্তবাযন করা সময়ের একান্ত দাবি। বেসরকারি শিক্ষকদের মধ্যে যাদের যোগ্যতা আছে, তাঁদের জাতির জনক প্রবর্তিত ২০ শতাংশ কোটায় বিসিএস সাধারণ শিক্ষা ক্যাডারে অন্তর্ভুক্ত হয়ে শিক্ষা প্রশাসনের বিভিন্ন পদে আসীন হওয়ার অবারিত সুযোগ দেয়া হোক। বিশ্ব মানের শিক্ষার জন্য একটি সৎ, দক্ষ, চৌকস ও মেধাবী এবং শিক্ষা ও শিক্ষক বান্ধব শিক্ষা প্রশাসন গড়ে তোলা এখন একান্ত অপরিহার্য।
লেখক : প্রাক্তন অধ্যক্ষ, চরিপাড়া উচ্চ বিদ্যালয় ও কলেজ, কানাইঘাট, সিলেট এবং যুক্তরাজ্যে অবস্থানরত দৈনিক শিক্ষা ও আমাদের বার্তার আবাসিক সম্পাদক।