শিক্ষা নামের রেলগাড়িটা কত পথ পাড়ি দিল? - দৈনিকশিক্ষা

শিক্ষা নামের রেলগাড়িটা কত পথ পাড়ি দিল?

দৈনিকশিক্ষা ডেস্ক |

গত ৩০ বছরে যে আবেগ আর উৎসাহ নিয়ে দেশের আনাচে-কানাচের কলেজে ‘মহাসমারোহে’ অনার্স কোর্স চালু করা হয়েছে, এখন বোধকরি তা আর নেই। সর্বশেষ পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত সারা দেশের আনুমানিক ২২৫০টি ডিগ্রি কলেজের মধ্যে ৮৮০টি কলেজে অন্তত ৩০টি বিষয়ে অনার্স কোর্স চালু আছে। এর মধ্যে মাস্টার্স চালু আছে ১৭০টি কলেজে।

এ পর্যন্ত ডামাডোলের মধ্য দিয়ে কোনোরকমে চলে এলেও এবার ২০২১-২২ শিক্ষাবর্ষে প্রথমবর্ষ অনার্স ভর্তির হালহকিকত দেখে শিক্ষার্থী-শিক্ষক ও অভিভাবকসহ সচেতন মহলে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা দেখা দিয়েছে। শনিবার (৩০ জুলাই) যুগান্তর পত্রিকায় প্রকাশিত এক নিবন্ধে এ তথ্য জানা যায়। 

নিবন্ধে আরও জানা যায় জেলা সদর এবং উপজেলা পর্যায়ের খ্যাতনামা কলেজগুলো যেমনই হোক, যেখানে-সেখানে অনার্স চালু করা কলেজগুলোতে চরমভাবে শিক্ষার্থীসংকট অনুভূত হচ্ছে। ২০ জুলাই ছিল অনার্স প্রথমবর্ষের ওরিয়েন্টেশন ক্লাস। এ উপলক্ষ্যে কলেজে কলেজে, বিশেষ করে বিভাগে বিভাগে বেশ ঘটা করে অনুষ্ঠান করার রেওয়াজ রয়েছে। ফুলের পাপড়ি ছিটিয়ে, রজনীগন্ধার স্টিক, কলম, ডায়েরি, ফাইল এমন নানা কিছু দিয়ে নবীন ছাত্রছাত্রীদের বরণ করে নেওয়া হয়।

প্রতিষ্ঠান বিশেষে থাকে আলোচনা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। কিন্তু শিক্ষার্থীসংখ্যার স্বল্পতার কারণে এবার অনেক কলেজেই এ অনুষ্ঠান হয়নি বলে জানা যায়। বিভাগভিত্তিক তিনজন, পাঁচজন, দশজন এভাবে ভর্তি হওয়া শিক্ষার্থীদের নিয়ে কোনোরকমে ক্লাস শুরু করেছেন শিক্ষকরা। ওরিয়েন্টেশন ক্লাস বা আনন্দানুষ্ঠান তো দূরের কথা, এ নিয়ে সংশ্লিষ্টদের মনে দুর্ভাবনা দেখা দিয়েছে। শিক্ষার্থী ভর্তির হাল এমন হলে ওইসব কলেজে অনার্স টিকবে তো? ভুক্তভোগীদের সঙ্গে সঙ্গে এমন উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা আমারও।

আমার পরিচিত বেশ কজন অভিজ্ঞ শিক্ষকের সঙ্গে এ নিয়ে কথা বলি। তারা জানান, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় হঠাৎ অনার্সে ভর্তির পয়েন্ট বাড়িয়ে দেওয়ায় এ বছর এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। ফলে এসএসসি-এইচএসসি পাশ করেও অনেকেই আবেদনটি পর্যন্ত করতে পারেনি।

স্বাধীনতা লাভের পর শিক্ষাক্ষেত্রে আমাদের শুরুটা কিন্তু মোটামুটি ভালোই ছিল। ১৯৭১ সালে বিজয়ের অব্যবহিত পর প্রবাসী সরকার দেশে ফিরে এসে নতুন করে মন্ত্রীদের দায়িত্ব পুনর্বণ্টন করে। ২৯ ডিসেম্বর শিক্ষামন্ত্রীর দায়িত্ব দেওয়া হয় অধ্যাপক মোহাম্মদ ইউসূফ আলীর ওপর। ইউসূফ আলীই স্বাধীন দেশের প্রথম শিক্ষামন্ত্রী (১৯৭১-৭৫)। তার মেধা, যোগ্যতা ও দক্ষতা বলতে গেলে প্রশ্নাতীত। মুক্তিযুদ্ধকালে তিনি প্রবাসী সরকারের ত্রাণ ও পুনর্বাসন দপ্তরের প্রধান হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন। গণপরিষদের স্পিকার হিসাবে মুজিবনগরে অস্থায়ী সরকারের স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র পাঠ করেন অধ্যাপক ইউসূফ আলী। এ ছাড়া ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী ও অন্যান্য মন্ত্রীদের শপথবাক্য পাঠ করান তিনি।

প্রবাদ আছে-‘সব জ্ঞানী ব্যক্তিরই ভাবনা একই রকম হয়’ (গ্রেটমেন থিঙ্ক এলাইক)। এ প্রবাদের যথার্থতার প্রমাণ পাওয়া যায় স্বাধীনতা-পরবর্তী শিক্ষামন্ত্রী পছন্দ করার বেলায়। পাকিস্তানি কারাগার থেকে দেশে ফিরে ১২ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান প্রধানমন্ত্রী হিসাবে শপথ নেন। পরিবর্তন, পরিবর্ধন, সংযোজন আর বিয়োজন যাই হোক, বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বাধীন মন্ত্রিসভায় অধ্যাপক ইউসূফ আলীর অবস্থান শিক্ষা মন্ত্রণালয়েই স্থির থাকে। এখানে বঙ্গবন্ধু ও তার সহকর্মীদের আগের পছন্দের মাঝে চমৎকার মিল লক্ষ করা যায়। দেশের প্রথম শিক্ষামন্ত্রী হিসাবে গুরুত্বপূর্ণ সময়টিতে দায়িত্ব পালন করেন একনাগাড়ে সাড়ে তিন বছর-কম কথা নয়। স্বাধীনতার পর প্রথম বিশ বছরে (১৯৭১-৯১) মোট বাইশবার (২২ বার) পদটিতে রদবদল হয়, এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি দিনের শিক্ষামন্ত্রী অধ্যাপক ইউসূফ আলী।

স্বাধীন দেশের শিক্ষামন্ত্রী হিসাবে মোটামুটি দীর্ঘদিন দায়িত্বে থেকে কী করেছেন অধ্যাপক ইউসূফ আলী? শতরকমের প্রতিকূলতা আর বাধা-বিপত্তির মাঝেও বেশকিছু প্রশংসনীয় কাজ তো তিনি করেছেনই। এবং স্বাভাবিকভাবে এ নিয়ে রয়েছে নানা আলোচনা-সমালোচনাও। কিন্তু দেশ বা জাতির ভবিষ্যৎ ধ্বংসের কারণ হিসাবে চিহ্নিত হয়ে আছে এমন কোনো কাজ এ সময় করা হয়েছে বলে মনে পড়ে না।

কোনোকিছু সম্পর্কে মূল্যায়ন করার ক্ষেত্রে সমসাময়িক পরিবেশ-পরিস্থিতিটিকেও গুরুত্ব সহকারে বিবেচনায় রাখতে হয়। একটি ধ্বংসস্তূপের ভেতর থেকে স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়। এক সাগর রক্ত আর অপরিমেয় ক্ষয়ক্ষতি এবং ব্যাপক ধ্বংসসাধন। চারদিকে লক্ষ-কোটি নিঃস্ব নরনারীর আর্তনাদ, ব্যথা-বেদনা, অভাব-অনটন, নেই আর নেই আওয়াজ। খাদ্য চাই, কাপড় চাই, গৃহ চাই, ওষুধ চাই। সাড়ে সাত কোটি বাঙালির বেঁচে থাকা আর পুনর্বাসনের ব্যাপারটিই ছিল এ সময়ে জরুরি। এরই মধ্যে আবার ‘বাঙালি’ বলে কথা। দুর্দিনে সুযোগ গ্রহণ করে একশ্রেণির লোকের অপতৎপরতা, চুরিচামারি, ডাকাতি-রাহাজানি।

ফলে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির মারাত্মক অবনতি। এর মাঝে আবার যোগ হয় ‘মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা’ চুয়াত্তরের বন্যা ও দুর্ভিক্ষ। এতসব কিছুর মাঝেও পাবলিক পরীক্ষায় খুব দ্রুত নকল বন্ধ করার বিষয়টি বেশ প্রশংসনীয়। শিক্ষাক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য এমন আরও অনেক অর্জন রয়েছে। শিক্ষাক্ষেত্রে ওই সময়কার সবচেয়ে বড় গৌরব ও সাফল্য শতরকমের বাধা-বিঘ্ন সত্ত্বেও ড. কুদরাত-এ-খুদার নেতৃত্বে জাতীয় শিক্ষা কমিশন গঠন (১৯৭২) ও কমিশনের রিপোর্টের (১৯৭৪) ভিত্তিতে একটি যুগোপযোগী শিক্ষানীতি প্রণয়ন। কিন্তু দুর্ভাগ্য যে, এ শিক্ষানীতি বাস্তবায়ন শুরু হতে না হতেই ঘাতকচক্র বঙ্গবন্ধুকে নির্মমভাবে হত্যা করে। ফলে শিক্ষাসহ দেশ ও জাতির অনেক কিছু ওলটপালট হয়ে যায়।

স্মরণযোগ্য, আবেগের বশবর্তী হয়ে লাগামহীনভাবে স্কুল-কলেজ জাতীয়করণ এবং সস্তা জনপ্রিয়তা লাভের আশায় এমনকি দু-দশটি কলেজেও বেহিসাবি অনার্স খোলার মতো ক্ষতিকর ও বিড়ম্বনাময় কোনো কাজ করা থেকে বিরত থাকেন শিক্ষামন্ত্রী ইউসূফ আলী তথা বঙ্গবন্ধু সরকার।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নির্মম হত্যাকাণ্ড তথা পঁচাত্তরের পটপরিবর্তনের পর এবং সেনাপ্রধান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের ক্ষমতায় আরোহণ পর্যন্ত একে একে মোট সাতজন ব্যক্তি শিক্ষামন্ত্রী বা শিক্ষা উপদেষ্টা হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন। তার মানে ৭ বছরে (১৯৭৫-৮২) সাতজন শিক্ষামন্ত্রী। এ সাতজন মন্ত্রী বা উপদেষ্টার মধ্যে একজনের মেয়াদ ছিল দেড় মাস (৪০ দিন) আর একজনের ৩ মাস (১০০ দিন)। স্বল্পমেয়াদি উল্লিখিত দুজন ছাড়াও একজন ৭ মাস এবং আরও একজন ১ বছর দায়িত্ব পালন করেছেন।

কথা হলো, ৭ বছরে সাতজন শিক্ষামন্ত্রী দিয়ে স্বাভাবিক প্রাত্যহিক কাজের (রুটিনওয়ার্ক) বাইরে প্রকৃতপক্ষে কাজের কাজ কী হয়েছে কিংবা কতটুকু কাজ করাই বা সম্ভব? সদ্যস্বাধীন একটি দেশে শিক্ষার মতো গুরুত্বপূর্ণ একটি মন্ত্রণালয়ে চরম অস্থিরতা অর্থাৎ দায়িত্বের এমন ঘনঘন হাতবদলে জাতি আসলে কী পেয়েছে? অথচ মত আর পথ যাই হোক, মেধা ও পাণ্ডিত্য এবং দক্ষতা-বিচক্ষণতার বিবেচনায় অধ্যাপক আবুল ফজল, সৈয়দ আলী আহসান, কাজী জাফর আহমদ ও শাহ আজিজুর রহমানরা কিন্তু কোনো অংশে কম ছিলেন না (তারা সবাই শিক্ষামন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেছেন)।

বেশিদিনের শিক্ষামন্ত্রী এএসএইচকে সাদেক (পাঁচ বছর), ড. এম ওসমান ফারুক (পাঁচ বছর) ও নূরুল ইসলাম নাহিদ (টানা ১০ বছর)। বর্তমান শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনির কার্যকাল সাড়ে ৩ বছর অতিবাহিত হলো। স্বাধীনতার অব্যবহিত পর যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশে শত প্রতিকূলতার মধ্যেও শিক্ষা নামের গাড়িটা মোটামুটি সঠিকভাবেই স্টার্ট দেওয়া হয়েছিল; কিন্তু উত্তরসূরিদের কাছে বিনীত জিজ্ঞাসা-কী করলেন আপনারা একেকজন? গাড়িটি কতদূর চলেছে আর এখন এর হালই বা কী? স্বাধীনতার পর একে একে ৫০ বছর অতিবাহিত হয়েছে। শিক্ষা নিয়ে কি দেশবাসী স্বস্তিতে আছে?

লেখক : বিমল সরকার, অবসরপ্রাপ্ত কলেজ শিক্ষক

প্রাথমিকে ১০ হাজার শিক্ষক নিয়োগ জুনের মধ্যে: প্রতিমন্ত্রী - dainik shiksha প্রাথমিকে ১০ হাজার শিক্ষক নিয়োগ জুনের মধ্যে: প্রতিমন্ত্রী পূর্ণাঙ্গ উৎসব ভাতা দাবি মাধ্যমিকের শিক্ষকদের - dainik shiksha পূর্ণাঙ্গ উৎসব ভাতা দাবি মাধ্যমিকের শিক্ষকদের ঝরে পড়াদের ক্লাসে ফেরাতে কাজ করছে সরকার - dainik shiksha ঝরে পড়াদের ক্লাসে ফেরাতে কাজ করছে সরকার প্রাথমিক শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষায় জালিয়াতি, ভাইবোন গ্রেফতার - dainik shiksha প্রাথমিক শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষায় জালিয়াতি, ভাইবোন গ্রেফতার ভিকারুননিসায় ৩৬ ছাত্রী ভর্তিতে অভিনব জালিয়াতি - dainik shiksha ভিকারুননিসায় ৩৬ ছাত্রী ভর্তিতে অভিনব জালিয়াতি শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষায় অসদুপায় অবলম্বন প্রায় শূন্যের কোটায় - dainik shiksha শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষায় অসদুপায় অবলম্বন প্রায় শূন্যের কোটায় ‘চার আনা’ উৎসব ভাতা: প্রধানমন্ত্রী ও শিক্ষামন্ত্রী সমীপে - dainik shiksha ‘চার আনা’ উৎসব ভাতা: প্রধানমন্ত্রী ও শিক্ষামন্ত্রী সমীপে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0037901401519775