পাকিস্তান যুগে ও স্বাধীন বাংলাদেশে বিভিন্ন সরকারের সময় শিক্ষা নিয়ে নানা পরিকল্পনা ও কার্যক্রম গ্রহণ করা হয়েছে। তার মধ্যে প্রায় প্রত্যেক সরকারের মেয়াদকালে একটা শিক্ষা কমিশন গঠন করা হয়েছে শিক্ষাক্ষেত্রে সংস্কার আনার সুপারিশ করার জন্য। তবে বর্তমান সরকার গঠিত কমিশন ব্যতীত এসব কমিশনের সুপারিশ বাস্তবায়ন শেষ পর্যন্ত করা যায়নি। ছাত্র আন্দোলন ছাড়াও রিপোর্ট বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে সরকারের দৃঢ়তার অভাব এর জন্য দায়ী। পাশাপাশি শিক্ষা সংস্কারের উদ্দেশ্যে বিদেশ থেকে মোটা অঙ্কের টাকাও এসেছে। প্রাথমিক থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে শিক্ষাকে সংস্কার করে মানোন্নয়নের কথা বলে শত শত কোটি টাকা ব্যয় করা হয়েছে। এর ফলে পাঠক্রম, অবকাঠামো, শিক্ষা উপকরণ, শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ কতদূর এগিয়েছে, তা নিয়ে অর্থবহ কোনো মূল্যায়ন করা হয়েছে কি-না জানি না। শিক্ষা ব্যবস্থা কতদূর উপকৃত হয়েছে, তা জানা না গেলেও এটা বলা কোনো অতিকথন হবে না যে, কনসালট্যান্ট, গবেষক, আমলারা সম্মানী বাবদ অর্থলাভ ও বাস্তব অভিজ্ঞতা অর্জনের নামে বিদেশ ভ্রমণ করে অনেক লাভবান হয়েছেন।
এটা ঠিক যে, স্বাধীনতার ৪৬ বছরে শিক্ষার সুযোগ বৃদ্ধি পেয়েছে, বিভিন্ন পর্যায়ে শিক্ষার্থী সংখ্যা বেড়েছে, অবকাঠামোগত পরিবর্তন হয়েছে এবং শিক্ষকদের সংখ্যা বেড়েছে। বর্তমান শিক্ষা ব্যবস্থা নিয়ে কোনো আলোচনায় অবশ্যই এসব বিষয় উল্লেখ করতে হয়। প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ে পরীক্ষা গ্রহণে নানা পরিবর্তন হয়েছে বা হতে যাচ্ছে। এত কিছুর পরও শিক্ষার মান নিয়ে সরকার থেকে শুরু করে সমাজের নানা পর্যায়ে নেতিবাচক মনোভাব লক্ষ্য করা যায়। শিক্ষার মান বৃদ্ধি একটি মৌলিক বিষয়, যার আলোচনা কখনও শেষ হবে বলে মনে হয় না। জ্ঞান অন্বেষণের সঙ্গে মানের হ্রাস-বৃদ্ধি যেহেতু জড়িত, তাই জ্ঞানের বিকাশ ও উৎকর্ষের সঙ্গে শিক্ষার মানেও পরিবর্তন হবে বলে বিশ্বাস করা যায়। যুগোপযোগী শিক্ষার বিষয়টি বিজ্ঞান-প্রযুক্তি-শিল্পকলা-মানবিক-দর্শন বিষয়ের অগ্রগতির সঙ্গে জড়িত। এসব ক্ষেত্রে সর্বশেষ অগ্রগতি শিক্ষার পাঠক্রমের সংযোজন করে শিক্ষার মান বৃদ্ধি সম্ভব। এর সঙ্গে একজন শিক্ষার্থীর জ্ঞানলাভের মানদণ্ড যাচাই হতে পারে তার মূল্যায়ন দিয়ে, যা নতুন পদ্ধতি প্রয়োগের মাধ্যমে সমৃদ্ধ করা যেতে পারে।
কিন্তু বর্তমান সময়ে বাংলাদেশ সমাজে শিক্ষা নিয়ে ক্রমবর্ধমান শঙ্কার বিষয়টি যেমন মান বা উপকরণগত সমস্যাকেন্দ্রিক, তার থেকেও নৈতিকতাকেন্দ্রিক বেশি বলে মনে হয়। প্রাথমিক পর্যায় থেকে বিশ্ববিদ্যালয় এবং বিভিন্ন নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁস হয়ে যাওয়া বর্তমানে শিক্ষা প্রশাসকদের মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এক সময় যেমন পরীক্ষার হলে নকল করে লেখার বিষয়ে প্রধান মনোযোগ ছিল। এখন প্রশ্ন ফাঁসের হিড়িকে তা নিয়ে উদ্বেগ কমে গেছে। প্রশ্ন ফাঁসের সঙ্গে উত্তর লাভ হয় বলে নকল করার দরকার নেই এখন। কে বা কারা প্রশ্ন ফাঁস করছে, তা তদন্ত করে কাউকে শাস্তি দিতে দেখা যায়নি আজ পর্যন্ত।
প্রশ্ন ফাঁসের অভিযোগ উঠছে এখন প্রাথমিক থেকে বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি পরীক্ষা, মেডিকেল ভর্তি পরীক্ষা এবং বিভিন্ন নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্ন নিয়ে। গত কয়েক বছর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁস হচ্ছে বলে আলোচনা আছে। সাম্প্রতিক সময়ে প্রাথমিক স্কুলের বার্ষিক পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁসের অভিযোগ পরীক্ষার শুদ্ধতাকে কোন পর্যায়ে নিয়ে গেছে; বোঝা যায়! মোদ্দা কথা, ফাঁস হওয়া প্রশ্নপত্র পেয়ে উত্তর মুখস্থ করা বা পরীক্ষার হলে উত্তর পেয়ে তা লেখার মধ্য দিয়ে মেধার কোনো যাচাই হয় না। ভেজাল তেলের মতো ভেজাল ছাত্রছাত্রী তৈরি হচ্ছে। তা হলে জলের চেয়ে তেল মূল্যবান- প্রমাণ হবে কীভাবে?
নৈতিকতা শিক্ষা দেওয়ার জন্য পরিবারের সঙ্গে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ভূমিকা নিয়ে কোনো বিতর্ক নেই। বরং পারিবারিক আবহাওয়ায় একজন শিশু যা শিখতে পারে না, তা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান শিখাতে পারে। দীর্ঘ সময় সে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে কাটায়, সেটাই কারণ নয়। তার শিক্ষকের নৈতিক গুণসম্পন্ন উন্নত মানবিক ভূমিকাও আছে বলে। তাই ‘মানুষ গড়ার কারিগর’ অভিধার এখানেই প্রাসঙ্গিকতা। শিক্ষকতা পেশায় আগত ব্যক্তিরা অন্য পেশার ব্যক্তিদের তুলনায় ভিন্ন চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের হবেন- এটাই প্রত্যাশিত। প্রাচীন যুগ থেকেই শিক্ষকের এ পরিচয় তাকে অনন্য করে তুলেছে। সে কারণে তারা সমাজের অন্যদের কাছ থেকে সম্মান পেয়ে এসেছেন।
কিন্তু এখন শিক্ষকরা যে তেমন নৈতিকতার গুণে গুণান্বিত নন- তা বোঝা যায়। প্রশ্ন উঠতে পারে, এ অভিযোগ কি সব শিক্ষকের বেলায় ওঠে? হয়তো না, তবে সংখ্যা যা-ই থাকুক, অন্যরাও এভাবে অভিযুক্ত হন তাদের অন্য সহকর্মীদের অপকর্মের দায়ের কারণে। তারা ব্যক্তিগতভাবে নৈতিক গুণাবলিসম্পন্ন হয়েও এ অপকর্মের বিরুদ্ধে দাঁড়ান না বা কোনো প্রতিবাদ করেন না বা তারা সংঘবদ্ধ হন না এসব সহকর্মীর বিরুদ্ধে।
স্কুল পর্যায়ে শিক্ষকদের বিরুদ্ধে প্রশ্ন ফাঁসের অভিযোগের সঙ্গে নিজ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষাদানে অবহেলা করে প্রায় সারাদিন কোচিং করানোর অভিযোগ আছে। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের শিক্ষকদের বিরুদ্ধে নিয়মিত কোর্স পড়াতে অবহেলা করে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ান এবং সান্ধ্য কোর্সে পড়াতে আগ্রহের অভিযোগ আছে। এসব অভিযোগের পক্ষে অনেক তথ্য-প্রমাণ আছে। তাই যারা এর সঙ্গে জড়িত তারা অস্বীকার করতে পারবেন না।
একসময় শিক্ষকরা নিজেদের সমাজের অবহেলিত অংশ বলে মনোবেদনায় ভুগতেন। তাদের বেতন-ভাতা সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের তুলনায় কম ছিল। সে কারণে তাদের স্কুলের বাইরে ছাত্র পড়িয়ে বাড়তি আয় করতে হতো। কিন্তু বেতন-ভাতা যেভাবে বেড়েছে, তাতে আয়ের ঘাটতি পূরণে ছাত্র পড়ানোর যুক্তির সপক্ষে দাঁড়ানো যায় না। অন্যদিকে তারা নিয়মিত শিক্ষার্থীদের পাশাপাশি দু’চারজন ছাত্রকে ‘প্রাইভেট টিউশনি’ করান না। এখন যা করেন তাকে বলা হচ্ছে ‘কোচিং ব্যবসা’। নামিদামি ডাক্তারদের মতো তারাও বাড়ি ভাড়া নিয়ে প্রায় সারাদিন এমনভাবে পড়ান, যাতে পরীক্ষায় একজন শিক্ষার্থী ৫+ পায় (আগে ছিল স্টার মার্কস)। সম্ভবত এসব শিক্ষকের কোচিং করানোর নিজস্ব পদ্ধতি আছে। যে কারণে তারা শিক্ষার্থীদের সর্বোচ্চ ফলের নিশ্চয়তা দিয়ে তাদের দিকে টেনে আনেন। রাস্তার ধারে ‘অমুক স্যার, তমুক স্যার’ নামে বিজ্ঞাপনের বোর্ড ঝুলতে দেখা যায় শহরের বিভিন্ন স্থানে।
বিভিন্ন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের বিরাট অংশও অভিযোগমুক্ত নন। তাদের বিরুদ্ধে নিজ শিক্ষার্থীদের অবহেলা করে অন্য বিশ্ববিদ্যালয় বা নিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে উচ্চ বেতনের সান্ধ্য কোর্সে পড়ানোর অভিযোগ। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার সঙ্গে সঙ্গে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর শিক্ষকদের দিয়ে সেগুলো চালানোর প্রচলন শুরু হয়েছিল। বিশেষ করে বাণিজ্য অনুষদ ও ইংরেজি বিভাগের শিক্ষকরা তখন থেকে নিজ বিশ্ববিদ্যালয়কে জানিয়ে বা না জানিয়ে এসব বিশ্ববিদ্যালয় চালানোর দায়িত্ব নেন। এসব শিক্ষকের বিরুদ্ধে সময়মতো কোর্সের পাঠদান সম্পন্ন না করা বা পরীক্ষা গ্রহণ শেষে নির্ধারিত সময়ে ফল প্রকাশ না করার অভিযোগ যথেষ্ট। সান্ধ্য কোর্স প্রবর্তন করার বিষয়টি খুব পুরান ব্যাপার নয়। এখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে খুব কম বিভাগ বা ইনস্টিটিউট আছে, যেখানে এসব কোর্স পড়ানো হয় না। পড়ানোর প্রায়োগিক মূল্য নির্বিশেষে সান্ধ্য কোর্স খুলে শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে উচ্চহারে ফি আদায় করা হয় এসব বিষয়ে। বিশ্ববিদ্যালয়ে কোনো নীতিমালা নেই বলে ‘একজনকে দেখে অপরজনের প্রভাবিত হওয়া’র নিয়মে অধিক উপার্জনের আশায় এসব কোর্স পড়ানো হচ্ছে বললে অতিকথন হয় না। নিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের অবকাঠামো ব্যবহার করে এসব কোর্স পড়িয়ে যে অর্থাগম হয়, তার একটা অংশ বিশ্ববিদ্যালয় তহবিলে দেওয়ার নিয়ম থাকলেও তা মানা হয় না।
পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের একটা অংশকে সেমিনার-ওয়ার্কশপ করতে বিদেশে যেতে যত আগ্রহী হতে দেখা যায়, নিজ শিক্ষার্থীদের পড়ানোর বিষয়ে তত আগ্রহী হতে দেখা যায় না। এ ছাড়া বিভিন্ন সময়ে তারা কনসালট্যান্সি বা গবেষণা প্রকল্প নিয়ে ব্যস্ত থাকেন বলে তাদের শিক্ষার্থীরা বঞ্চিত হয়। গবেষণা ও পাঠদান পাশাপাশি হওয়া উচিত; কিন্তু শুধু গবেষণা করে একজন শিক্ষকের ব্যক্তিগত অর্জন হতে পারে; তাতে শিক্ষার্থীদের লাভ কী হতে পারে? সেমিস্টার চলার সময় একজন শিক্ষক কত দিন বাইরে থাকতে পারেন, সে বিষয়ে কোনো নীতিমালা আছে বলে জানি না, যদিও বিদেশে যাওয়ার জন্য অনুমতি চাইতে একজন শিক্ষকের যে ফরম পূরণ করতে হয়, তাতে তাকে লিখতে হয় যে, তিনি এর আগে এ জাতীয় উদ্দেশ্যে কতদিন বিদেশে ছিলেন। বেশি বেশি বিদেশে সময় কাটালেও কোনো শিক্ষককে বিশ্ববিদ্যালয় অনুমতি দেয়নি বলে জানি না।
স্বাধীনতার পর থেকে দেশে যে অসুস্থ রাজনীতি বিদ্যমান, তা যে শুধু রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড ও রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানের ক্ষতি করেছে, এমন নয়। একই সঙ্গে নৈতিকতাবোধকেও ভয়ানকভাবে আঘাত করেছে। জবাবদিহি, সঠিকভাবে আইনের প্রয়োগ, স্বজনপ্রীতি রোধ, অপরাধের শাস্তি বিধানের সঙ্গে নীতি-নৈতিকতা সম্পর্কিত করা যেতে পারে। স্বাধীনতার পর থেকে রাষ্ট্রীয় সম্পদের লুটপাট ও পরিত্যক্ত সম্পত্তি দখলের মাধ্যমে বেআইনিভাবে সম্পদ অর্জনের সূত্রপাত হওয়ায় অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে কোনো শৃঙ্খলা আরোপ করা সম্ভব হয়নি। বেআইনি অর্থ অর্জনের সঙ্গে প্রশ্নবিদ্ধভাবে রাজনৈতিক ক্ষমতা অর্জন পুরো সমাজকে জবাবহীনতার দিকে নিয়ে গেছে। অবাধ ভোগ-বিলাসিতার চলও বেআইনি অর্থলাভের আকর্ষণ বাড়িয়ে দিয়েছে। শিক্ষকরাও তাই ‘উচ্চতর ও সাধারণ জীবনযাপন’ চিন্তাকে বিসর্জন দিয়েছেন। এটাই স্বাভাবিক যে, তারা এ সমাজের মানুষ হয়ে পারিপার্শ্বিক অবস্থা দিয়েই প্রভাবিত হবেন। বেআইনি কাজ আর কর্তব্যে অবহেলার জন্য কোনো জবাবদিহি না থাকা এবং অপরাধ করেও রাজনৈতিক প্রভাবে দণ্ড থেকে মুক্ত থাকার রেওয়াজ আছে বলে শিক্ষকরাও নৈতিক গুণসম্পন্ন থাকছেন না। এ দেখে অবাক হওয়ার কী আছে?
অবসরপ্রাপ্ত প্রফেসর, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
সৌজন্যে: সমকাল