বিশ্ববিদ্যালয় জ্ঞানচর্চার বাতিঘর। জ্ঞানের উদ্ভাবন, পরস্ফুিটন, সংরক্ষণ ও প্রায়োগিক গবেষণার মাধ্যমে দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ ও মানবিক মূল্যবোধসম্পন্ন নাগরিক তৈরির প্রয়াস থেকেই জন্ম বিশ্ববিদ্যালয়ের। বিশ্ববিদ্যালয় মুক্তচিন্তার দ্বার উন্মোচন করে দেশের ইতিহাস, সংস্কৃতি, রাজনীতি, অর্থনীতি ও সমাজব্যবস্থার ক্রমধারা মূল্যায়িত করে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বিশ্ববিদ্যালয়কে আখ্যায়িত করেছেন বিদ্যা উত্পাদনাগার হিসেবে। যেখানে সদা নিত্যনতুন বিদ্যা জন্ম নেবে এবং বিদ্যার্থীদের জাতির উপযোগী দক্ষ, যোগ্য, সার্থক ও কল্যাণকামী সদস্য হিসেবে গড়ে তুলবে। বৃহস্পতিবার (২৯ জুলাই) ইত্তেফাক পত্রিকায় প্রকাশিত এক নিবন্ধে এ তথ্য জানা যায়।
নিবন্ধে আরও জানা যায়, জন্ম থেকে মৃত্যু অবধি মানুষের জীবনকে তিনটি স্তরে ভাগ করা যায়। আহরণ, পরস্ফুিটন ও প্রতিফলন। আহরণ অর্থ সঞ্চয় করা। পৃথিবীর অসীম ভান্ডার থেকে জ্ঞান, তথ্য, ন্যায়-নীতিবোধ, মূল্যবোধ সংগ্রহ করা। আমাদের এই পর্ব সম্পূর্ণ হয়ে থাকে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষাকেন্দ্র থেকে। এরপর পরস্ফুিটিত হওয়ার পালা, অর্জিত জ্ঞানকে বিকাশিত করার পালা। এই কাজ সম্পূর্ণ করে বিশ্ববিদ্যালয়। বিশ্ববিদ্যালয় আমাদের পূর্বে আহরিত সব জ্ঞানকে প্রক্রিয়াকরণ করে প্রয়োগের উপযোগী করে তোলে। জ্ঞানের পূর্ণতা দান করে সমাজ ও রাষ্ট্রের প্রয়োজন মেটাতে চেষ্টা করে, যা প্রতিফলনের পর্বকে ত্বরান্বিত করে, স্থায়িত্ব করে। এখানেই বিশ্ববিদ্যালয়ের সার্থকতা।
বিশ্ববিদ্যালয় বিশ্বের যাবতীয় জ্ঞানভান্ডারের রক্ষক। কেবল রক্ষক নয়; সেই জ্ঞানকে সাধনা, বোধশক্তি ও প্রজ্ঞার মাধ্যমে বৃদ্ধি এবং পরবর্তী প্রজন্মের কাছে উপস্থিত করাও তার দায়িত্বের মধ্যে বর্তায়, যা ভবিষ্যত্ প্রজন্মকে মননসম্পন্ন চিন্তাচেতনা দ্বারা সমাজ ও রাষ্ট্রের সামাজিক, আর্থসামাজিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক সীমাবদ্ধতা এবং সমস্যাগুলো চিহ্নিত করে বিশ্লেষণ ও সমাধানের প্রতি প্রত্যয়ী করে তোলে। এখান থেকেই সৃষ্টি হয় দায়বদ্ধতার জায়গাটি। এই দায়বদ্ধতা বিবেক-বুদ্ধির জাগরণের, ইতিহাস-ঐতিহ্য রক্ষার, সত্য-সুন্দর প্রতিষ্ঠার, অন্ধকারের বিপরীতে আলোর মশাল হয়ে দাঁড়ানোর।
বিশ্ববিদ্যালয়ের বিদ্যার্থীরা হবেন সর্ব আধুনিক। সময়, যুগ ও সমাজসচেতন। ইতিহাসও তাই বলে। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন থেকে শুরু করে আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধ—সর্বক্ষেত্রে তাদের ভূমিকা ছিল অনস্বীকার্য। বিশ্ববিদ্যালয়ের বিদ্যার্থীরা হবেন সব অন্যায়, অত্যাচার ও অবিচারের বিরুদ্ধে মূর্তপ্রতীক। সাড়া দেবেন সমাজ, রাষ্ট্রের যে কোনো প্রয়োজনে। কখনো সমাজের আকাশে কালো মেঘ ঘনীভূত হলে আবির্ভূত হবেন আলোকদিশারী হয়ে। একদিকে তারা যেমন হবেন অসীম জ্ঞান-গরিমার আধার; তেমনি সত্য, ন্যায়, সহযোগিতা, সহমর্মিতা, মূল্যবোধসহ সব মানবীয় গুনাবলির ধারক ও বাহক। তাদের চিন্তাচেতনা হবে যৌক্তিক এবং সময়োপযোগী। তারা ভাববেন সমাজে সৃষ্ট নিত্যনতুন সমস্যা নিয়ে। সৃজনশীলতা দিয়ে বের করবেন এর সমাধান। এভাবে সৃষ্টিশীল কাজের মাধ্যমে প্রবর্তিত হবেন জাতির কান্ডারির ভূমিকায়।
বর্তমানে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে বাজারমুখী ও কর্মসংস্থান উপযোগী বিদ্যার বড্ড কদর; প্রয়োজনের নিরিখে যা স্বীকার্য। অন্যদিকে সৃজনী মানসিকতা, মুক্ত চিন্তা ও বোধের জায়গা তৈরিতে সহায়ক এমন বিদ্যার প্রতি অনীহা দারুণ। তাই এখন আমরা প্রায়শই দেখতে পাই বিশ্ববিদ্যালয়ের বিদ্যার্থীদের মানবিকতা খোয়া যাচ্ছে। তারা মদ, গাঁজা, বিড়ি-সিগারেটে আসক্ত হচ্ছে। যুক্ত হচ্ছে সন্ত্রাস, রাহাজানি, জঙ্গিবাদের সঙ্গে। অনেকে আবার বেছে নিচ্ছে আত্মহত্যার মতো গর্হিত পথ, যা জাতির স্বপ্ন ভেঙে খানখান করে দিচ্ছে, ব্যথিত করছে হূদয়। অথচ এই বিদ্যার্থীদেরই দেখতে পাওয়ার কথা ছিল আলোর মশাল হাতে সমাজ সংস্কারের ভূমিকায়। এখন এই বিপথগামী বিদ্যার্থীদের বোধের জানালায় টোকা দিতে কে তুলবে মশাল?
উচ্চশিক্ষার দুটি মূলনীতি—কোনো বিষয়ে উচ্চতর ও বিশেষজ্ঞীয় জ্ঞান অর্জন, শিক্ষানীতি ও প্রচলিত ধারণার ভিত্তিতে বলা যায়, সে বিষয়ে গবেষণা ও উচ্চতর ভাবনার ক্ষমতা ও দক্ষতা অর্জন করে নতুনতর জ্ঞান সৃজন এবং অর্জিত ও সঞ্চিত জ্ঞানের মাধ্যমে মানবসমাজের কল্যাণে অবদান রাখার যোগ্যতা অর্জন। বিশ্ববিদ্যালয়কে এই পথে হাঁটতে হবে। শিক্ষাকে যেমন কার্যত ও ফলপ্রসূ করে তুলতে হবে, তেমনি করতে হবে বাস্তবিক ও প্রায়োগিক। জ্ঞানের পরস্ফুিটনকে যেমন দিতে হবে প্রাধান্য, তেমনি তৈরি করতে হবে সুকুমার কলাচর্চার যথা উপযুক্ত পরিবেশ। শিক্ষাকে যেমন করতে হবে সহজলভ্য, তেমনি রুখতে হবে এর বাণিজ্যকরণ। তবেই তৈরি হবে বোধসম্পন্ন বিদ্যার্থী। যারা পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র বৃহত্ অর্থে এই মহাবিশ্বের দায়বদ্ধতা মেটাতে সক্ষম হবে।
লেখক : শাকিরুল আলম শাকিল, শিক্ষার্থী, ড্যাফোডিল আন্তর্জাতিক বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা