করোনার ভয়াল থাবায় এক রকম স্তব্ধ ও স্থবির পড়ে আছে সুন্দর পৃথিবীটা। চার মাস ধরে আমাদের দেশে এর একক আধিপত্য। স্বাভাবিক জীবনযাত্রা বিঘ্নিত। চীনের উহানে যেদিন প্রথম করোনা রোগী শনাক্ত হয়, সেদিন কেউ ভাবেনি এই জগৎ সংসার করোনা নামের অতিক্ষুদ্র ভাইরাসের কাছে অসহায় হয়ে পড়বে। আজ তা-ই হয়েছে। পৃথিবীতে এর শেষ কোথায় কিংবা করোনা কি আদৌ কোনোদিন শেষ হবে, সেটিও কেউ জানে না। করোনাকে সাথে নিয়ে অনেকদিন আমাদের বসবাস করতে হয় কি না, কে জানে? আপাতত ভ্যাকসিন আবিষ্কার না হওয়া পর্যন্ত এ বিষয়ে নিশ্চিত কেউ কিছু বলতে পারছে না। এই শতাব্দীতে পৃথিবীর মানুষ এর চেয়ে বড় কোনো বিপর্যয়ের মুখোমুখি হয়েছে বলে জানা নেই।
বৈশ্বিক এই মহামারিতে পৃথিবীর মানুষ নানাভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এই মুহূর্তে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ নিরূপণ করা কঠিন। আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশগুলোর এই ক্ষয়ক্ষতি আরও বেশি। বিগত দশ বছরে পৃথিবী যতটুকু এগিয়েছে, এই ছয়-সাত মাসে তার চেয়ে বেশি পিছিয়েছে। করোনা কেবল প্রাণহানি ঘটিয়ে চলেছে এমন নয়, অর্থনীতির চাকা বিকল করে রেখেছে। করোনার ভ্যাকসিন আবিষ্কৃত হলে একদিন হয়ত করোনা ভাইরাস নির্মূল হবে। কিন্তু অর্থনীতির চাকা সচল হয়ে পূর্বাবস্থায় ফিরে আসতে আরো কতদিন লাগবে, তা কেউ বলতে পারে না।
পৃথিবীর অন্যান্য উন্নয়নশীল দেশের ন্যায় এই মহামারিতে আমাদের দেশের স্বাস্থ্য ও শিক্ষাখাত সবচেয়ে বেশি বিপর্যস্ত হয়েছে। তদুপরি ঢাকা মেডিক্যালের স্বাস্থ্যকর্মীদের এক মাসের হোটেলের প্রশ্নবিদ্ধ খাবার ও থাকার বিল আর সাহেদ-সাবরিনাদের অপকর্ম আমাদের স্বাস্থ্যখাতের বেহাল চিত্র বিশ্ববাসীর সামনে ফুটিয়ে তুলেছে। এ কারণে সারা পৃথিবীর মানুষের সামনে লজ্জায় আমাদের মাথা আরেকবার হেট হয়েছে। লজ্জা-শরম ঢেকে রাখার জায়গা খুঁজে পাওয়া ভার। কম্বল চোরেরা বঙ্গবন্ধুর সোনালী অর্জনকে ম্লান করে দিতে যেমন তৎপর ছিল, তেমনি সাহেদ-সাবরিনারা জাতির জনকের তনয়া শেখ হাসিনার সব কৃতিত্বকে ধুলোয় মিশিয়ে দিতে চায়। বঙ্গবন্ধুর উদার মনে কম্বল চোরদের ক্ষমা করে দিলেও জননেত্রী শেখ হাসিনা যেন এসব দুর্নীতিবাজদের ক্ষমা করে না দেন, সেটিই আমরা চাই।
বন্দুক যুদ্ধ দেখিয়ে এদের ক্রসফায়ারে মেরে ফেলা কিংবা গাছে লটকিয়ে জনসমক্ষে গুলি করে মারার দাবি ফেসবুকে দেখতে পাই। আইনের ফাঁক-ফোকর দিয়ে এরা বেরিয়ে আসলে একদিন এদের দৌরাত্ম্যের কাছে হার মেনে সাধারণ মানুষজনকে দেশ ছেড়ে অন্য কোথাও পালিয়ে যেতে হবে। বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলাটিকে সাহেদ-সাবরিনারা মৃত পশুর মতো শকুনের ন্যায় ব্যবচ্ছেদ করে খেয়ে ফেলতে তৎপর রয়েছে। করোনার মতো এসব শকুনরূপী মানুষের সাথে জননেত্রী শেখ হাসিনাকে যুগপৎ আন্দোলন সংগ্রাম চালিয়ে যেতে হচ্ছে। সে সংগ্রামে তাঁকে জয়ী হতেই হবে। তাঁর চোখে মুখে এমন একটি প্রত্যয় আমরা নিত্যদিন দেখতে পাই।
এমনিতে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার বেহাল দশা। সাহেদ-সাবরিনারা ছদ্মবেশে আমাদের শিক্ষায় থাবা মেলে রয়েছে। তদুপরি করোনা মহামারির কারণে শিক্ষাব্যবস্থা আজ মুখ থুবড়ে পড়ে আছে। দেশের শিক্ষাব্যবস্থায় কতজন সাহেদ-সাবরিনা তৎপর রয়েছে, সে হিসেব আমাদের জানা নেই। কিন্তু, তাদের স্বজনেরা গোটা শিক্ষাব্যবস্থা আগলে আছে, সে কথা সহজেই অনুমেয়। এদের কারণে আজ শিক্ষাব্যবস্থা সরকারি ও বেসরকারি দুই ধারায় বিভক্ত। স্বাধীনতার রজত জয়ন্তীর কাছাকাছি এসেও শিক্ষায় বড় কোনো সুবাতাস বইতে দেখি না। বেসরকারি শিক্ষা ধারায় সাহেদ-সাবরিনাদের স্বার্থের কারণে শিক্ষক সমাজের দুর্দশা ও দুর্গতি দিন দিন বেড়ে চলেছে। এদের কবলে পড়ে বেসরকারি পাঁচ লাখ শিক্ষক-কর্মচারীর ভাগ্য নিত্যদিন ঘুরপাক খায়। এরা স্কুল, কলেজ ও মাদরাসায় ভৌত অবকাঠামো নির্মাণের নামে কোটি কোটি টাকা বাণিজ্য করে। শিক্ষকদের বিদেশে প্রশিক্ষণের নামে হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়। উপবৃত্তি ও বিনা মূল্যে পাঠ্যপুস্তক বিতরণের নামে কত শত হাজার কোটি টাকা কামাই করে, কে জানে? অবসর ও কল্যাণ ট্রাস্টের নামে জোর জবরদস্তি করে অতিরিক্ত ৪ শতাংশ নিয়ে কতজন সাহেদ-সাবরিনা তাদের পেট ভরছে, সে আমাদের জানা নেই।
যশোরের আইনুদ্দিন স্যার অবসর ও কল্যাণ ট্রাস্টের টাকা না পেয়ে বিনা চিকিৎসায় মৃত্যু বরণ করেন, দৈনিক শিক্ষায় প্রকাশিত সে দুঃসংবাদটি মন খারাপ করে। বেদনায় হৃদয় কত বিক্ষত হয়। এভাবে কত আইনুদ্দিন স্যার বুক ভরা কষ্ট নিয়ে পরকালগামী হয়েছেন, সে খবরটি কয়জনে জানতে পারে? শিক্ষাখাতের ছদ্মবেশী সাহেদ-সাবরিনাদের কারণে জাতির মহান কারিগর আইনুদ্দিন স্যারেরা ধুঁকে ধুঁকে মরে গিয়ে জীবনের ইহলীলা শেষ করেন।
করোনা আমাদের চোখে আঙ্গুল দিয়ে সাহেদ-সাবরিনাদের পরিচয় করিয়ে দিয়েছে। যারা কলার দাম ১০০০ টাকা আর ডিমের দাম ২০০০ টাকা ধরে ধরে আমাদের অর্থনীতি চুষে চুষে খায, তাদের স্বরূপ উন্মোচন করে দিয়েছে। রিজেন্টের সাহেদ যেমন বোরখা পরে সাতক্ষীরার ইছামতি নদী পাড়ি দিয়ে পালিয়ে যেতে চেয়েছিল, তেমনি না জানি কত সাহেদ বোরখা পরে শিক্ষাখাতটি খেযে খেয়ে চুরমার করে দিচ্ছে? এদের কারণে শিক্ষাব্যবস্থায় সরকারিকরণের স্বপ্নটি সুদূর পরাহত হয়ে আছে।
শিক্ষাখাত থেকে সাহেদ-সাবরিনাদের উচ্ছেদ করতে শিক্ষা সরকারিকরণের বিকল্প অন্য কিছু নেই। জাতির জনক সেটি উপলব্ধি করে বিধ্বস্ত অর্থনীতি নিয়েও শিক্ষা সরকারিকরণের সুচনায় প্রাথমিক শিক্ষাব্যবস্থা সরকারিকরণ করে দিয়ে গিয়েছিলেন। সেই ধারাবাহিকতা বজায় থাকলে সাহেদ-সাবরিনার মতো কুলাঙ্গারদের উলঙ্গ উত্থান আমাদের চোখ বন্ধ করে দেখতে হতো না।
লেখক : অধ্যক্ষ মুজম্মিল আলী, অধ্যক্ষ, চরিপাড়া উচ্চ বিদ্যালয় ও কলেজ, কানাইঘাট, সিলেট এবং দৈনিক শিক্ষার সংবাদ বিশ্লেষক।