সম্প্রতি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের দুর্নীতির খবরে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম, প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক সংবাদমাধ্যম আলোচনা-সমালোচনায় সরগরম ও সরব হয়েছে। বস্তুত সমাজের সব পেশা ও স্তরেই ভালো ও খারাপ মানুষ আছে। এর মধ্যে অবশ্যই ভালো মানুষের সংখ্যা বেশি। কিন্তু হাজারজন ভালো মানুষের ভালো কাজ ধূলিসাৎ করতে দু-একজন খারাপ মানুষই যথেষ্ট, কারণ ‘ব্যাধি সংক্রামক, স্বাস্থ্য নয়’। দু-একজন খারাপ মানুষের দুষ্কর্মের কালিমা মুছতে লক্ষ-কোটি মানুষের শত বছর লেগে যায়। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, মীর জাফররা সংখ্যায় বেশি হয় না, কিন্তু পুরো জাতিকে তাদের দুষ্কর্মের মাশুল দিতে হয় শত বছর ধরে। তবে, ভালো মানুষ গড়ার কারিগর যারা, তারা যদি দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়েন, তাহলে জাতির সামনে ঘোর অমানিশা নেমে আসে। কারণ, ময়লা হাতের প্রডাক্ট পরিষ্কার হয় না, তাতে কিছু ময়লা লাগবেই। একজন শিক্ষক তার শিক্ষার্থীদের কাছে একজন রোল মডেল। বৃহস্পতিবার (২৬ নভেম্বর) দৈনিক সংবাদ পত্রিকায় প্রকাশিত উপসম্পাদকীয়তে এ তথ্য জানা যায়।
উপসম্পাদকীয়তে আরও জানা যায়, একজন দুর্নীতিপরায়ণ শিক্ষক কখনোই এই রোল মডেল হয়ে উঠতে পারেন না; আর হতে পারলেও সেটা খারাপ মডেল। একটা দেশের শিক্ষার্থীরা যদি তাদের সামনে অনুসরণীয় আদর্শ ব্যক্তিত্ব ছাড়াই বেড়ে ওঠে, তাহলে একটা জাতির জন্য সেটা বড় দুর্ভাগ্যের কারণ। বিষয়টা খুব সংক্ষেপে ব্যাখ্যা করা যাক। একজন খারাপ শিক্ষক ৩০-৪০ বছর ধরে হাজার হাজার অযোগ্য শিক্ষার্থী তৈরি করেন। সেই হাজার হাজার অযোগ্য শিক্ষার্থী আবার লাখ লাখ মানুষকে বহু বছর ধরে নিম্নমানের সেবা দেয়। ফলে একজন অযোগ্য শিক্ষক নিয়োগের কুফল শুধু একজন শিক্ষকের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে না, লাখ লাখ মানুষের মধ্যে তা বিস্তৃত হয়, লাখ লাখ মানুষকে তার মাশুল দিতে হয়। আবার যদি একজন ভালো শিক্ষক নিয়োগ দেয়া যায়, তাহলে তার সুফলও পায় লাখ লাখ মানুষ। আর এসব এ কারণেই একজন শিক্ষকের দুর্নীতির খবর অন্য পেশার পাঁচজনের দুর্নীতির খবরের থেকে মানুষের মনে বেশি দাগ কাটে, বেদনা জাগায়, ক্ষোভ ছড়ায়। আমরা চাই বা না চাই, খারাপ শিক্ষকের খারাপ কর্মকাণ্ডের পরিণতি ও প্রভাব সমাজের সবাইকে পরোক্ষভাবে হলেও স্পর্শ করে।
কিন্তু, শিক্ষাঙ্গনের দুর্নীতির দায় কার? সোজা কথায় বললে, যিনি দুর্নীতিতে জড়িয়েছেন, দায় তার। কিন্তু ব্যাপারটা এত সরল নয়। দুর্নীতি করার ক্ষমতা বা সুযোগ খুবই অল্প-সংখ্যক শিক্ষকের হাতেই থাকে। তাদের দুর্র্নীতি হলো খারাপ পড়ানো, কম পড়ানো বা আদৌ না পড়ানো। তাদের হাতে প্রশাসনিক বা আর্থিক দুর্র্নীতির সুযোগ খুবই কম। শিক্ষা প্রশাসনের অধিকাংশ বড় পদে থাকেন অশিক্ষক কর্মকর্তারা। তারপরও স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়, শিক্ষা অধিদপ্তর, এনসিটিবি, শিক্ষা বোর্ডসহ আরও কিছু প্রতিষ্ঠানের প্রশাসনে শিক্ষকরা নিয়োগ/পদায়ন পেয়ে থাকেন।
তাদের এই পদায়ন বা নিয়োগ প্রক্রিয়ার মধ্যে বিরাট গলদ রয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়, শিক্ষা বোর্ড, শিক্ষা অধিদপ্তরসহ শিক্ষা প্রশাসনের বিভিন্ন স্তরে যারা নিয়োগ পেয়ে থাকেন, তাদের কতজন বিনা তদবিরে পদায়ন পেয়ে থাকেন? স্কুলের প্রধান শিক্ষক বা কলেজের অধ্যক্ষ পদে দুর্লভ দু-একজন হয়ত বিনা তদবিরে নিয়োগ পেয়ে থাকতে পারেন, কিন্তু আমি কখনও তেমনটা শুনিনি। এখন প্রশ্ন হলো, তদবির কারা, কীভাবে, কাদের মাধ্যমে করেন? তদবিরকারীদের আত্মমর্যাদাবোধ, নৈতিক চরিত্র ও রুচিবোধ কতটা পরিশুদ্ধ হতে পারে? এ প্রশ্নের উত্তরের মধ্যে লুকিয়ে আছে আমাদের প্রশ্নের উত্তর।
চারদিকে এত নিন্দা-বদনামের মাঝেও অবশ্যই সৎ শিক্ষক-প্রশাসক আছেন। বিশ^বিদ্যালয়ের উপাচার্যগণও শিক্ষক-প্রশাসক। একজন উপাচার্য কতটা সৎ ও ব্যক্তিত্ববান হতে পারেন, তার একটা বাস্তব উদাহরণ উল্লেখ না করে পারছি না। একবার যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগে শিক্ষক নিয়োগ হবে। ওই সময়ে ইংরেজি বিভাগের চেয়ারম্যান থাকার সুবাদে আমি ওই বোর্ডের অন্যতম সদস্য হিসেবে আমি এক অনন্য অভিজ্ঞতা লাভ করি। বোর্ডে বসার প্রাক্কালে উপাচার্য মহোদয় (প্রফেসর ড. মো. আনোয়ার হোসেন) জানালেন, তিনি বোর্ডে সভাপতিত্ব করবেন না, বোর্ডে উপস্থিতও থাকবেন না। কারণটা কী, তাও বললেন না। তখন বোর্ডের জ্যেষ্ঠ সদস্য ও ইউজিসি অধ্যাপক ড. ফকরুল আলম স্যারকে সভাপতির ক্ষমতা অর্পণ করলেন। সব প্রক্রিয়া শেষে যখন নিয়োগের জন্য সুপারিশপ্রাপ্ত প্রার্থীদের তালিকা প্রস্তুত সম্পন্ন হলো, তখন তিনি সামনে এলেন এবং তালিকাটা দেখলেন। বললেন, তার একজন আত্মীয় ওই বোর্ডে প্রার্থী ছিলেন যিনি নিয়োগের জন্য সুপারিশ পাননি। ওই প্রার্থীর কারণেই তিনি সভাপতির চেয়ারে বসেননি। বোর্ডের কোন সদস্য তার আত্মীয়ের প্রতি দুর্বলতা দেখাতে পারেনÑ এ আশঙ্কায় তিনি কারণটি আগে বলেননি। এ ধরনের উচ্চ ব্যক্তিত্বসম্পন্ন নির্মোহ, যোগ্য শিক্ষক দেশে অনেক আছেন। প্রয়োজন শুধু তাদের খুঁজে বের করা ও উপযুক্ত পদে বসানো। আমি আমার শিক্ষা জীবনে এমন শিক্ষকদের দেখেছি, যারা কোটি টাকার বেতনের চাকরির জন্যও কারও কাছে ধরনা দিতেন বা তদবির করতেন বলে মনে হয় না।
তাদেরকে কখনও ডিন বা উপাচার্যের কক্ষের সামনে ধরনা দিতে দেখিনি। আমলা বা রাজনৈতিক নেতাদের কাছে ধরনা দেয়ার তো প্রশ্নই ওঠে না। সাবেক রাষ্ট্রপতি হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদের শাসনামলে আমার একজন শিক্ষককে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হওয়ার প্রস্তাব দেয়া হলে তিনি সেটা গ্রহণ করেননি, কারণ প্রস্তাবের সঙ্গে নাকি এমন কিছু শর্ত ছিল যা তার ব্যক্তিত্বের সঙ্গে যায় না। অভিজ্ঞতার ভিত্তিতেই হয়তো সাবেক শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদসহ আরও একজন সাবেক সিনিয়র মন্ত্রীকে বলতে শুনেছি, ‘আগে ভাবতাম উপাচার্য হওয়ার জন্য শিক্ষকমণ্ডলীকে রাজি করানোই যাবে না, কারণ তারা সব সময় শিক্ষা-গবেষণায় মশগুল থাকেন। কিন্তু এখন দেখছি তারাই রাত-দিন ধরনা দিচ্ছেন উপাচার্য হওয়ার জন্য।’ এ বক্তব্যটির মধ্যে আংশিক সত্যতা থাকলেও ব্যতিক্রম আছে প্রচুর। ধরনা দেন না, এমন প্রচুর নির্মোহ, পণ্ডিত, যোগ্য শিক্ষক আছেন। এখন যদি শুধু তদবিরকারী শিক্ষকদের মধ্য থেকেই উপাচার্য নিয়োগ দেয়া হয়, তাহলে আমরা আর কী আশা করতে পারি?
বিশ্ববিদ্যালয়ের বাইরে শিক্ষা প্রশাসনের কেন্দ্রে এবং গুরুত্বপূর্ণ পদে অশিক্ষক কর্মকর্তারা নিয়োগ পেয়ে থাকেন। প্রধান শিক্ষক ও অধ্যক্ষ পদের বাইরে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তর, এনসিটিবি, শিক্ষা বোর্ড, কিছু প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠানসহ অল্প দু-একটা শিক্ষা-সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানে বিসিএস (সাধারণ শিক্ষা) ক্যাডারের শিক্ষক-কর্মকর্তা পরিচয়ে পদায়ন পেয়ে থাকেন। কিন্তু এসব পদে তদবির ছাড়া কেউ কখনও নিয়োগ পেয়েছেন বলে শুনিনি।
এখানে একটা মজার ব্যাপার ঘটে। তদবিরকারীদের (অধিকাংশ ক্ষেত্রে যারা যোগ্য নন) শিক্ষা খাতের এসব গুরুত্বপূর্ণ পদে যারা নিয়োগ দিয়ে থাকেন, তারাই আবার পরে গল্প করে বলেন, শিক্ষকরা প্রশাসনিক কাজে অযোগ্য ও অদক্ষ। অযোগ্য লোক শুধু শিক্ষকতা পেশায় নয়, সব পেশাতেই আছে। আর আছে বলেই সামরিক-বেসামরিক প্রশাসনের গুরুত্বপূর্ণ পদে নিয়োগের আগে বহু যাচাই-বাছাই করে ফিটলিস্ট তৈরি করা হয় এবং ফিটদেরকেই গুরুত্বপূর্ণ পদের জন্য বিবেচনা করা হয় (সেটা শতভাগ নির্ভেজাল না হলেও, সেখানে ভেজাল ছেঁকে ফেলার একটা প্রচেষ্টা ও সুযোগ থাকে)।
যোগ্যদের খোঁজা যাদের দায়িত্ব তারা সেটা করেন না। অযোগ্যদেরই বেছে নেয়া হয় অযোগ্যদেরই চাহিদার ভিত্তিতে। তারপর অযোগ্যতার ট্যাগ লাগিয়ে দেয়া হয় পুরো শিক্ষক সম্প্রদায়ের গায়ে। এ অজুহাতের ভিত্তিতেই আবার শিক্ষকদের শিক্ষা সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদ থেকে সরিয়ে দেয়ার চেষ্টা চলে। এ দোষারোপ প্রক্রিয়ায়, প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর থেকে শিক্ষা কাডারের শিক্ষক-কর্মকর্তাদের সরিয়ে দেয়া হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়েও অশিক্ষক আমলাদের বসালে কী প্রতিক্রিয়া হয়, তা আঁচ করার জন্য সম্প্রতি শেরে বাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে একজন অশিক্ষক কর্মকর্তাকে (রেজিস্ট্রার) উপাচার্যের সাময়িক দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল। বাংলাদেশের ইতিহাসে এটা নজিরবিহীন এবং প্রথম ঘটনা। এ ঘটনার ফলে শিক্ষক সমাজ থেকে যথারীতি নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া হলে আর একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে একজন শিক্ষক রেজিস্ট্রারকে একইভাবে উপাচার্যের সাময়িক দায়িত্ব দিয়ে সরলীকরণ করার চেষ্টা করা হয়।
শুধু তদবিরকারীদের প্রয়োজন বিবেচনা না করে, দেশের স্বার্থকে প্রধান বিবেচনা করে গুরুত্বপূর্ণ পদে সৎ ও যোগ্য মানুষকে নিয়োগ দিতে হবে। শিক্ষা খাতের বিভিন্ন গুরুত্ব পদে নিয়োগের লক্ষ্যে সুপারিশ করার জন্য কয়েকজন নির্মোহ ও বিদগ্ধ শিক্ষাবিদ দ্বারা বিভিন্ন স্তরের শিক্ষা প্রশাসনের জন্য আলাদা কমিটি গঠন করা যেতে পারে। এ কমিটিতে অন্তর্ভুক্তির জন্য তদবির করাকে শুরুতেই অযোগ্যতা বিবেচনা করতে হবে। যাদের সন্তানেরা বিদেশে পড়াশোনা করে তাদেরও এ কমিটিতে রাখা সমীচীন হবে না। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক নিয়োগের জন্য অনুরূপ নির্মোহ ও বিদগ্ধ শিক্ষাবিদ দ্বারা একটা অভিন্ন নীতিমালা প্রণয়ন ও অনুসরণ করা যেতে পারে। সুপারিশপ্রাপ্ত ও অকৃতকার্য- সব প্রার্থীর অ্যাকাডেমিক ফলাফল, লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষার নম্বরসহ মোট স্কোর প্রকাশ করলে অযোগ্য শিক্ষক নিয়োগের দুর্নাম ঘোচানো সম্ভব। শুধু শিক্ষা প্রশাসন নয়, সব প্রশাসনে অযোগ্য ও দুর্নীতিবাজদের জবাবদিহিতার মধ্যে আনা ও অপসারণের পদ্ধতি ও রেওয়াজ দাঁড় করাতে হবে। এদেশে দুর্র্নীতি একটা বড় অভিশাপ; কিন্তু দুর্র্নীতিবাজদের শাস্তি পাওয়ার ঘটনা খুবই কম।
পদলোভী তদবিরবাজ, ধরনাধারীদের কাছ থেকে আমরা সৎ, মহৎ, মহানুভব কর্মকাণ্ড আশা করতে পারি না। আত্মমর্যাদাবোধসম্পন্ন, রুচিশীল, সুশিক্ষিত শিক্ষকরা কখনও ধরনা ধরেন না, তদবির করেন না। কিন্তু, আমরা যদি শুধু ধরনাধারী, তদবিরবাজদেরই উপযুক্ত ব্যক্তি হিসেবে বাছাই করে পদায়ন করি, তাহলে যা হওয়ার সেটাই হবে বা হচ্ছে; আম গাছে আমই ধরছে, জাম ধরছে না।
আত্মমর্যাদাবোধসম্পন্ন, রুচিশীল, সুশিক্ষিত, সৃষ্টিশীল শিক্ষককে খুঁজে বের করা এবং দায়িত্বে বসানো সরকারের দায়িত্ব। জাতির বৃহত্তর স্বার্থে সততা, নিষ্ঠা ও যতেœর সঙ্গে এ মহৎ দায়িত্বটি পালন করতে হবে।
লেখক : মো. মুনিবুর রহমান, সহকারী অধ্যাপক, ইংরেজি বিভাগ, যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়