করোনা ভাইরাসের নিষ্ঠুর আক্রমণের কাল সামনের মার্চ মাসে এক বছর পূর্ণ হবে। করোনা ভাইরাসের এক বছর পূর্তি উপলক্ষ্যে আমরা যদি করোনা ভাইরাসের তাণ্ডবের সঠিক চিত্র পর্যালোচন করতে বসি, তাহলে দেখা যাবে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে বিশ্ব যে ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছিল, যে মানুষের মৃত্যু এবং সম্পদ হারানোর অভিজ্ঞতা মানুষ অর্জন করেছিল, করোনার আক্রমণে এবার মানুষের প্রাণহানি এবং অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের পরিমাণ তুলনামূলকভাবে তার চেয়ে অনেক বেশি। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে বিশ্বের সব দেশ হয়তো আক্রান্ত হয়নি; কিন্তু করোনা ভাইরাস দ্বারা এবার কমবেশি বিশ্বের সব দেশই আক্রান্ত হয়েছে। বিশ্বের এমন কিছু দেশ আছে, যারা চিকিত্সাবিজ্ঞানে অনেক উন্নত, করোনার আক্রমণ থেকে তারাও রক্ষা পায়নি। উদাহরণ হিসেবে আমরা ইউরোপ-আমেরিকার কথা উল্লেখ করতে পারি। এসব উন্নত দেশে করোনায় প্রাণহানির সংখ্যা তুলনামূলকভাবে বেশি। বৃহস্পতিবার (২৫ফেব্রুয়ারি) সমকাল পত্রিকায় প্রকাশিত এক নিবন্ধে এ তথ্য জানা যায়।
নিবন্ধে আরও জানা যায়, বাংলাদেশ অত্যন্ত ঘনবসতিপূর্ণ দেশ। মানুষের আর্থিক অবস্থা তেমন ভালো নয়। স্বাস্থ্যরক্ষা সম্পর্কে সচেতনতার অভাব। আশঙ্কা করা হয়েছিল করোনা মহামারিতে এ দেশের লাখ লাখ মানুষের মৃত্যু ঘটবে; কিন্তু আল্লাহর রহমতে বাস্তবে তেমনটি ঘটেনি। শহর এলাকার মানুষ করোনায় আক্রান্ত হলেও গ্রামবাংলার মানুষ প্রায় করোনামুক্ত জীবন কাটিয়েছে। বাংলাদেশ মূলত গ্রামনির্ভর দেশ। গ্রামগুলো করোনামুক্ত থাকার ফলে এখানে প্রাণহানির সংখ্যা তুলনামূলকভাবে কম হয়েছে।
বাংলাদেশে করোনাকে মোকাবিলা করতে গিয়ে বর্তমান সরকারের সময়োপযোগী পদক্ষেপসমূহ প্রশংসনীয়। উদাহরণস্বরূপ দেশের মানুষের জীবন ও জীবিকার বিষয়টি আলোচনায় নিয়ে আসা যায়। মানুষের জীবন ও জীবিকা অবিচ্ছিন্ন। করোনার দাপটে দেশের অর্থনৈতিক মেরুদণ্ড যাতে ভেঙে না পড়ে, সেদিক বিবেচনা করে অত্যন্ত ঝুঁকি নিয়েই মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পোশাকশিল্পসহ বিভিন্ন শিল্পকারখানা খোলা রাখার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছিলেন। তাতে ভালো ফল হয়েছে—বিদেশের বাজার হাতছাড়া হয়নি এবং দেশের মানুষ বড় রকমের অর্থনৈতিক সংকটের মধ্যে পড়েনি। শিল্পকারখানা সময়মতো খুলে না দিলে দেশের অসংখ্য মানুষ অনাহারে মারা যেত। শিল্পকারখানা, ব্যবসায়-বাণিজ্য চালু রেখে আওয়ামী লীগ সরকার দূরদর্শিতার পরিচয় দিয়েছে। কলকারখানার সঙ্গে অফিস-আদালতের সম্পৃক্ততা রয়েছে, যার ফলে সীমিত আকারে অফিস-আদালত খোলা রাখার যে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল, তারও সুফল দেশের মানুষ পেয়েছে।
কলকারখানা, অফিস-আদালত, ব্যবসায়-বাণিজ্য খোলা থাকলেও সরকারি নির্দেশে দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখা হয়েছে। এ নিয়ে দেশে নানা রকম তর্কবিতর্ক দেখা দিয়েছে। কোনো কোনো পণ্ডিত ব্যক্তি যুক্তি দেখিয়ে বলতে চাইছেন কলকারখানা, অফিস-আদালত, ব্যবসায়-বাণিজ্য যখন চলছে, তখন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোও খোলা রাখা উচিত। কোমলমতি শিক্ষার্থীদের সঙ্গে যারা শ্রমিকদের তুলনা করেন, তাদের বিবেক-বিবেচনা নিয়ে কিছু প্রশ্ন উঠতেই পারে। করোনা মোকাবিলার ক্ষেত্রে শ্রমিকদের দেহে যে প্রতিরোধক্ষমতা আছে, কোমলমতি শিক্ষার্থীদের দেহে সে প্রতিরোধ ক্ষমতা নেই। কাজেই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান না খোলার সরকারি সিদ্ধান্ত ছিল অত্যন্ত সঠিক এবং বাস্তবসম্মত। উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষার্থীদের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত গ্রহণে বড় রকমের একটা জটিলতা দেখা দিয়েছিল। সময় একটু বেশি লাগলেও মাননীয় প্রধানমন্ত্রী এবং শিক্ষামন্ত্রী মহোদয় যে পদ্ধতিতে উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষার্থীদের পরীক্ষার ফলাফল ঘোষণা করেছেন, তাতে সব মহল খুশি হয়েছে এবং সরকারের সিদ্ধান্তকে সব পক্ষই অত্যন্ত আন্তরিকতার সঙ্গে মেনে নিয়েছে। উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষার ফলাফল ঘোষিত হওয়ার পর শিক্ষার্থীরা তাদের উচ্চশিক্ষার কেন্দ্রবিন্দু বিশ্ববিদ্যালয় খোলার দিকে তাকিয়েছে। সরকারও তাদের বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় তথা সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার একটা নির্দিষ্ট তারিখ ঘোষণা করেছেন। সামনে রমজান মাস। রোজার মধ্যে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলা রাখায় নানা রকম জটিলতা দেখা দেয়। কাজেই সরকার অনেক চিন্তাভাবনা করে রোজার ঈদের পর মে মাসে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো খুলে দেওয়ার সিদ্ধান্ত দেশবাসীকে জানিয়ে দিয়েছেন। পাশাপাশি এ কথাও জানিয়ে দেওয়া হয়েছে—অনলাইনে ডিজিটাল পদ্ধতিতে শিক্ষার্থীদের পঠনপাঠনের কাজ অব্যাহত থাকবে। স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীদের মধ্য থেকে সরকারের এই ঘোষণার প্রতিবাদ আমাদের চোখে পড়েনি, তবে বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু শিক্ষার্থী সরকারের এই সিদ্ধান্তকে মেনে নিতে পারেনি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের কতিপয় শিক্ষার্থী তাদের হলের তালা ভেঙে হলে অবস্থান গ্রহণ করেছে, এমন কিছু ঘটনা দেশের টেলিভিশনের মাধ্যমে আমাদের দৃষ্টিগোচর হয়েছে। তালা ভেঙে শিক্ষার্থীদের হল দখল করার দৃশ্যটি দেশবাসীর কাছে অশোভন বলেই মনে হয়েছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এবং জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ বিষয়টি মোকাবিলা করতে গিয়ে কঠোর অবস্থান গ্রহণ করায় ধারণা করা যায়, শিক্ষার্থীরা হল ছেড়ে দিতে বাধ্য হবে। সরকারের সিদ্ধান্তের সঙ্গে মিলিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ইতিমধ্যে ঘোষণা দিয়েছেন—ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলো খুলে দেওয়া হবে ১৭ মে এবং ক্লাস শুরু হবে ২৪ মে। আশা করা যায়, দেশের অন্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলো একই সময়ে খুলে দেওয়া হবে। আমি যখন লেখাটি তৈরি করতে বসেছি, টেলিভিশনের দিকে তাকিয়ে দেখলাম আজও দেশে করোনায় ১৮ জন মানুষের মৃত্যু হয়েছে এবং ৪০০ জন আক্রান্ত হয়েছে। কাজেই আমরা করোনামুক্ত হয়ে গেছি—এ কথা মনে করার কোনো কারণ নেই।
বিশ্ববিদ্যালয় খুলে দেওয়া না হলেও সরকারের পক্ষ থেকে স্পষ্ট নির্দেশ আছে, অনলাইনে ডিজিটাল পদ্ধতিতে শিক্ষার্থীদের পঠনপাঠন অব্যাহত থাকবে। মাঝেমধ্যে প্রশ্ন তোলা হচ্ছে—গ্রামে যারা বসবাস করছে, নেটওয়ার্ক সমস্যায় তাদের পঠনপাঠনে বিঘ্ন ঘটছে। অভিযোগটির সত্যতা হয়তো অগ্রাহ্য করা যাবে না। তবে আমাদের দেশের যোগাযোগ ব্যবস্থার এতটাই উন্নতি হয়েছে যে, অজ পাড়াগাঁয়ে যে শিক্ষার্থীটি অবস্থান করে, তার কাছের উপজেলা শহরে উপস্থিত হতে সর্বোচ্চ এক ঘণ্টার বেশি সময় লাগবে না। উপজেলা শহরে গেলে নেটওয়ার্ক সে পাবে। কাজেই সদিচ্ছা থাকলে কাছের উপজেলা শহরে গিয়ে নিয়মিত ক্লাস করার ব্যবস্থা করা তার জন্য এমন কোনো কঠিন কাজ নয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক শিক্ষার্থী টঙ্গী, জয়দেবপুর, উত্তরা থেকে প্রতিদিন দুই-তিন ঘণ্টা ধরে পথ পাড়ি দিয়ে ক্লাস করে থাকে। সে তুলনায় অনেক কম সময়ের মধ্যে গ্রামের শিক্ষার্থীরা উপজেলা শহরে গিয়ে অনলাইন ক্লাসে যোগদান করতে সমর্থ হবে। এজন্য প্রয়োজন শিক্ষার্থীদের সদিচ্ছা। হলে অবস্থান করতে গেলে তাদের যে অর্থের প্রয়োজন হয়, তার চেয়ে অনেক কম খরচে স্থানীয় উপজেলা শহরে অবস্থান করে অনলাইনে তারা ক্লাস করতে সমর্থ হবে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন হলে অংশগ্রহণের জন্য যেসব শিক্ষার্থী শক্তি প্রয়োগের পথ বেছে নিয়েছে, তারা সত্যিকার অর্থে ক্লাস করার জন্য এ আন্দোলন করছে, নাকি তাদের অন্য কোনো উদ্দেশ্য আছে—তা একটু খতিয়ে দেখা প্রয়োজন। আমার নাতি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘রোবোটিকস অ্যান্ড মেকাট্রোনিকস ইঞ্জিনিয়ারিং’ বিভাগের মেধাবী ছাত্র। রাজশাহী আমার বাসায় অবস্থান করে নিয়মিত অনলাইনে তাকে ক্লাস করতে দেখি। কোনো অসুবিধে হচ্ছে না। তার সঙ্গে কথা বলে জানতে পারলাম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হল খোলার আন্দোলনে যেসব শিক্ষার্থী নেতৃত্ব দিচ্ছে, তারা অধিকাংশই প্রাইভেট পড়িয়ে প্রচুর অর্থ উপার্জন করে থাকে। হল খোলা না থাকায় তাদের প্রাইভেট পড়িয়ে অর্থ উপার্জনের পথে অনেক সমস্যা দেখা দিয়েছে। হল খোলা রাখার জন্য যারা পীড়াপীড়ি করছে, বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের ওপর চাপ প্রয়োগ করছে, তাদের চাপের মুখে হল খুলে দেওয়ার পর যদি করোনায় কোনো শিক্ষার্থীর মৃত্যু ঘটে, তাহলে সে জন্য ঐ শিক্ষার্থীরাই বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে দায়ী করবে; স্লোগান উঠবে—‘করোনায় ছাত্র মরল কেন? কর্তৃপক্ষ জবাব চাই’। কাজেই কতিপয় স্বার্থান্বেষী শিক্ষার্থীর দাবির মুখে সরকার এবং বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ নতি স্বীকার করেনি। এটি উত্তম পদক্ষেপ বলে শিক্ষার্থী-অভিভাবকরা মনে করেন। করোনা প্রতিষেধক টিকা নেওয়ার আগে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো খোলা ঠিক হবে না। রোজার ছুটির আগে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো না খোলার সরকারি সিদ্ধান্তকে দেশের মানুষ যথার্থ বলেই মেনে নিয়েছে। শিক্ষার্থীদের অভিভাবকবৃন্দ চিন্তামুক্ত হয়েছেন।
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসমূহ খোলার আগে সরকারের এখন প্রধান দায়িত্ব হবে শিক্ষক এবং শিক্ষার্থীদের করোনার টিকা প্রদান সম্পন্ন করা। বিভিন্ন পরিসংখ্যান থেকে জানা গেছে, মহানগর এলাকায় করোনার তাণ্ডব যত ব্যাপক, উপজেলা এলাকায় করোনার তেমন ব্যাপকতা নেই। কাজেই ধাপে ধাপে শিক্ষক এবং শিক্ষার্থীদের টিকার ব্যবস্থা করে ফেলতে হবে। সরকার চাইলে দেশের অধিকাংশ শিক্ষক-শিক্ষার্থীকে মার্চ-এপ্রিল মাসের মধ্যে টিকার আওতায় নিয়ে আসা সম্ভব। প্রথম ডোজ আগে হয়ে যাক, দ্বিতীয় ডোজের জন্য কালক্ষেপণের কোনো দরকার নেই। টিকা যারা নেবেন, প্রত্যেকের হাতেই রেজিস্ট্রেশন কার্ড থাকবে। রেজিস্ট্রেশন কার্ড থাকলে যে কোনো টিকা কেন্দ্র থেকে সে দ্বিতীয় ডোজ টিকা গ্রহণ করতে পারবে—এ রকম ব্যবস্থা থাকলে আশা করি কোনো রকম সমস্যা হবে না।
মোটকথা মে মাসে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো খোলার আগে দেশের সব শিক্ষক ও শিক্ষার্থীকে বাধ্যতামূলকভাবে টিকার আওতায় নিয়ে আসতে হবে। এ ব্যাপারে শৈথিল্য প্রদর্শনের কোনো রকম সুযোগ দেওয়া সমীচীন হবে না।
লেখক : প্রফেসর ড. আবদুল খালেক, সাবেক ভিসি, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়