শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অবাঞ্ছিত কর্মসূচি বাস্তবায়নের চাপ - দৈনিকশিক্ষা

শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অবাঞ্ছিত কর্মসূচি বাস্তবায়নের চাপ

মো. রহমত উল্লাহ্ |

ঢাকাসহ বড় শহরের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো যেন দেশি-বিদেশি বিভিন্ন সংস্থা, সংগঠন ও প্রতিষ্ঠানের কর্মসূচি বাস্তবায়নের উর্বর ক্ষেত্র! প্রায়শই দেখা যায়, ডায়েরি, ক্যালেন্ডার ও অন্যান্য গিফটসহ কিছু কাগজপত্র নিয়ে বিভিন্ন দেশি-বিদেশি এনজিও কর্মীরা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এসে তাদের বিভিন্ন কর্মসূচি বাস্তবায়ন করার জন্য প্রচেষ্টা চালায়। যেমন: শিক্ষার্থী ও তাদের পরিবার সম্পর্কিত বিভিন্ন রকম জরিপ করা, বিনামূল্যে বা স্বল্পমূল্যে শিক্ষার্থীদের ব্লাড গ্রুপ নির্নয় করা, নির্ধারিত ফি নিয়ে শিক্ষার্থীদের নাম রেজিস্ট্রেশন করে বিভিন্ন অনলাইন ও অফলাইন কোর্সে এবং প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করানো, প্রাইভেট হসপিটাল থেকে মেডিক্যাল চেকআপ ও টেস্ট করানোর ক্ষেত্রে ডিসকাউন্ট পাওয়ার জন্য শিক্ষার্থীদের নাম রেজিস্ট্রেশন করা ইত্যাদি।

অতি সম্প্রতি যুক্ত হয়েছে শিশুশিক্ষার্থীদের বিনামূল্যে কোভিড টেস্ট করা। অনেক সময় প্রভাবশালী ব্যক্তিদের রেফারেন্স এবং সরকারি বিভিন্ন দপ্তরের কর্মকর্তাদের স্বাক্ষরিত চিঠিপত্রের ফটোকপিও থাকে তাদের হাতে। সেসব সংগঠন ও প্রতিষ্ঠানের বৈধতা এবং চিঠিপত্রের সত্যতা যাচাই করা প্রতিষ্ঠানপ্রধানের জন্য বেশ কষ্টসাধ্য ও সময়সাপেক্ষ হয়। তাছাড়া তাদের মান, নীতি, আদর্শ, উদ্দেশ্য, দৃষ্টিভঙ্গি, সম্পৃক্ততা, নির্ভরযোগ্যতা ইত্যাদি সম্পর্কেও নিশ্চিত হতে পারেন না প্রতিষ্ঠানপ্রধান। তাঁর প্রতিষ্ঠানের নির্ধারত কার্যক্রম ও সরকারি আদেশ-নির্দেশ পালনের পর এসব বাড়তি বিষয় নিয়ে মাথা ঘামানোর সময়-সুযোগ কই? তাই এমন পরিস্থিতিতে চরমভাবে বিব্রত হতে হয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রধানকে। অনেকেই বুঝে উঠতে পারেন না যে, এসব কর্মসূচি বাস্তবায়নে শিক্ষার্থীদের সম্পৃক্ত করা উচিত হবে কি হবে না! তদুপরি এসব সংগঠন ও প্রতিষ্ঠানের সাথে শিক্ষার্থীদের সম্পৃক্ত করে দেয়া ঠিক হবে কিনা! সরকারি দপ্তরের কর্মকর্তা বা অন্য কোন ব্যক্তি কর্তৃক স্বাক্ষরিত যে পত্রের ফটোকপি প্রদর্শন করা হয় সেটি আসলে সঠিক কি না! এ সকল কর্মসূচি বাস্তবায়ন করতে দেয়া না হলে কোনোরকম অসুবিধা হবে কি না বা সরকারি আদেশ অমান্য হবে কি না। অপরদিকে এ সুযোগ দেওয়া হলে শিক্ষার্থীদের লেখাপড়া যতটুকু বিঘ্নিত হবে এবং শিক্ষার্থীরা যদি কোন ঝামেলায় পড়ে তাহলে যে অসুবিধা হবে সেগুলো কর্তৃপক্ষ ও অভিভাবক মেনে নেবেন কি না, নৈতিক হবে কি না তাও ভাবনার বিষয়।

তাছাড়া বিভিন্ন দেশি-বিদেশি কোম্পানির প্রতিনিধিরা তাদের উৎপাদিত পণ্য/খাদ্যসামগ্রীর বিক্রয় বৃদ্ধির লক্ষ্যে শিক্ষার্থীদের মধ্যে প্রচারণা চালাতে বারবার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে আসে। তাদের সেই প্রচারণা চালানোর সুযোগ নেয়ার জন্য রেফারেন্স করে বিভিন্ন কর্তা ও নেতা ব্যক্তির নাম। বিভিন্ন কৌশলে জানান দেয়, কোন কোন বড় বড় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে তাদের পণ্যের প্রচারণা চালিয়েছে, কোন কোন বিশিষ্ট ব্যক্তির উপস্থিতিতে। এও জানায় যে, কোন কোন প্রতিষ্ঠানে কীভাবে চালিয়েছে তাদের এই পণ্যপ্রচার কার্যক্রম। সে সাথে প্রতিষ্ঠানপ্রধান, শিক্ষক-কর্মচারী ও শিক্ষার্থীদের জন্য দিয়ে থাকে বিভিন্ন লোভনীয় অফার। যেমন: স্যানিটারি প্যাড, টুথপেস্ট, গুড়া দুধ, চকলেট, চিপস, ড্রিংস, বার ইত্যাদি ফ্রি দেওয়া হবে সবাইকে। শিক্ষার্থী ও কর্মচারীদের দেওয়া হবে দু'একটি করে, শিক্ষকদের দেওয়া হবে তার চেয়েও কিছু বেশি, প্রতিষ্ঠান প্রধানকে দেওয়া হবে সবচেয়ে বেশি। এর বিনিময়ে শিক্ষার্থীদের মধ্যে চালানো হবে বিভিন্ন ইভেন্ট, করা হবে তাদের পণ্যের গুণকীর্তন; যাতে সফল হয় সেই পণ্যের প্রচারণা।

সেই ইভেন্টগুলো হতে পারে শিক্ষার্থীদের এসেম্বলিতে ও শ্রেণিকক্ষে। সুযোগ পেলে শ্রেণিকক্ষে যেতেই তারা বেশি আগ্রহ প্রকাশ করে থাকে। তাছাড়া ক্লাস চলাকালে স্কুলের মাঠে এনে রাখতে চায় তাদের পণ্যের ব্যানার-পোস্টার দিয়ে বিশেষ ভাবে সাজানো গাড়ি। সেই গাড়ি থেকে শিক্ষার্থীদের পরিবেশন করতে চায় গরম গরম পানীয় বা খাবার। হয়ত বিভিন্ন লোভনীয় অফারে বা অন্য কোনো উদ্দেশ্যে এসব প্রস্তাবে সম্মতি দিয়ে থাকেন কোনো কোনো প্রতিষ্ঠানপ্রধান ও শিক্ষকগণ। সেক্ষেত্রে হয়ত শিক্ষকের জন্য নির্ধারিত ক্লাসের ২/১ ঘণ্টা সময় দিয়ে দেন কোম্পানি বা এনজিও কর্মীরদের। সে সুযোগে তারা শিক্ষার্থীদের দেন তাদের পণ্যের পাঠ। আর বেকার থাকেন বেতনভুক্ত শিক্ষক। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বিরাজ করে একটি ভিন্ন রকম পরিবেশ। তাতে নিশ্চয়ই বিঘ্নিত হয় সংশ্লিষ্ট শিক্ষার্থীদের জন্য শিক্ষাবোর্ড কর্তৃক নির্ধারিত পাঠের মনোযোগ ও লেখাপড়া। 

এ অবস্থায় এসব বিষয়ে শিক্ষামন্ত্রণালয় থেকে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহকে কিছু সুনির্দিষ্ট নির্দেশনা দেয়া অত্যন্ত জরুরি। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অন্যান্য সংগঠন বা প্রতিষ্ঠানের অবাঞ্ছিত ইভেন্ট যত কম থাকবে, বা না থাকবে ততই মঙ্গল। তথাপি শিক্ষামন্ত্রণালয় যদি মনে করে, সবদিক বিবেচনা করে অন্য কোনো মন্ত্রণালয়ের বা দপ্তরের বা এনজিওর কোন সুনির্দিষ্ট কর্মসূচি বা ইভেন্ট শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বাস্তবায়ন করা প্রয়োজন, তাহলে ওই আদেশসংবলিত পত্রটি শিক্ষামন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন কর্তাব্যক্তির স্বাক্ষরে বা মাধ্যমে সরাসরি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের নির্ধারত মেইলে প্রেরণ করা উচিত। 


লেখক : মো. রহমত উল্লাহ্, অধ্যক্ষ, কিশলয় বালিকা বিদ্যালয় ও কলেজ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা।
 

শিক্ষায় বরাদ্দ বেড়েছে, আরো বাড়বে: শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী - dainik shiksha শিক্ষায় বরাদ্দ বেড়েছে, আরো বাড়বে: শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী সমাবর্তনের অজুহাতে সনদ আটকে রাখা যাবে না - dainik shiksha সমাবর্তনের অজুহাতে সনদ আটকে রাখা যাবে না হিটস্ট্রোকে স্কুলছাত্রীর মৃত্যু - dainik shiksha হিটস্ট্রোকে স্কুলছাত্রীর মৃত্যু চুয়েটে আন্দোলন স্থগিত, সড়কে যান চলাচল শুরু - dainik shiksha চুয়েটে আন্দোলন স্থগিত, সড়কে যান চলাচল শুরু প্রাথমিকের প্রশ্ন ফাঁসে অল্পদিনে কয়েকশ কোটি টাকা আয় - dainik shiksha প্রাথমিকের প্রশ্ন ফাঁসে অল্পদিনে কয়েকশ কোটি টাকা আয় রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম সংবিধানবিরোধী নয়: হাইকোর্ট - dainik shiksha রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম সংবিধানবিরোধী নয়: হাইকোর্ট কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0067670345306396