করোনাকালে বন্ধ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলার পর শিক্ষার্থীরা মেতে উঠেছে উৎসবের আমেজে। টানা দেড় বছর পর ব্যাপক উৎসাহ-উদ্দীপনায় প্রিয় শ্রেণীকক্ষে বসল তারা। ফুল, চকোলেট, মাস্ক ও হ্যান্ড স্যানিটাইজার দিয়ে তাদের স্বাগত জানাল শিক্ষকরা। কোন কোন স্কুলে বাদ্যযন্ত্র বাজিয়ে বরণ করা হয় শিক্ষার্থীদের। দীর্ঘ ছুটির পর শিক্ষার্থীদের শ্রেণীকক্ষে পেয়ে শিক্ষকদের মধ্যেও ছিল খুশির আমেজ। শ্রেণীকক্ষগুলো পরিণত হয় মিলনমেলায়। রাজধানীর সব প্রান্তের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেই ছিল উৎসবের আমেজ। প্রথম দিন যথারীতি স্বাস্থ্যবিধি মেনেই বিদ্যালয়ে প্রবেশ করে শিক্ষার্থীরা। স্বাস্থ্যবিধি মানতে শিক্ষকদের পাশাপাশি অভিভাবকদের তৎপরতাও ছিল চোখে পড়ার মতো। শিক্ষকরা শিক্ষার্থীদের বুঝিয়ে দিচ্ছিলেন কিভাবে স্বাস্থ্যবিধি মেনে শ্রেণীকক্ষে প্রবেশ করতে হবে ও শ্রেণীকক্ষে বসবে। অভিভাবকরাও দীর্ঘদিন পর তাদের সন্তানদের বিদ্যালয়ে নিয়ে আসতে পেরে খুশি। তাদের অনেকেই জানিয়েছেন, এতদিন ছেলেমেয়েরা বাসায় থাকার কারণে অস্থির হয়ে থাকত। এখন বিদ্যালয় খোলার কারণে কিছুটা স্বস্তি ফিরে এসেছে। সংক্রমণের নিম্নমুখী প্রবণতায় আবারও প্রাণ ফিরেছে দেশের স্কুল-কলেজগুলোতে। সর্বোচ্চ স্বাস্থ্যবিধি নিশ্চিত করে এবার থেকে আবারও নিয়মিত জীবনযাপনে ফিরবে শিক্ষার্থীরা। সেই চিরচেনা স্কুল ড্রেস, কাঁধে বইয়ের ব্যাগের সঙ্গে এবার নতুন পরিধান যোগ হয়েছে মাস্ক। তবে দীর্ঘদিন পর স্কুল খুললেও সহপাঠীদের সঙ্গে আগের সেই হইহুল্লোড় নেই। সামনের বেঞ্চ ধরা নিয়ে নেই হুড়োহুড়িও। শিক্ষকদের নির্দেশনা মেনে শিক্ষার্থীরা দূরত্ব বজায় রেখে প্রবেশ করছে প্রিয় অঙ্গনে। তবে কয়েকজন অভিভাবক জানান, সময়মতো স্কুল ড্রেস তৈরি না হওয়ায় অনেক শিক্ষার্থী প্রথম দিন আসতে পারেনি। প্রথম দিন সারাদেশে গড়ে ৮০ শতাংশ শিক্ষার্থীর উপস্থিতি ছিল বলে জানিয়েছে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদফতর (মাউশি)। শিক্ষা এবং প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীনে সারাদেশে প্রায় এক লাখ সাড়ে পাঁচ হাজার শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শ্রেণী কার্যক্রম শুরু হয়েছে। সোমবার (২০ সেপ্টেম্বর) জনকণ্ঠ পত্রিকায় প্রকাশিত এক নিবন্ধে এ তথ্য জানা যায়।
নিবন্ধে আরও জানা যায়, বিগত ৫ সেপ্টেম্বর শিক্ষামন্ত্রীর সভাপতিত্বে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের সম্মেলন কক্ষে অনুষ্ঠিত উচ্চপর্যায়ের বৈঠকে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলার সিদ্ধান্ত নেয়াসহ বেশকিছু দিকনির্দেশনা আসে। এর মধ্যে প্রথম দিন চার-পাঁচ ঘণ্টা ক্লাস হবে, পর্যায়ক্রমে ক্লাসের সংখ্যা আরও বাড়বে। শ্রেণীকক্ষে পাঠদানকালে শিক্ষার্থী-শিক্ষকসহ সবাইকে মাস্ক পরিধান করতে হবে। শুরুর দিকে ২০২১ সালে যারা এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষার্থী তাদের প্রতিদিন স্কুলে আসতে হবে। পঞ্চম শ্রেণীর শিক্ষার্থীরাও প্রতিদিন ক্লাসে আসবে। স্কুলে প্রবেশের ক্ষেত্রে শিক্ষার্থীদের সারিবদ্ধভাবে প্রবেশ করাতে হবে। স্কুলে আপাতত কোন এ্যাসেম্বলি হবে না। তবে ফিজিক্যাল এ্যাক্টিভিটি বা খেলাধুলা চলবে, যাতে শারীরিক ও মানসিকভাবে শিক্ষার্থীরা ভাল অবস্থানে থাকে। প্রতিটি প্রতিষ্ঠানকে চেকলিস্ট পূরণ করে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে পাঠাতে হবে। র্যান্ডম স্যাম্পলিং করে সংক্রমণের ঝুঁকি থাকলে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ করার সিদ্ধান্তও নেয়া হতে পারে। তাছাড়াও সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের প্রতিদিনের উপস্থিতি সংক্রান্ত তথ্য পাঠাতে নির্দেশ দিয়েছে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদফতর (ডিপিই)। এতে বলা হয়, কোভিড-১৯ সংক্রমণ পরিস্থিতিতে আন্তঃমন্ত্রণালয় সভার সিদ্ধান্তের আলোকে জনস্বাস্থ্য ও স্বাস্থ্যবিধি মেনে বিদ্যালয়গুলোয় ১২ সেপ্টেম্বর বিকেল থেকে রুটিন অনুযায়ী সরাসরি শ্রেণীকক্ষে পাঠদান শুরু হয়েছে। প্রতিদিন বিদ্যালয়ে কতজন শিক্ষার্থী সরাসরি পাঠগ্রহণে উপস্থিত রয়েছে সে সম্পর্কিত তথ্য প্রত্যেক বিভাগের জেলাভিত্তিক সমন্বয় করে নির্ধারিত ছক অনুযায়ী পাঠানোর জন্য অনুরোধ করা হয়েছে। করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে বা দেহে কোন ধরনের উপসর্গের কারণে যদি শিক্ষার্থীরা সশরীরে উপস্থিত হয়ে ক্লাসে যোগদান করতে না পারে তাহলে (যথোপযুক্ত প্রমাণ সাপেক্ষে) তাদের অনুপস্থিত হিসেবে গণ্য করা হবে না। সবাইকে মাস্ক পরে স্কুলে আসার নির্দেশনা রয়েছে। আবার মাস্ক পরার কারণে কোন শিশু শিক্ষার্থী অসুস্থ হয়ে পড়ে কি না, সে বিষয়েও শিক্ষকদের দৃষ্টি রাখতে বলা হয়েছে।
প্রধানমন্ত্রীও বলেন, দীর্ঘদিন পর গত ১২ সেপ্টেম্বর শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খুলে দেয়া হয়েছে এবং ধীরে ধীরে সব স্কুল খুলে যাবে। যার ফলে আবার নতুনভাবে শিক্ষা কার্যক্রম শুরু হবে। তিনি বলেন, আমাদের অত্যন্ত দুর্ভাগ্য আমরা প্রায় দেড় বছরের মতো আমাদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো খুলতে পারিনি। যদিও অনলাইনে বা টেলিভিশনের মাধ্যমে বা ঘরে বসে শিক্ষা কার্যক্রম চলেছে। ঘরই আমার স্কুল- এই ধরনের বহুমুখী কার্যক্রম তার সরকার পরিচালনা করলেও স্কুল বা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যেতে পারার আনন্দ থেকে শিক্ষার্থীদের বঞ্চিত থাকতে হয়েছে। ১৯৯৬ সালে সরকার পরিচালনার সময় বিশ্বমন্দার প্রেক্ষাপট স্মরণ করে সরকারপ্রধান বলেন, আমরা আমাদের সাধ্যমতো চেষ্টা করেছি, নানারকম প্রতিবন্ধকতা-অসুবিধা ছিল। প্রথমবার সরকার গঠন করার পরই বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক মন্দা আর এবার এলো করোনাভাইরাস। এই সবকিছু মিলে যে প্রতিবন্ধকতা এসেছে সেখানে সব থেকে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে আমাদের শিশুরা অর্থাৎ শিক্ষার্থীরা। করোনাকালে শিক্ষা কার্যক্রম সচল রাখতে সংশ্লিষ্টদের ভূমিকার প্রশংসা করে শেখ হাসিনা বলেন, করোনাকালে যখন সবকিছু স্থবির তখন আপনারা যথেষ্ট উদ্যোগ নিয়েছেন, বিশেষ করে যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে কিভাবে শিক্ষা ব্যবস্থাকে শিক্ষার্থীদের কাছে আকর্ষণীয় করা যায়। সেইসঙ্গে জীবন-জীবিকার পথটাও যেন খোলা থকে সেই বিষয়টার দিকে বিশেষ দৃষ্টি দিয়ে আপনারা জাতীয় শিক্ষাক্রমের রূপরেখা ঠিক করেছেন।
শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী সারাদেশে মাধ্যমিক পর্যায়ে প্রায় ৪০ হাজার স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা ও কারিগরি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান রয়েছে। এছাড়া প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীনে সারাদেশে ৬৫ হাজার ৫৬৬টি সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয় রয়েছে। করোনা সংক্রমণের কারণে গত বছরের ১৭ মার্চ থেকে দেশের সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ছুটি ছিল। ১১ সেপ্টেম্বর, ২০২১ সেই ছুটি শেষ হয়। এতদিন এ্যাসাইনমেন্ট, অনলাইন-টিভি ও রেডিওর মাধ্যমে ক্লাস চলেছে। শিক্ষার্থীরা ঘরে বসেই ‘পাঠলাভ’ করেছে। শিক্ষামন্ত্রী ডাঃ দীপু মনির সভাপতিত্বে গত ৬ সেপ্টেম্বর সচিবালয়ে এক আন্তঃমন্ত্রণালয় সভায় উচ্চমাধ্যমিক স্তর পর্যন্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলার বিষয়ে সিদ্ধান্ত হয়। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলার বিষয়ে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের নির্দেশনায় বলা হয়েছে, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহে স্বাস্থ্যবিধি অনুসরণ বিষয়ে স্থানীয় প্রশাসন সার্বক্ষণিক তদারকি করবে। ইউনিফর্মের সঙ্গে নতুন যোগ হয়েছে মাস্ক ও স্বাস্থ্যবিধি নিশ্চিতে সর্বোচ্চ সতর্কতা। সরকারের নির্দেশনা অনুযায়ী বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে চালানো হয়েছে পরিচ্ছন্নতা অভিযান। সব স্কুল-কলেজই নতুনভাবে সেজেছে। একই সঙ্গে করোনার সংক্রমণ ফের বাড়ার শঙ্কায় উদ্বেগ-উৎকণ্ঠাও রয়েছে। স্বাস্থ্যবিধি হুমকি বাড়াতে পারে বলে মন্তব্য করে স্বাস্থ্য অধিদফতরের মুখপাত্র বলেছেন, দীর্ঘদিন পর দেশের স্কুল-কলেজ খোলার ফলে তাতে প্রাণ ফিরেছে শিক্ষক-শিক্ষার্থীর মাঝে সত্যি, কিন্তু স্কুলের সামনে অভিভাবকদের জটলা দেশের করোনা সংক্রমণের বর্তমানের নিম্নমুখিতাকে প্রভাবিত করতে পারে। এজন্য তাদের আরও দায়িত্বশীল হওয়া উচিত। সংক্রমণের এই নিম্নমুখিতায় স্কুল-কলেজ খুলে দেয়া হলেও শিশু-কিশোরদের স্বাস্থ্য সুরক্ষার বিষয়টি মাথায় রাখতে হবে। একে-অপরকে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে উদ্বুদ্ধ করতে হবে যেন কোন অবস্থাতেই সংক্রমণ আগের পর্যায়ে ফিরে না যায়।
এইত গেল ঢাকা শহরের কথা । মফস্বল শহরের চিত্র ভিন্ন এবং দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় জেলাগুলোতে এখন বন্যার সংক্রমক বেশি বিধায় প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ের সরকারী-বেসরকারী স্কুলগুলোতে বন্যার পানি প্রবেশ করেছে কিংবা বন্যার্তদের আশ্রয় কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহার হচ্ছে। পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র জানিয়েছে, সবচেয়ে বন্যাপ্রবণ নদ ব্রহ্মপুত্রের পানিও বাড়ছে। আশঙ্কা রয়েছে এই নদের অববাহিকাও প্লাবিত হওয়ায় ব্রহ্মপুত্র, যমুনা ও পদ্মার পানি বৃদ্ধি পাচ্ছে, যা অব্যাহত থাকতে পারে। এছাড়া স্থিতিশীল হতে পারে তিস্তা নদীর পানিও। এ অবস্থায় কুড়িগ্রাম, সিরাজগঞ্জ, পাবনা, কুষ্টিয়া, মানিকগঞ্জ, রাজবাড়ী, ফরিদপুর ও শরীয়তপুর জেলার নিম্নাঞ্চলে বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হতে চলছে। সেই সকল জেলার স্কুল-কলেজের পরিস্থিতি নিয়ে কেউ কোন কথা বলছে না, অথচ সারাদেশে গ্রামের শিক্ষার্থীর সংখ্যাই বেশি। এই ধরনের একটি পরিস্থিতিতে একদিকে করোনা, অপরদিকে ডেঙ্গু আতঙ্কের মাঝে স্কুলে যাওয়ার আনন্দ সারাদেশের শিক্ষার্থীরা কতটুকু ভাগাভাগি করে নিতে পারবে তা শিক্ষাপ্রশাসন ভেবে দেখবে।
এমনিতেই বিগত বছরে করোনার কারণে মানুষের আয় কমেছে এবং ব্যয় বেড়েছে। গ্রামে বাল্যবিবাহসহ তালাকের সংখ্যাও অনেকাংশে বেড়েছে, যা সমাজ চিন্তাবিদদের আশঙ্কার কারণ। তাই আসুন সরকার, শিক্ষার্থী, শিক্ষক ও অভিভাবক মিলে স্বাস্থ্য সুরক্ষার ক্ষেত্রে এমন একটি নজির সৃষ্টি করি যা জাতির কাছে দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে। যেমনটি হয়েছিল ভারতের কেরালা রাজ্যে। যেখানে শিক্ষার হার শতকরা একশত ভাগ। করোনায় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান দীর্ঘদিন বন্ধ থাকায় যে ক্ষতি হয়েছে তা অপূরণীয় বিধায় সরকারী প্রণোদনা ও বিনিয়োগ অব্যাহত থাকুক এই আশাই রইল।
লেখক : ড. মিহির কুমার রায়, অধ্যাপক, গবেষক, ডিন ও সিন্ডিকেট সদস্য, সিটি ইউনিভার্সিটি, ঢাকা