শিক্ষার্থীদের হাফ পাসের বিষয়টির স্থায়ী সমাধান প্রয়োজন - দৈনিকশিক্ষা

শিক্ষার্থীদের হাফ পাসের বিষয়টির স্থায়ী সমাধান প্রয়োজন

দৈনিকশিক্ষা ডেস্ক |

শিক্ষার্থীদের হাফ পাস কিংবা অর্ধেক ভাড়ার দাবি নিয়ে কারও দ্বিমত নেই। সরকারও বিষয়টিতে ইতিবাচক। ইতোমধ্যে বিআরটিসির গাড়িতে হাফ পাসের ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। কিন্তু মনে রাখতে হবে, বিআরটিসির বাস ১০ শতাংশ। আর যে প্রায় ৯০ শতাংশ বাস রয়েছে সেগুলোতে শিক্ষার্থীরা সুবিধা না পেলে আসলে সুফল আসবে না। সরকার নিশ্চয় আন্তরিকতা নিয়ে মালিকপক্ষের সঙ্গে হাফ পাসের বিষয়ে বসছে। তারপরও কেন সিদ্ধান্ত আসছে না- এ কারণও অস্পষ্ট নয়। সরকারকে সেখানেই নজর দিতে হবে। বস্তুত গণপরিবহনে সংকটের মূল কারণ মালিকপক্ষের নীতিবহির্ভূত ব্যবসা। এখানে বড় বড় কোম্পানি লাইসেন্স নিয়ে অনেক ক্ষেত্রে বিনা পুঁজিতে ব্যবসা করে। ফলে প্রকৃত বাস মালিকদের বড় অঙ্কের অর্থ চলে যায় কিছু অহেতুক খরচে। যেটা সাধারণত তাদের লাগার কথা নয়। সোমবার (২৯ নভেম্বর) সমকাল প্রক্রিকায় প্রকাশিত এক নিবন্ধে এ তথ্য জানা যায়।

ধরা যাক, নির্দিষ্ট রুটের জন্য লাইসেন্স নিয়েছে পরিচিত একটা বাস কোম্পানি। তারা বলছে, কোম্পানির বাস রয়েছে আড়াইশ। প্রকৃতপক্ষে তার এতসংখ্যক বাস রয়েছে কিনা, পরীক্ষা না করেই লাইসেন্স দেওয়া হয়। ফলে ছোট ছোট মালিক ওই কোম্পানির নামে গাড়ি এবং তাদের রুট ব্যবহার করে। এ কারণে ছোট মালিকদেরকে বছর বছর যেমন নবায়ন খরচ দিতে হয়, তেমনি রুট পারমিট নেওয়ার জন্য শুরুতেই বড় অঙ্কের অর্থ পরিশোধ করতে হয়। এর বাইরে টার্মিনাল, পুলিশসহ অন্যান্য চাঁদাবাজি তো আছেই।

মালিকদের এই যে অতিরিক্ত অর্থ খরচ, তা ওঠাতে তারা আরেকটি কাজ করছে। তারা বাসের চালক ও হেলপারের সঙ্গে চুক্তিতে যাচ্ছে। অর্থাৎ তারা সারাদিন গাড়ি চালিয়ে নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ মালিককে দেবে; বাকিটা নিজেরা নেবে। এভাবে আমরা দেখছি, পরিবহনে যে লাভ হচ্ছে, তার মধুটা আসলে চলে যাচ্ছে অন্য জায়গায়। তার মানে, গাড়ির চালক ও হেলপাররাই হয়ে যাচ্ছে গাড়ির মালিক। বাস মালিক বেশি লাভ করার জন্য চালকদের লক্ষ্যমাত্রা বেঁধে দেওয়ার ফলে তারা যেমন বেপরোয়াভাবে গাড়ি চালায়, তেমনি ভাড়ার ক্ষেত্রেও হেলপারদের কঠোরতা স্পষ্ট। তারা ভাবছে, বাসের সব খরচ ওঠাতে হবে যাত্রীর কাছ থেকেই। ফলে যখনই হাফ ভাড়ার বিষয়টি এসেছে, তখনই গাড়ির চালক-হেলপাররা এর বিরোধিতা করছে। এ নিয়ে নানা রুটে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে বাসের হেলপাররা খারাপ ব্যবহারও করছে। অর্ধেক ভাড়া দিতে গিয়ে শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন সময়ে বাসচালক কিংবা তার সহযোগীর দ্বারা হেনস্তার শিকার হওয়ার ঘটনাও ঘটেছে। এমনকি হাফ ভাড়া দিতে চাওয়ায় ছাত্রীকে ধর্ষণের হুমকিও দেওয়া হয়েছে। রাজধানীতে অর্ধেক ভাড়া নিয়ে তর্কের এক পর্যায়ে এক ছাত্রকে বাস থেকে ধাক্কা দিয়ে ফেলার খবরও সংবাদমাধ্যমে এসেছে। এমন আচরণ শুধু অবমাননাকরই নয়, ফৌজদারি অপরাধও বটে।

আমরা মনে করি, সরকারের আন্তরিকতা এখানেই জরুরি। এই যে সিস্টেম আমাদের সংকটের মুখোমুখি দাঁড় করিয়েছে, সরকারকে সে সিস্টেমটাই পরিবর্তন করতে হবে। তার সমাধানও যে নেই, তা নয়। সে উদাহরণ গ্রহণ করে সরকার সংস্কার করতে পারে। গুলশান-বনানী-বারিধারায় যেমন 'ঢাকা চাকা' নামে একটা বাস চালু রয়েছে। একই আদলে হাতিরঝিলে আরেকটি চক্রাকার বাস সার্ভিস চালু করা হয়েছে। সেগুলোতে বাসচালক ও হেলপার কর্মচারী। কোম্পানি তাদের বেতন দেয়। ফলে এখানে চালকদের মধ্যে অসুস্থ প্রতিযোগিতা দেখা যায় না। চালককে বেশি যাত্রী তোলার জন্য আরেকটি বাসের আগে গিয়ে দাঁড়াতে হয় না। হাফ পাসের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। যেহেতু সেখানে মালিকদের অহেতুক অতিরিক্ত ব্যয় নেই, তারা তখন হাফ পাসের বিষয়টি সহজেই বিবেচনা করতে পারবে। আমরাও ছাত্রজীবনে হাফ পাসে গণপরিবহনে চলেছি। তখন চালক-হেলপাররা মালিকের বেতনভুক্ত ছিল। ফলে সেদিকেই সরকার নজর দিতে পারে।

গণপরিবহনে শিক্ষার্থীদের হাফ পাসের দাবি যেমন পূরণ হওয়া প্রয়োজন, তেমনি বিশৃঙ্খল পরিবহনকে শৃঙ্খলায় আনা জরুরি। আমরা শিক্ষার্থীদের আন্দোলন দেখছি। তারা হাফ ভাড়া যেমন দাবি করছে, তেমনি সড়কে নিরাপত্তার কথাও বলছে। নিরাপদ সড়কের আন্দোলনে ২০১৮ সালেও শিক্ষার্থীরা সড়কে নেমেছে। সড়ক ও পরিবহন সমস্যা শুধু শিক্ষার্থীদেরই নয় বরং অন্যরাও এর ভুক্তভোগী। অন্যরা আন্দোলনে না নামলেও শিক্ষার্থীরা নামছে। কারণ তারা স্বপ্ন দেখে। তরুণ প্রজন্ম প্রত্যাশা করে, আন্দোলনের মাধ্যমে সমস্যার সমাধান হবে। বস্তুত সমাধান যে খুব দুরূহ, তা নয়। সরকারের যে সদিচ্ছা রয়েছে, সেটিই যথেষ্ট। এই সদিচ্ছা কাজে লাগিয়ে গণপরিবহনকে নতুন করে ঢেলে সাজানো অসম্ভব নয়। বস্তুত এটা সরকারের পক্ষেই কেবল সম্ভব।

সড়কে বিশৃঙ্খলার কারণেই আমরা সড়কে হত্যা দেখি। এমনকি কয়েক দিন আগে নটর ডেম কলেজের একজন শিক্ষার্থী যেভাবে ময়লার গাড়িতে চাপা পড়ে প্রাণ হারায়, সেটাও তার বাইরে নয়। বস্তুত সিটি করপোরেশনসহ সরকারি প্রতিষ্ঠানের গাড়িগুলোর ফিটনেস, চালকের লাইসেন্স রয়েছে কিনা- এসব দেখভালের কেউ নেই। এই সুযোগে গাড়ির স্টিয়ারিং যে কারও হাতে চলে যায়। সিটি করপোরেশনের পরিবহন খাতে বহু দিন ধরে চরম বিশৃঙ্খলা বিরাজমান। এখানে কঠোর আইনের প্রয়োগ নেই। সরকারি প্রতিষ্ঠানের গাড়ি এভাবে একের পর এক প্রাণহানির কারণ হলে কেন শুধু চালক বা তার সহকারী দায়ী হবে? প্রতিষ্ঠানকে এর দায় নিতে হবে। কারণ তাদের তো অজানা নয়, এ খাতে কী ধরনের নৈরাজ্য চলছে। আর নগরপিতা নিজের প্রতিষ্ঠানকে দুর্বল রেখে অন্যকে সব বিষয়ে আইন মানার কথা বলবেন- এই বৈপরীত্য হতাশাজনক। ফলে পরিবহন খাত ঘিরে বড় ধরনের সংস্কার না হলে হৃদয়বিদারক ঘটনা ঘটতে থাকবে।

বলাবাহুল্য, গণপরিবহনের উন্নয়নে আমাদের পরিকল্পনা, দলিল সবই আছে, কিন্তু যথাযথ প্রয়োগ নেই। এমনকি হাফ পাসের বিষয়টি তো অনেক আগেই সমাধান হয়েছে, তারপরও সময়ে সময়ে শিক্ষার্থীদের কেন রাস্তায় নামতে হচ্ছে? এর পেছনে স্বার্থান্বেষী মহলের চাপও রয়েছে। ২০১৮ সালের ঘটনায় আমরা দেখেছি, জাবালে নূরের যে বাসটি চাপা দিয়ে দু'জন শিক্ষার্থীকে মেরে ফেলল, বিআরটিএ সেই বাসের লাইসেন্স বাতিল করল। ওই মালিকের কিন্তু আরও বাস আছে। সেগুলো বহাল তবিয়তে আছে।

গণপরিবহনকে ঘিরে এক ধরনের প্রভাবশালী চক্র তৈরি হয়েছে। এদের কাছে সরকারও অনেক সময় জিম্মি হয়ে পড়ে। আমরা জানি, সরকারের অনেক অর্জন রয়েছে। পরিবহনেও সরকার এ কাজটি করে যেতে পারে। শিক্ষার্থীদের হাফ পাসের বিষয়টির একটি স্থায়ী সমাধান প্রয়োজন, যাতে তাদের বারবার রাস্তায় নামতে না হয়। সরকারের আন্তরিকতা অস্বীকারের উপায় নেই। সরকারের প্রচেষ্টায় স্বল্পমেয়াদে সমাধানও হবে নিশ্চয়। কিন্তু দীর্ঘমেয়াদে সংস্কারে মনোযোগী হওয়া প্রয়োজন। এ সরকারই সেটা করে দেখাতে পারে।

লেখক : ড. এম শামসুল হক, পরিবহন বিশেষজ্ঞ ও অধ্যাপক, পুরকৌশল বিভাগ, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট)

অভিভাবকদের চাপে শিক্ষার্থীরা আত্মকেন্দ্রিক হয়ে উঠছেন - dainik shiksha অভিভাবকদের চাপে শিক্ষার্থীরা আত্মকেন্দ্রিক হয়ে উঠছেন বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে মামলা ১২ হাজারের বেশি - dainik shiksha বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে মামলা ১২ হাজারের বেশি শিক্ষকদের অবসর সুবিধা সহজে পেতে কমিটি গঠন হচ্ছে - dainik shiksha শিক্ষকদের অবসর সুবিধা সহজে পেতে কমিটি গঠন হচ্ছে শিক্ষকদের শূন্যপদ দ্রুত পূরণের সুপারিশ - dainik shiksha শিক্ষকদের শূন্যপদ দ্রুত পূরণের সুপারিশ ইরানে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালালো ইসরায়েল - dainik shiksha ইরানে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালালো ইসরায়েল চট্টগ্রাম শিক্ষাবোর্ডের সচিবের বিরুদ্ধে মাউশির তদন্ত কমিটি - dainik shiksha চট্টগ্রাম শিক্ষাবোর্ডের সচিবের বিরুদ্ধে মাউশির তদন্ত কমিটি কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0032730102539062