শিক্ষার্থীর আচরণ, শিক্ষকের মর্যাদা ও মানসম্মত শিক্ষা - দৈনিকশিক্ষা

শিক্ষার্থীর আচরণ, শিক্ষকের মর্যাদা ও মানসম্মত শিক্ষা

মো. আব্দুল কুদ্দুস সিকদার |

সাম্প্রতিক সময়ে শিক্ষাঙ্গন ও শিক্ষাঙ্গনের বাইরে শিক্ষার্থীদের আচরণ, শিক্ষক ও অভিভাবকের প্রতি তাদের শ্রদ্ধাবোধের অভাব, পড়ালেখার প্রতি অমনোযোগ, নিয়মিত শ্রেণিকক্ষে উপস্থিতির প্রতি অনাগ্রহ, ক্লাসরুমে লেকচার শোনার পরিবর্তে স্মার্টফোন ও ফেইসবুক নিয়ে ব্যস্ততা ইত্যাদি বিষয়গুলো অনেক বেশি আলোচিত-সমালোচিত। শিক্ষার্থীকর্তৃক শিক্ষক লাঞ্ছনার ঘটনাও ঘটছে প্রায় নিয়মিত। অনেকেই বলে থাকেন শিক্ষার্থীদের মাঝে সামাজিক অবক্ষয় এমন আশঙ্কাজনক পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, এটি নিয়ন্ত্রণ করা না গেলে সমগ্র জাতিকেই হয়তো একদিন চড়া মূল্য দিতে হবে। আমাদের সন্তান, আমাদের  আগামী প্রজন্ম সুশিক্ষায় শিক্ষিত হোক, নীতিবোধে জাগ্রত হোক, আলোকিত মানুষ হোক, এ আমাদের প্রত্যাশা। কিন্তু প্রত্যাশা পূরণে শিক্ষার্থীকে আদর্শিক জায়গায় ফিরিয়ে আনতে হবে এবং এজন্য প্রয়োজন প্রচেষ্টা গ্রহণ। কিন্তু প্রথমেই প্রশ্ন এই প্রচেষ্টা কে বা কারা গ্রহণ করবেন এবং কার দায় কতটুকু? 

এ সময়ের একজন শ্রেণিশিক্ষকই কেবল জানেন যে, শ্রেণিকক্ষে তিনি কতটা অসহায়। তাঁর পক্ষে শ্রেণিকক্ষ নিয়ন্ত্রণ করা প্রায় অসম্ভব হয়ে দাঁড়িয়েছে। সাম্প্রতিক সময়ে ময়মনসিংহের একজন স্কুল শিক্ষক তাঁর ফেসবুক স্ট্যাটাসে লিখেছেন, ‘ক্লাসরুম কন্ট্রোল করা  যুদ্ধক্ষেত্রে যুদ্ধ করার মত অবস্থা দাঁড়িয়েছে। ক্লাসের সামনের সারির অল্প কয়েকজন কিছু শিক্ষকদের কথা শুনলেও পেছনের দিকের সবাই নিজেদের ব্যক্তিগত আলাপচারিতায় ব্যস্ত থাকে। বারবার অনুরোধ করার পরেও এক দুই মিনিটের জন্য শান্ত হলেও শিক্ষক যখন আবার পড়াতে শুরু করেন, আবার তারাও পূর্বের মত নিজেদের ইচ্ছামত আলাপচারিতায় ব্যস্ত হয়ে পড়ে।’ তিনি স্ট্যাটাসে আরও উল্লেখ করেছেন, ‘আমরাও তো একদিন ছাত্র ছিলাম। শিক্ষকগণ ক্লাসে আসলে সবাই শান্ত হয়ে যেতাম। স্যার যা ক্লাসে বলতেন তাই করতাম। আজকের এই উল্টো চিত্রের জন্য দায়ী কে?’ স্ট্যাটাসদাতা শিক্ষক অসহায় হয়ে প্রশ্ন করেন, ‘এ কী হলো?…আমরা কী করব? কীই বা শিক্ষকগণের করার আছে? মিনিমাম শাসন করলেও কত ধরনের অপমান, অপদস্ত হওয়ার আশঙ্কা।’

শিক্ষার্থীরা নিয়মিত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে আসতে চায় না, এলেও ক্লাসরুমে যেতে চায় না, ক্লাসরুমে যারা যায় তারাও ক্লাস লেকচার শোনার প্রতি মনোযোগী হয় না। লেকচার শোনার পরিবর্তে স্মার্টফোন ও ফেসবুক চ্যাটিংয়ে তারা অনেক বেশি মনোযোগী। বাড়ির কাজ দিলে সেগুলো তারা করবে না, প্রতিষ্ঠানের নিয়ম কানুন মানতে চায় না, প্রতিষ্ঠানের সময় মেনে ক্লাসে আসবে না। শৃঙ্খলা মানবে না।এসব নিয়ে প্রশ্ন করলে দেখায় নানা অজুহাত। এমনকি এমন কিছু অভিভাবক আছেন, যারা তাদের সন্তানদের পক্ষে নিজেরাই নানা অজুহাত দেখান। ব্যতিক্রম কিছু শিক্ষার্থী বাদে নিয়মিত লেখাপড়ার প্রতি শিক্ষার্থীদের আগ্রহের জায়গা প্রায় শূন্যের কোটায়।

স্কুল থেকে শুরু করে উচ্চমাধ্যমিক পর্যায় পর্যন্ত এগুলো কিছুটা সহনীয় মাত্রায় থাকলেও অনার্স-মাস্টার্স পর্যায়ের চিত্র ভয়াবহ। ক্লাসে উপস্থিতি নেই, অথচ ফরম ফিলাপ করতে দিতে হবে, পরীক্ষার হলে নকল করে লেখার সুযোগ দিতে হবে, নেতা নামধারী অনেকের জন্য পরীক্ষার সময় সিকবেডের নামে বিশেষ কক্ষে পরীক্ষা নেয়ার দারি করবে, অনেকে তো নিজেও পরীক্ষার রুমে যেতে চায় না, পাঠায় কোনো ছোট ভাইকে দেখে শুনে খাতায় কিছু একটা লিখে দিতে (এমন ঘটনা ২/১টি হলেও ঘটছে), মৌখিক পরীক্ষায় কিছু না পারলেও তাদের ভাল ছাত্রের চেয়েও বেশি নাম্বার দিতে হবে, বিভাগের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে ছাত্রনেতাদের দাওয়াত করে খাওয়াতে হবে, বিভিন্ন অনুষ্ঠান উপলক্ষে তাদের প্রতিষ্ঠান থেকে চাঁদা দিতে হবে, কলেজ বা বিভাগের অনুষ্ঠানের গেস্ট কে হবেন তাও ছাত্রনেতাদের পরামর্শ(অনুমতি বলাটাই বোধহয় যথার্থ) অনুযায়ী ঠিক করতে হবে। এই তো শিক্ষকদের অবস্থা। এসবের ব্যতিক্রম হলেই শিক্ষক হবেন হেনস্তার শিকার।

মাস্টার্স শেষ বর্ষের মৌখিক পরীক্ষায় কোনো একটি কেন্দ্রের ৫১ জন পরীক্ষার্থীর মধ্যে ৪৮ জনকে পেয়েছিলাম যারা তাদের সমগ্র অনার্স-মার্টার্স শিক্ষা জীবনে গাইড ব্যতীত কোনো মূল বই পড়েনি। এমনকি যে গাইড বইটি তারা পড়েছে সে গাইডটির প্রকাশনা সংস্থার নাম বলতে পারলেও গাইডের নাম ও লেখকের নামটা পর্যন্ত তারা বলতে পারেনি। কোথায় চলেছি আমরা? শিক্ষার্থী তরুণ সমাজ আজ চরম অস্থির। কী করবে শিক্ষকরা? সমস্যা সমাধানের কোনো ক্ষমতা কি শিক্ষকদের হাতে আছে?

অনেক অভিভাবক মনে করেন প্রতিষ্ঠানে ঠিকমতো পড়াশোনা হয় না। তাই শিক্ষার্থীরা ক্লাসমুখো হয় না। এ অজুহাতে তারা ক্লাস টাইমে সন্তানকে পাঠান কোচিং সেন্টারে। এটি তাদের একটি বিরাট ভুল। আমরা সব শিক্ষকই ভাল পড়াই, তাও আমি বলছি না। তাই বলে ক্লাসরুমের সমকক্ষ কি কোচিং সেন্টার হতে পারে? কোচিং সেন্টার কি একজন শিক্ষার্থীর শিক্ষাজীবনের যে প্রাতিষ্ঠানিক শৃঙ্খলা তা শেখাতে পারে? শেখাতে পারে কি জীবনের মূল্যবোধ? কোচিং সেন্টার একটি ব্যবসাকেন্দ্র, শিক্ষার্থীর শৃঙ্খলাবোধ, মূল্যবোধ ও নৈতিকতা শেখানোর প্রশ্নটি সেখানে মূখ্য নয়। তাই তো অনেক কোচিং সেন্টারে ছেলে-মেয়ের সংখ্যা সমান ভর্তি করে বলে শুনেছি যেন আড্ডাটা তাদের জমে ভাল। কোচিং সেন্টারে গিয়ে নিজের সন্তানটি কী করছে, তা কতজন অভিভাবক খোঁজ রাখেন? সন্তান প্রতিষ্ঠানের শৃঙ্খলা ভঙ্গ করলে আপনি কেন তার পক্ষ নেবেন? আমাদের সন্তানরা দিনদিন বিপথগামী হচ্ছে,যার পরিণতি আমাদের অভিভাবকদের‌ই বেশি ভোগ করতে হবে। সুতরাং আদর্শ নাগরিক গড়তে, অনুগত শিক্ষার্থী গড়তে, সন্তানের মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করতে অভিভাবকের দায় অনেক বেশি।

শরিয়তপুরে অবস্থিত জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সরকারি কলেজে কর্মরত শিক্ষা ক্যাডার কর্মকর্তা বিএম সোহেলের   ওপর একটি ছাত্র সংগঠনের নেতা নামধারী ছাত্রকর্তৃক হামলার ঘটনা ঘটে। বিভাগের মৌখিক পরীক্ষার সময় ছাত্রনেতাকে দাওয়াত দিয়ে না খাওয়ানোয় এমন ঘটনা ঘটে।

শ্রেণিকক্ষে হৃদয় চন্দ্র মণ্ডল নামক একজন স্কুল শিক্ষকের দেয়া একটি বক্তব্য শিক্ষার্থীকর্তৃক রেকর্ড করে বাইরে বিকৃতভাবে উপস্থাপন করে উত্তেজনা সৃষ্টি করায় অবশেষে হৃদয় চন্দ্র মণ্ডলকে গ্রেপ্তার হতে হয়। এর ফলে  শ্রেণিকক্ষে শিক্ষকের বাকস্বাধীনতাও ক্ষুণ্ণ হচ্ছে।

মামলাজনিত কারণে স্কুলের ম্যানেজিং কমিটি গঠনে দেরি হওয়ায় যশোরে স্কুলের এক প্রধান শিক্ষককে অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ ও হত্যার হুমকি দিয়েছেন নেতা নামধারী তারই এক প্রাক্তন ছাত্র। সম্প্রতি চাঁদার দাবিতে সরকারি ছাত্রসংগঠনের ব্যানারে ছাত্রনেতা নামধারী কতিপয় দুষ্কৃতিকারী গফরগাঁও সরকারি কলেজে ভাঙচুর করে ও দুই শিক্ষককে মারধর করে। এ প্রেক্ষিতে থানায় দেওয়া লিখিত অভিযোগ করা হলো তা প্রত্যাহারের দাবিতে তারা পুনরায় কলেজে ভাংচুর ও লাঠি মিছিল করে। এ যেন শিক্ষাঙ্গন নয় এক যুদ্ধক্ষেত্র।

ক্লাসে পড়া না পারা, অনিবার্য় কোনো কারণে দেরিতে স্কুলে পৌঁছানো বা ছোট খাটো ভুলের জন্য জীবনে অসংখ্যবার শিক্ষকের ধমক ও বকা খেয়েছি, জোড়াবেতের ঘা খেয়েছি, সকলের সামনে কান ধরে বেঞ্চের ওপর দাঁড়াতে হয়েছে, দুই আঙুলের মধ্যে পেন্সিল ঢুকিয়ে চাপ হাতের আঙুল শিক্ষক ব্যথা করে দিয়েছেন, কান টেনে লাল করে দিয়েছেন, চুলের কলি ওপরের দিকে টেনে ধরে পুরো কান ও মাথা ব্যাথা করে দিয়েছেন। তারপরও শিক্ষকের বিরুদ্ধে কথা বলার সাহস করিনি কখনো। এমনকি বাড়িতে যেয়ে বাবা মা-কেও শাস্তির কথা ভয়ে ও লজ্জায় বলতে পারিনি কখনো। কিন্তু আজ আমরা শিক্ষার্থীদের ধমকের সুরে কথা বলতে পারি না। অনুরোধ করে বললেও তারা আমাদের পাত্তা দেয় না।

বারবার শিক্ষক নির্যাতনের ঘটনা সংগঠিত হওয়ায় শিক্ষকের মর্যাদাহানির পাশাপাশি পেশাগত কর্মে অনীহা সৃষ্টি হচ্ছে, যা মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিতকরণকে ব্যাহত করবে। আমি শিক্ষক, শিক্ষাদানের জন্য আমি উপযুক্ত পরিবেশ চাই। আমাকে শিক্ষাদানের উপযুক্ত পরিবেশ দিন, শ্রেণিকক্ষে আমি আমার জ্ঞানের সবটুকু বিতরণে আন্তরিকভাবে সচেষ্ট থাকব।
 
শিক্ষা নিয়ে যারা ভাবেন, শিক্ষা ও শিক্ষাঙ্গন নিয়ে তাদের নতুন করে ভাবনার সময় এসেছে। সরকার, রাজনীতিবিদ ও শিক্ষাবিদদের প্রতি বিনীত অনুরোধ থাকবে জাতিকে বাঁচানোর জন্য নতুন  করে চিন্তা করুন। শিক্ষাক্ষেত্রে এসব অরাজকতা ও বিশৃঙ্খলা অবশ্যই বন্ধ করতে হবে। অন্যথায় আমার আপনার সন্তান, আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম চরম অন্ধকারের দিকে ধাবিত হবে এটা নিশ্চিত করেই বলা যায়। এ কথাগুলো আমার একার কথা নয়, সারাদেশের সকল শিক্ষকের মনের কথা, অন্তরের কথা। আমাদের আগামী প্রজন্মকে সঠিক পথে ফিরিয়ে আনার জন্য যেসব শিক্ষক আন্তরিক প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে, তারা আপনাদেরকে পাশে চায়। অভিভাবক, শিক্ষক, শিক্ষাবিদ, পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রের সমন্বিত প্রয়াস গ্রহণই কেবল পারে শিক্ষাক্ষেত্রে শিক্ষার পরিবেশ ফিরিয়ে এনে জাতি গড়ার উপযুক্ত পরিবেশ তৈরি করতে।শিক্ষকতার মতো মহান পেশার সাথে জড়িত মানুষগুলোর সম্মান রক্ষা করার দায়িত্ব আপনারা নেবেন কিনা তার অবশ্যই আপনাদেরকে এবং রাষ্ট্রকে ভেবে দেখতে হবে।  

 
লেখক : মো. আব্দুল কুদ্দুস সিকদার, সাধারণ সম্পাদক, শিক্ষক পরিষদ, ঢাকা কলেজ।

হাইকোর্টের আদেশ পেলে আইনি লড়াইয়ে যাবে বুয়েট: উপ-উপাচার্য - dainik shiksha হাইকোর্টের আদেশ পেলে আইনি লড়াইয়ে যাবে বুয়েট: উপ-উপাচার্য প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগ: তৃতীয় ধাপের ফল প্রকাশ হতে পারে আগামী সপ্তাহে - dainik shiksha প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগ: তৃতীয় ধাপের ফল প্রকাশ হতে পারে আগামী সপ্তাহে ভূমির জটিলতা সমাধানে ভূমিকা রাখবেন নবম শ্রেণির শিক্ষার্থীরা - dainik shiksha ভূমির জটিলতা সমাধানে ভূমিকা রাখবেন নবম শ্রেণির শিক্ষার্থীরা সর্বজনীন শিক্ষক বদলি চালু হোক - dainik shiksha সর্বজনীন শিক্ষক বদলি চালু হোক ডিপ্লোমা প্রকৌশলীদের বিএসসির সমমান দিতে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কমিটি - dainik shiksha ডিপ্লোমা প্রকৌশলীদের বিএসসির সমমান দিতে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কমিটি রায় জালিয়াতি করে পদোন্নতি: শিক্ষা কর্মকর্তা গ্রেফতার - dainik shiksha রায় জালিয়াতি করে পদোন্নতি: শিক্ষা কর্মকর্তা গ্রেফতার কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0069019794464111