শিক্ষার্থীরা নতুন বই ঠিক সময়ে পাবে তো! - দৈনিকশিক্ষা

শিক্ষার্থীরা নতুন বই ঠিক সময়ে পাবে তো!

মাছুম বিল্লাহ |

২০২৩ শিক্ষাবর্ষের শুরুতে বিনামূল্যের পাঠ্যপুস্তক হাতে পাওয়া নিয়ে শঙ্কা তৈরি হয়েছে। নভেম্বরের মধ্যে ছাপা শুরু হলেও ৩১ ডিসেম্বরের মধ্যে সর্বোচ্চ ৩০-৩৫ শতাংশ বা দশ কোটির বেশি বই সরবরাহ করা সম্ভব হবে না। সংশ্লিষ্টরা এমনই আশঙ্কা করছেন। আর যেসব প্রতিষ্ঠান কাজ বেশি নিয়েছে, তারা শেষপর্যন্ত বই দিতে পারবে কিনা, সেটি নিয়েও আরেক সন্দেহ। প্রাথমিক স্তারের বই ছাপতে দেওয়া হয়েছে ১২টি প্রতিষ্ঠানকে, যাদের মধ্যে ১১টিরই বই ছাপানোর নির্দিষ্ট মেশিন নেই। তার মানে হচ্ছে গত কয়েক বছরের মতো এবারও শিক্ষার্থীরা ত্রুটিপূর্ণ বই পেতে যাচ্ছে। শিক্ষার্থীদের হাতে নির্দিষ্ট সময়ে নতুন বই তুলে দেয়া সরকারের একটি বড় চ্যালেঞ্জ। তার সাথে যুক্ত হচ্ছে মানসম্পন্ন বই এবং বিলম্ব। নববর্ষে শিক্ষার্থীদের জন্য এটি একটি বাড়তি আনন্দের দিন। কিন্তু এই আনন্দে দেশের সব এলাকার শিক্ষার্থীরা শামিল হতে পারে না। কারণ প্রতিবছরই সব এলাকার শিক্ষার্থীরা একসাথে বই হাতে পায় না। এবার শিক্ষার্থীদের হাতে বই না পাওয়ার শঙ্কা আরও বড় করে দেখা দিয়েছে। শঙ্কার কারণ এবার বই ছাপানোর কার্যাদেশ দিতে দেরি করাসহ তিনটি কারণ। নতুন শিক্ষাবর্ষ শুরু হতে মাত্র সাড়ে তিন মাস বাকি। যতটা জানা যায়, এখন পর্যন্ত প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের পাঠ্যবই ছাপানোর কার্যাদেশই দিতে পারেনি এনসিটিবি। এ অবস্থা হলে প্রায় ৩৫ কোটি বই কীভাবে এত অল্প সময়ের মধ্যে ছাপা হবে, এ নিয়ে মারাত্মক দ্বিধায় আছে শিক্ষা সংশ্লিষ্টরা। অন্যান্য বছর এই সময়ের মধ্যে ৬-৭ কোটি বই ছাপা হয়ে যায়। আর এবার এখনো পর্যন্ত  কোনো প্রতিষ্ঠানের সাথে নাকি কার্যকর কোনো চুক্তিই হয়নি।

মূল তিনটি কারণে এবার বই নিয়ে এলোমেলো অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। প্রথম কারণটি হচ্ছে এনসিটিবি প্রক্রিয়াই শুরু করেছে বিলম্বে যার ফলে পাঠ্যপুস্তকসংক্রান্ত ছয়টি দরপত্রের মধ্যে একটির প্রক্রিয়াও চূড়ান্ত হয়নি। তার মানে হচ্ছে বই ছাপার জন্য এখনো কোনো চুক্তিই হয়নি। আগামী বছর নতুন শিক্ষাক্রমে চারটি শ্রেণিতে বই দেওয়ার কথা। বিলম্বের কারণে প্রাথমিকের পাইলটিংই করা যায়নি। মাধ্যমিকের ষষ্ঠ শ্রেণির পাইলটিং  কোনোমতে হয়েছে। কিন্তু এখনও চূড়ান্ত হয়নি। তৃতীয় কারণটি হচ্ছে, ডলার, জ্বালানি তেল ও কাগজসহ বই ছাপানোর অপরিহার্য উপাদানের দাম বৃদ্ধি এবং বিদ্যুতের বিদ্যমান পরিস্থিতি। এসব সত্ত্বেও মুদ্রাকররা গড়ে প্রাক্কলিত দরের চেয়ে ২৫ শতাংশ কম টাকায় দরপত্র দিয়েছেন। এতে কাঙ্ক্ষিত মানের বই পাওয়া যাবে কিনা সন্দেহ থেকে যাচ্ছে। পাঠ্যবই নিয়ে এ পর্যন্ত যে অবস্থা তৈরি হয়েছে, তার পুরো দায় এনসিটিবির ওপর চাপাতে চাইছেন মুদ্রণ শিল্প সমিতির সাধারণ সম্পাদক। তিনি বলতে চাচ্ছেন, যে দামে কাজ দেওয়া হয়েছে, তাতে অন্তত ৫০টি ফার্ম বই-ই দিতে পারবে না। আবার কেউ কেউ নিউজপ্রিন্টে বই সরবরাহ করা তো দূরের কথা, খালি কাগজ দিতে পারবে কিনা সন্দেহ রয়েছে। এই অবস্থায় কারও লক্ষ থাকে বছরের শেষ সময়ের দিকে। কারণ এনসিটিবি তখন শুধু বই চায়, কী রকম বই, কী মানের বই, এসব দিকে কোনোও খেয়াল রাখতে পারে না। সেই সুযোগের অপেক্ষায় থাকে কেউ কেউ। এনসিটিবি কর্ম প্রক্রিয়া আরও আগে শুরু করলে অবস্থা এমন দাঁড়াত না। এনসিটিবির চেয়াম্যান বলেন, এখন পর্যন্ত সবকিছু সময়সূচি অনুযায়ী চলছে, কোনো বিলম্ব হয়নি। গত বছর একটি প্রতিষ্ঠানকে তিন কোটি বিশ লাখ বই মুদ্রণের দায়িত্ব দেওয়া হয়। এবার সেই প্রতিষ্ঠানকে দুই কোটির মতো বই মুদ্রণের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে, যাতে তারা ম্যানেজ করতে পারেন। যেহেতু সক্ষমতা বিচার করে কাজ দেওয়া হয়েছে, তাই সংকট না হওয়ারই কথা। তাছাড়া নিউজপ্রিন্টে বই সরবরাহ ঠেকাতে এবার দ্বৈত তদারকি সংস্থা নিয়োগ করা হয়েছে। কম দামে কাজ নেওয়ার দায় মুদ্রাকরদের। নিম্নমানের বই দেয়ার সুযোগ নেই। 

এনসিটিবি এবার মোট ৩৩ কোটি ২৮ লাখ বই ছাপানোর প্রক্রিয়া চালিয়েছে। এর মধ্যে ক্ষুদ্র ও নৃগোষ্ঠী ও দৃষ্টিপ্রতিবন্ধীদের ব্রেইল বই এবং প্রাক-প্রাথমিক স্তরের পাঠ্যবই ও অনুশীলন গ্রন্থের দরপত্র প্রক্রিয়া শেষে দরদাতাদের কাছ থেকে সম্মতিপত্র (নোটিফিকেশন অব অ্যাওয়ার্ড) নেয়ার কাজ চলছে। প্রাথমিকের তৃতীয়–পঞ্চম শ্রেণির সম্মতিপত্র চাওয়া শুরু হয়েছে ২৫ সেপ্টেম্বর। এই স্তরের প্রথম-দ্বিতীয় শ্রেণির বইয়ের দরপত্র জাতীয় ক্রয় কমিটি ও প্রধানমন্ত্রীর অনুমোদনের জন্য প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। মাধ্যমিকের অষ্টম-নবম শ্রেণির বইয়ের চুক্তির প্রক্রিয়া চলছে। ক্রয় কমিটি সম্প্রতি ষষ্ঠ-সপ্তম শ্রেণির দরপত্র অনুমোদন দিয়েছে। এটির ফাইল এখন প্রধানমন্ত্রীর অনুমোদনের পর শিক্ষা মন্ত্রণালয় হয়ে এনসিটিবিতে আসবে। তারপর সম্মতিপত্র চাওয়া হবে দরদাতাদের কাছে। নিয়ম অনুযায়ী সম্মতিপত্র চাওয়া হলে দরদাতারা অন্তত এক সপ্তাহ সময় পান। এরপর তারা আরও ২৮ দিন সময় পান চুক্তি করার জন্য। দরদাতারা পারফরম্যান্স গ্যারান্টি বা সিকিউরিটি মানি দিলেই এনসিটিবি বই ছাপার  অনুমতি দিতে সম্মত হয়। এরপর বই মুদ্রণের কার্যাদেশের পাশাপাশি পাণ্ডুলিপি দেওয়া হয়। ওই পাণ্ডুলিপি যাচাই ও এনসিটিবির অনুমোদন নিয়ে বই মুদ্রণ শুরু করতে আরও ৩-৪ দিন সময় লেগে যায়। মুদ্রণ শিল্প সমিতির সাধারণ সম্পাদক বলেন, সম্মতিপত্র দেওয়ার পর থেকে বই ছাপা শুরু পর্যন্ত অন্তত দেড় মাস প্রয়োজন। এই হিসাবে বেশি চাপাচাপি করা হলেও ১০ নভেম্বরের আগে কাজ শুরু করা কিছুতেই সম্ভব নয়। অথচ অন্যান্য বছর এই সময়ের মধ্যে প্রাথমিক স্তরের বই জেলা-উপজেলায় পৌঁছে যায়। নির্ধারিত সময়ের পরও বই সরবরাহে ২৮ দিন সময় পান মুদ্রাকররা, যে সময়ের মধ্যে নামমাত্র জরিমানা দিয়ে বই সরবরাহের সুযোগ থাকে। সূত্র জানায়, এই ২৮ দিনের সুযোগ নিয়ে কেউ কেউ অনেক বিলম্বে বই সরবরাহ করে।

গত কয়েক বছর যাবত প্রাক-প্রাথমিক স্তরে নিম্নমানের পাঠ্যবই সরবরাহের অভিযোগ রয়েছে। এক্ষেত্রে বড় অভিযোগ হচ্ছে, ডিজাইন অনুযায়ী বই ছাপানো হয় না। এনসিটিবি থেকেই সংগৃহীত বইয়ে দেখা যায়, পৃষ্ঠার নিচের দিকে সবুজ রিবন থাকার কথা। কিন্তু ‘ফ্লাশ কাট’ ছাড়াই দেওয়া হয়েছে বই। ফলে রঙিন রিবনের দিকে সবুজ রিবন থাকার কথা। রঙিন রিবনের নিচে বাড়তি সাদা কাগজ রয়ে গেছে। মূলত সাদা অংশ কেটে ফেললে বইয়ের আকার ছোট হয়ে যায়। এজন্যই তা না কেটে সংশ্লিষ্ট মুদ্রাকররা ত্রুটিপূর্ণ বা ডিজাইনবহির্ভূত এই বই সরবরাহ করেছেন। সাদা অংশ কেটে ফেললে বইয়ের আকার ছোট হয়ে যায়। তাই না কেটে সংশ্লিষ্ট মুদ্রাকররা ত্রুটিপূর্ণ বা ডিজাইনবহির্ভূত বই সরবরাহ করে থাকেন। আবার কেউ কেউ নিচে ফ্লাশ কাট দিয়ে সাদা অংশ বাদ দিতে গিয়ে গত বছর একটি প্রতিষ্ঠান ছোট বই সরবরাহ করে জরিমানার মুখে পড়েছিল। প্রথম-নবম শ্রেণির বই ছাপানের জন্য দরপত্রে কোন সাইজের মেশিনে ছাপতে হবে, তা উল্লেখ থাকে। এসব বইয়ের আকার পৌনে দশ বাই সোয়া সাত ইঞ্চি, যা ২০ বাই ৩০ ইঞ্চি মেশিনে ছাপা সম্ভব। আর প্রাক-প্রাথমিকের বইয়ের আকার হচ্ছে পৌনে এগার বাই সোয়া আট ইঞ্চি। এই বই ছাপতে পৌনে ২৩ বাই ৩৬ ইঞ্চি মেশিন দরকার। কিন্তু রহস্যজনক কারণে প্রাক-প্রাথমিকের দরপত্রে মেশিনের সাইজ উল্লেখ করা হয় না। এ সুযোগে যাদের এই মানের মেশিন নেই, তারাও কাজ পেয়ে যায়। এবার ১২টি প্রতিষ্ঠনের মধ্যে মাত্র একটিতে নাকি এ ধরনের মেশিন আছে। এনসিটিবির চেয়ারম্যান এ বিষয়ে বলেন, বাংলাদেশে অল্পসংখ্যক প্রতিষ্ঠানের ওই সাইজের মেশিন আছে, তাই সাইজ উল্লেখ করা হয় না। মুদ্রণশিল্প সমিতির সাধারণ সম্পাদক বলেন, বাংলাদেশে অন্তত বিশটি প্রতিষ্ঠানের ওই সাইজের মেশিন আছে। এসব পাল্টাপাল্টি কথা বা যুক্তি কিন্তু আমাদের দ্রুত বই সরবরাহে কোনোভাবে সাহায্য করবে না-বরং এনসিটিবি ও মুদ্রণ শিল্পগোষ্ঠীর মধ্যে দুরত্ব ও তিক্ততা বাড়াবে। মুদ্রণ শিল্পকেও বাঁচাতে হবে আর এনসিটিবিকেও সময়মতো এবং মানসম্পন্ন বই শিক্ষার্থীদের হাতে পৌঁছে দিতে হবে। বিনামূল্যে বিতরণের বই কালোবাজারে বিক্রি, বইয়ের সঙ্গে নোট বই কিনতে অভিভাবক ও শিক্ষার্থীদের বাধ্য করার মতো ঘটনা প্রতিবছরই ঘটেছে। পাঠ্যপুস্তকের মান নিয়েও সংশয়, অস্পষ্ট ছাপা, নিম্নমানের কাগজ ব্যবহার ইত্যাদি অভিযোগ প্রতি বছরই শোনা যায়। তার মধ্যেও কয়েক বছর যাবৎ ঝকঝকে ছাপা রঙিন বই কিন্তু প্রাথমিকের শিক্ষার্থীদের হাতে দেওয়া হয়েছে। তাতে তাদের বই পাঠের আনন্দ বহুগুণ বেড়ে গেছে। এটি একটি যৌথ প্রয়াস। এখানে কাউকে দোষারোপ করে একে অপরের দোষ খুঁজলে কেউ কাউকে সহযোগিতা করবে না, ক্ষতি হবে আমাদের শিক্ষার্থীদের, যা আমাদের হতে দেওয়া উচিত নয়। 

লেখক : মাছুম বিল্লাহ, শিক্ষা বিশেষজ্ঞ ও গবেষক, প্রেসিডেন্ট- ইংলিশ টিচার্স এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ইট্যাব)

ছুটি না বাড়ালে বাড়ি যেতে হতে পারে ঈদের দিন - dainik shiksha ছুটি না বাড়ালে বাড়ি যেতে হতে পারে ঈদের দিন হাইস্কুলে কমেছে দশ লাখের বেশি শিক্ষার্থী - dainik shiksha হাইস্কুলে কমেছে দশ লাখের বেশি শিক্ষার্থী জালিয়াতি করে পদোন্নতি শিক্ষা ক্যাডার গ্যাঁড়াকলে - dainik shiksha জালিয়াতি করে পদোন্নতি শিক্ষা ক্যাডার গ্যাঁড়াকলে রুয়েটের সাবেক উপাচার্য-রেজিস্ট্রারের বিরুদ্ধে মামলা - dainik shiksha রুয়েটের সাবেক উপাচার্য-রেজিস্ট্রারের বিরুদ্ধে মামলা উপবৃত্তির জন্য সংখ্যালঘু কোটার তথ্য চেয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয় - dainik shiksha উপবৃত্তির জন্য সংখ্যালঘু কোটার তথ্য চেয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয় প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগে সতর্কীকরণ বিজ্ঞপ্তি - dainik shiksha প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগে সতর্কীকরণ বিজ্ঞপ্তি উপবৃত্তির জন্য সংখ্যালঘু কোটার তথ্য চেয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয় - dainik shiksha উপবৃত্তির জন্য সংখ্যালঘু কোটার তথ্য চেয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয় হাইস্কুলে কমেছে দশ লাখের বেশি শিক্ষার্থী - dainik shiksha হাইস্কুলে কমেছে দশ লাখের বেশি শিক্ষার্থী please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0031490325927734