শিক্ষায় করোনার ক্ষতি কমিয়ে আনার পরিকল্পনা স্পষ্ট করতে হবে - দৈনিকশিক্ষা

শিক্ষায় করোনার ক্ষতি কমিয়ে আনার পরিকল্পনা স্পষ্ট করতে হবে

দৈনিকশিক্ষা ডেস্ক |

করোনাকালের দুই বছর প্রাইমারি থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায় পর্যন্ত শিক্ষাক্ষেত্রে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে একটি বড় ক্ষতির মুখোমুখি হয়েছে সারা পৃথিবীর মানুষ। করোনা এখনো সব অঞ্চলে নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়নি। কোনো কোনো দেশে এখনো চোখ রাঙাচ্ছে। নানা ধরনের ক্ষতির মুখোমুখি হতে হয়েছে সব দেশেরই।

তবে অর্থনৈতিক ক্ষতি নানাভাবে পূরণ করা সম্ভব হলেও শিক্ষার ক্ষতি পুরোপুরি পুষিয়ে নেওয়াটা কঠিন। আমাদের মতো দেশের নীতিনির্ধারকরা শিক্ষাক্ষেত্রের ক্ষতিটা কতটা গুরুত্বের সঙ্গে দেখেন তা এক গুরুতর প্রশ্ন বটে! এখানে অর্থনৈতিক উন্নয়নের কথাই আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে থাকে। কিন্তু সবারই বোঝা উচিত, অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য যে মেধা প্রয়োগ করতে হয় তা শিক্ষা থেকেই আসে। এ দেশের দৃশ্যমান শিক্ষার উন্নয়ন অনেকটা ‘রাজনৈতিক বক্তব্যের’ মতোই, যার প্রতি মানুষ তেমনভাবে আস্থা স্থাপন করতে পারে না। দলীয় বলয়বৃত্তে বন্দি রাজনীতি হওয়ায় শিক্ষা উন্নয়নে ভূমিকা রাখতেও দলীয় বিশেষজ্ঞ খোঁজা হয়। তাই যথার্থ ভূমিকা রাখার যোগ্য মেধাবী মানুষ অনেক সময় পর্দার আড়ালেই থেকে যান। শুক্রবার (২৯ এপ্রিল) কালের কণ্ঠ পত্রিকায় প্রকাশিত উপসম্পাদকীয়তে এ তথ্য জানা যায়।

উপসম্পাদকীয়তে আরও জানা যায় করোনাকালের বিপর্যয়ের সময় শিক্ষা মন্ত্রণালয় শিক্ষার দ্বীপশিখা জ্বালিয়ে রাখার প্রাণপণ চেষ্টা করেছে। তারা স্কুল শিক্ষায় টেলিভিশন মাধ্যম, অনলাইন ক্লাস, অ্যাসাইনমেন্ট ইত্যাদি পদ্ধতি প্রয়োগ করে কিছুটা সচল রেখেছে। এ জন্য আমরা সাধুবাদ জানাই। অবশ্য সব শিক্ষার্থীর কাছে এসব সুবিধা পৌঁছানো সম্ভব হয়নি। কিন্তু বাতি জ্বালিয়ে রাখার পরও বলতে হবে এসব টোটকা ব্যবস্থা কোনোভাবেই ক্লাসরুম শিক্ষার বিকল্প হতে পারেনি।

আগুনে পুড়ে যাওয়ার পর যখন ক্ষয়ক্ষতির হিসাব করা হয় তখন বেরিয়ে আসে আসল চিত্র। এখন অফলাইন ক্লাস শুরু হওয়ার পর টের পাওয়া যাচ্ছে আসল ক্ষতির খতিয়ান। আর্থিক প্রণোদনা না পাওয়ায় অনেক স্কুল শিক্ষক আর্থিকভাবে পঙ্গু হয়ে পড়েছেন। সরকার তেমনভাবে শিক্ষক ও অভিভাবকদের পাশে আর্থিক প্রণোদনা নিয়ে দাঁড়ায়নি। এ দেশে বরাবরই শিক্ষক সম্প্রদায় অন্যান্য পেশাজীবীর চেয়ে কিছুটা অচ্ছুত বিবেচিত হয়। এভাবে আর্থিক ও মানসিক সংকটে ক্লাসে শিক্ষকের নতুন করে মনঃসংযোগে কিছুটা সমস্যা হচ্ছে। ক্লাস পরীক্ষায় শিক্ষার্থীদেরও অনেকটা কষ্ট হচ্ছে মানিয়ে নিতে।

উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে সংকটটা একটু ভিন্ন। উচ্চশিক্ষায় অনলাইন ক্লাস ছিল অনেকটা জোড়াতালির। ফাঁকিবাজ শিক্ষার্থী আর শিক্ষকের জন্য অনলাইন ছিল আশীর্বাদ। সরকারিভাবে অনলাইন ক্লাসকে সাফল্য হিসেবে দেখা হয়েছে। কিন্তু বুঝতে হবে, সারা দেশে অনলাইন ক্লাস হয়েছে প্রধানত ‘জুম’ অ্যাপের মাধ্যমে। অনেকেই হয়তো জানেন জুম একটি মিটিং আইডি। ক্লাস পরীক্ষার সব সুবিধা সেখানে নেই। এর চেয়ে স্মার্ট ব্যবস্থা হিসেবে কেউ কেউ ‘গুগল ক্লাসরুম’ ব্যবহার করে অনেকটা সাফল্য পেয়েছেন। কিন্তু পৃথিবীজুড়ে এখন ‘ক্যানভাসে’র মতো আধুনিক মাধ্যমে ক্লাসরুমের বিকল্প হিসেবে ক্লাস, তথ্য, রেফারেন্স আদান-প্রদান, পরীক্ষা নেওয়া, মূল্যায়ন—সব কিছু সাফল্যের সঙ্গে সম্পন্ন করতে পারছে। কিন্তু আমাদের দেশে কয়েকটি প্রথম সারির বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়া খুব কম শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেই ক্যানভাস মাধ্যম ব্যবহার করা গেছে। দেশের সর্বত্র—প্রত্যন্ত অঞ্চলে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের প্রশিক্ষিত করে ডিভাইস দিয়ে শিক্ষার গতি সঞ্চার তো কঠিন ছিল।

যাক, তবু আমরা করোনা থেকে অনেকটা মুক্ত হতে পেরেছি। এখন শিক্ষাঞ্চলের নির্বাহীদের সামনে বড় চ্যালেঞ্জ ক্ষতি পুষিয়ে শিক্ষাকে স্বাভাবিক ছন্দে ফিরিয়ে আনা। শিক্ষাঞ্চলে শিক্ষক ও শিক্ষার্থী উভয়েই উভয়ের পরিপূরক।

কিন্তু করোনা-উত্তর স্কুল শিক্ষায় যখন নড়বড়ে অবস্থা তখন চলমান কারিকুলামকে নিয়মমাফিক ব্যবহার না করে এখনই নিম্ন মাধ্যমিক ও মাধ্যমিকে নতুন নতুন পাঠ্য বিষয় যুক্ত করা হয়েছে। যার যুক্তি কী সে প্রসঙ্গে না গিয়ে বলব এক্ষুনি অমন গোলমেলে অবস্থা সৃষ্টি করা কেন! এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে এক আতঙ্কের বিষয়। তা হচ্ছে দুনিয়াজুড়ে সভ্য দেশগুলো যেখানে নিজ দেশের ইতিহাস পাঠ আবশ্যিক বিবেচনা করে, সেখানে আমাদের সিলেবাস থেকে পূর্ণাঙ্গ বিষয় হিসেবে ইতিহাস পাঠ উঠিয়ে দিয়েছে। সমাজবিজ্ঞান গ্রন্থে অন্যান্য পাঠের সঙ্গে ১৫ নম্বরের একচিলতে ইতিহাস নামের বস্তু ভিক্ষা দেওয়া হয়েছে যেন। অর্থাৎ এগারো শতকে ব্রাহ্মণ সেন শাসকরা এবং পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে পাকিস্তানে আইয়ুব খানরা যেভাবে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালিকে নিজ ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি ভোলাতে চেয়েছে করোনা-উত্তরকালে একই ছক কষল যেন আমাদের শিক্ষা মন্ত্রণালয়। সাধারণ শিক্ষার্থীকে বদ্ধবুদ্ধিতে আটকে ফেলে কী রাজনৈতিক লাভ অর্জিত হবে, তা আমাদের বোধগম্য হচ্ছে না। অন্য পেশাজীবীদের তুলনায় আর্থিক অবস্থানে দুর্বল করে দিয়ে এমনিতেই সমাজে শিক্ষকদের সম্মান অনুজ্জ্বল করে দেওয়া হয়েছে, তার ওপর করোনার ছোবলে তাদের অনেকেরই অবস্থান আরো নাজুক এখন। তাদের পক্ষে ক্লাসরুমে কতটুকু সপ্রতিভ হওয়া সম্ভব? এ বিষয়গুলো বিবেচনায় না এনে আমরা কেমন করে করোনা-উত্তর শিক্ষা উন্নয়নে কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য অর্জন করতে পারব? এখনো সরকার স্পষ্ট করছে না জেএসসি ও পিইসির মতো এই অপ্রয়োজনীয় দুই উপদ্রব থেকে শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের মুক্ত করা হবে কি হবে না। গাইড বই নিষিদ্ধ হবে কি হবে না এ বিষয়েও কোনো সরকারি নির্দেশনা নেই। তাই মিছামিছি শিক্ষার মানের অধোগতি নিয়ে কথা তুলে লাভ কী!

পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষার মানের নিম্নমুখিনতা অনেক দিন থেকেই দৃশ্যমান। করোনাকালের দীর্ঘ সময়ে শিক্ষার্থীর শিখন উদ্দেশ্য সিকি ভাগও অর্জিত হয়েছে বলে মনে করি না। ব্যাবহারিক ক্লাস পরীক্ষাভিত্তিক বিভাগগুলো স্বাভাবিকভাবেই বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। অন্য বিভাগগুলোর অবস্থাও যে খুব ভালো তা নয়। করোনা-উত্তর এই সময়ে অবস্থা যে খুব ঘুরে দাঁড়াবে বর্তমান বাস্তবতায় তা মনে হয় না। আমাদের জাতীয় রাজনীতির মহানায়করা ক্ষমতার শক্তিকেন্দ্র হিসেবে বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসকে ব্যবহার করতে গিয়ে ‘একাডেমিক এক্সেলেন্সি’ শব্দটিকে অচেনা করে দিয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনায় যখন থেকে প্রতিভাবান অধ্যাপকদের দেয়ালের বাইরে রেখে দলীয় বিবেচনাকে প্রাধান্য দেওয়া শুরু হলো তখন থেকে এক ধাপ পতন শুরু হয়েছিল। দলীয় বিবেচনায় শিক্ষক নিয়োগ মেধাবী শিক্ষার্থীদের হতাশায় ফেলে দিল। বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস যে জ্ঞানচর্চা ও জ্ঞান সৃষ্টির প্রতিষ্ঠান তা বিস্মৃত হতে থাকলেন অনেকেই। নষ্ট ছাত্ররাজনীতি সরকারি দলের পৃষ্ঠপোষকতায় শিক্ষার্থীদের স্বাভাবিক মনন বিকাশের পথ ধোঁয়াচ্ছন্ন করে তুলল। শিক্ষক রাজনীতি ও ছাত্ররাজনীতি মৌচাকের চারপাশেই ভনভন করে ঘুরছে যেন। এমন বাস্তবতায় করোনা-উত্তরকালে উচ্চশিক্ষার অঙ্গন শিক্ষা গবেষণায় উজ্জীবিত হবে সে ভরসা করা যাচ্ছে না। এসব নেতিবাচক বাস্তবতা এখন এতটাই দৃশ্যমান যে বড় রকম হতাশায় নিপতিত হচ্ছে শিক্ষাঞ্চল।

এই অবস্থা থেকে বেরিয়ে আমাদের সার্বিক শিক্ষাকাঠামোকে যদি স্বস্তির জায়গায় নিয়ে আসতে চাই, তাহলে শিক্ষার মানোন্নয়নের জন্য সুস্পষ্ট পরিকল্পনা প্রয়োজন। আমার পর্যবেক্ষণ মতে, আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা বারবার হোঁচট খায় পরিকল্পনা ও নীতিনির্ধারণের জায়গাটিকে দলীয়করণের বৃত্তে বন্দি করার কারণে। এ ধারায় মুক্তচিন্তার বিশেষজ্ঞ কম পাওয়া যায়। এসব ক্ষেত্রে সরকারি ইচ্ছার প্রতিফলন ঘটানোর প্রাক-চিন্তা থাকলে শিক্ষা পরিকল্পনাকে উচ্চতায় নিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়।

এ সময়ের প্রথম সারির কয়েকটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের দিকে তাকাতে পারি। সেখানে শিক্ষক-ছাত্রদের মধ্যে নষ্ট রাজনীতির অপচ্ছায় ফেলার সুযোগ রাখা হয়নি বলে শিক্ষা ও গবেষণার ক্ষেত্রে তারা এগিয়ে যাচ্ছে। বিশ্ব র‌্যাকিংয়ের জায়গাটিতেও নিজ প্রতিষ্ঠানের সূচক ওপরের দিকে তুলে ধরতে পারছে।

আমরা অনুরোধ করব, এ দেশের সার্বিক শিক্ষা ব্যবস্থাপনা নিয়ে যাঁদের ভূমিকা রাখার এখতিয়ার দেওয়া হয়েছে তাঁরা করোনা-উত্তরকালের কঠিন বাস্তবতা বিবেচনায় রেখে প্রাথমিক থেকে উচ্চশিক্ষা পর্যন্ত সব অঞ্চল কেমন করে পুনর্গঠন করা যায় এর জন্য সুস্পষ্ট পরিকল্পনা গ্রহণ করবেন। যোগ্য মানুষদের মেধা প্রয়োগের সুযোগ দিয়ে এ দেশের শিক্ষার সব ধাপকে যৌক্তিক লক্ষ্য অর্জনের দিকে নিয়ে যাওয়া জনকল্যাণকামী রাষ্ট্রের জন্য জরুরি কর্তব্য বলে আমরা মনে করি। এই মুহূর্তে আমাদের লক্ষ্য থাকা উচিত শিক্ষাক্ষেত্রে করোনাকালের ক্ষতি যতটা সম্ভব কমিয়ে আনা।

লেখক : এ কে এম শাহনাওয়াজ, অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়। 

হাইকোর্টের আদেশ পেলে আইনি লড়াইয়ে যাবে বুয়েট: উপ-উপাচার্য - dainik shiksha হাইকোর্টের আদেশ পেলে আইনি লড়াইয়ে যাবে বুয়েট: উপ-উপাচার্য প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগ: তৃতীয় ধাপের ফল প্রকাশ হতে পারে আগামী সপ্তাহে - dainik shiksha প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগ: তৃতীয় ধাপের ফল প্রকাশ হতে পারে আগামী সপ্তাহে ভূমির জটিলতা সমাধানে ভূমিকা রাখবেন নবম শ্রেণির শিক্ষার্থীরা - dainik shiksha ভূমির জটিলতা সমাধানে ভূমিকা রাখবেন নবম শ্রেণির শিক্ষার্থীরা সর্বজনীন শিক্ষক বদলি চালু হোক - dainik shiksha সর্বজনীন শিক্ষক বদলি চালু হোক ডিপ্লোমা প্রকৌশলীদের বিএসসির সমমান দিতে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কমিটি - dainik shiksha ডিপ্লোমা প্রকৌশলীদের বিএসসির সমমান দিতে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কমিটি রায় জালিয়াতি করে পদোন্নতি: শিক্ষা কর্মকর্তা গ্রেফতার - dainik shiksha রায় জালিয়াতি করে পদোন্নতি: শিক্ষা কর্মকর্তা গ্রেফতার কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0043270587921143