শূন্যপাস প্রতিষ্ঠানে কারা পড়িয়েছেন - দৈনিকশিক্ষা

শূন্যপাস প্রতিষ্ঠানে কারা পড়িয়েছেন

মাসুম বিল্লাহ |

করোনা মহামারি আমাদের অনেক ঐতিহ্য ভেঙে দিয়েছে। বেশ কয়ক বছর ধরে মাধ্যমিকের পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হতো ফেব্রুয়ারি মাসে। কিন্তু মহামারির কারণে পরীক্ষা গ্রহণ করা হয় ২০২১ খ্রিষ্টাব্দের নভেম্বর মাসে। অবস্থা অনুযায়ী ব্যবস্থা। ২০২০ খ্রিষ্টাব্দের মার্চে সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যাবার পর বর্তমান এসএসসি পরীক্ষার্থীরা মাত্র আড়াই মাস সময় পেয়েছিল শ্রেণিকক্ষের শিক্ষা গ্রহণ করতে। অনলাইনে যদিও কিছুটা হয়েছে, কিন্তু পুরো তো হয়নি। গত বছর ১২ সেপ্টেম্বর শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো খুলে দেয়ার পর দেড়মাস শ্রেণিকক্ষে ক্লাস করে তারা এসএসসি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করেছে। অন্যান্য বছরের মতো এবার সব বিষয়ের পরীক্ষা হয়নি। শুধু গ্রুপভিত্তিক বিজ্ঞান, মানবিক ও ব্যবসায় শিক্ষার তিনটি বিষয়ে সময় ও নম্বর কমিয়ে গুরুত্বপূর্ণ এই পাবলিক পরীক্ষাটি অনুষ্ঠিত হয়। এটি মন্দের ভাল। কারণ  ‘অটোপাসে’ শিক্ষার্থী, অভিভাবক ও প্রতিষ্ঠান কারুরই তৃপ্তির কোন জায়গা থাকে না। এবার অন্য আবশ্যিক বিষয় ও চতুর্থ বিষয়ের পরীক্ষা হয়নি। এসব বিষয়ে জেএসসি ও সমমানের পরীক্ষার নম্বরের ভিত্তিতে ‘ম্যাপিং’ করে নম্বর দেয়া হয় এবং এগুলোর ভিত্তিতেই এসএসসি ও সমমানের ফল ঘোষণা করা হয়। ফল ঘোষণা করা মানে উচ্ছল তরুণ-তরুণীদের মনে উচ্ছ্বাসের বান জাগানো। কারণ এটি জীবনের এক বিরাট পরিবর্তন ও বিশাল আনন্দের বিষয়।

করোনাভাইরাস মহামারির কারণে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় ২০২১ খ্রিষ্টাব্দে নয় মাস পিছিয়ে গত ১৪ নভেম্বর এসএসসি পরীক্ষা শুরু হয়। শেষ হয় ২৩ নভেম্বর। সেটা ছিল দেড় বছর পর প্রথম কোন পাবলিক পরীক্ষা। ২০২১ খ্রিষ্টাব্দে এসএসসিতে পরীক্ষার্থী ছিল ২২ লাখ ২৭ হাজার ১১৩ জন। দেশের ইতিহাসে এবারই প্রথম মাধ্যমিকে আংশিক পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়েছে। করোনা মহামারির কারণে ৫৪৪ দিন টানা স্কুল বন্ধ থাকায় মাধ্যমিকের সব বিষয়ের পরীক্ষা নেয়া যায়নি। একই কারণে আগেই কমানো হয়েছিল মাধ্যমিকের সিলেবাসও। পরীক্ষার ফলাফলে দেখা যায়, সারা দেশের ১৮টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের কোন পরীক্ষার্থীই পাস করতে পারেনি। আবার তার বিপরীতে ৫ হাজার ৪৯৪টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পাসের হার শতভাগ। গত বছর ১০৪টি প্রতিষ্ঠান থেকে কেউই পাস করেনি। সে তুলনায় বিষয়টি ভাল বলা যাবে। তবে একজন শিক্ষার্থীও যেসব প্রতিষ্ঠান থেকে কৃতকার্য হয়নি, তাদের ব্যাপারে গভীরভাবে ভাবতে হবে। কৃতকার্য হতে না কারণগুলো বের করতে হবে। এগুলো কি  এমপিওভুক্ত প্রতিষ্ঠান নাকি নন-এমপিও? এমপিওভুক্ত প্রতিষ্ঠান হলে অবশ্যই জবাবদিহির আওতায় আনতে হবে প্রতিষ্ঠান প্রশাসনকে। তবে এখানে একটি দুর্বলতা লক্ষ করা যাচ্ছে। সেটি হচ্ছে জাতিকে জানানো যে, এই প্রতিষ্ঠানগুলো কোন ধরনের? কী ধরনের প্রতিষ্ঠান? কারা কারা এখানে পড়িয়েছেন? কীভাবে পড়িয়েছেন? এ দায়িত্ব মাধ্যমিক ও উ্চচশিক্ষা অধিদপ্তর, কারিগ শিক্ষা অধিদপ্তর ও মাদরাসা শিক্ষা অধিদপ্তরের। পুরো বিষয়গুলো নিয়ে পর্যালোচনা করে অধিদপ্তরগুলোর উচিত জাতির সামনে তা উপস্থাপন করা, যাতে সবাই মিলে এসব প্রতিষ্ঠানকে সহায়তা করা যায়। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোকে সহায়তা করার জন্য সরকারি বেসরকারি আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বহু প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তি আছেন। তাদের সাথে শুধু সমন্বয় দরকার। এসব প্রতিষ্ঠান ঠিক কী ধরনের, দেখা যাবে অধিদপ্তর কিংবা মন্ত্রণালয়ের এ নিয়ে কোন মাথাব্যথা নেই। আমরা হয়তো প্রিন্ট মিডিয়ার সাংবাদিক ভাই-বোনদের কাছ থেকেই জানব। কিন্তু জানতে পারব না শিক্ষা সংশ্লিষ্টদের কাছ থেকে। এটি শিক্ষাক্ষেত্রে একটি দুঃখজনক বাস্তবতা।
 
আগে সাধারণত এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষার বড় নিয়ামক হিসেবে দেখা হতো তুলনামূলক কঠিন বলে পরিচিত ইংরেজি এবং গণিত বিষয়কে। কিন্তু এবার বাধ্যতামূলক এসব বিষয় এবং চতুর্থ বিষয়ে কোন পরীক্ষা হয়নি। তবে, বাংলা ও ইংরেজি হচ্ছে বেসিক বিষয়। এদুটোর পরীক্ষা ছাড়া কিন্তু মূল্যায়ন করা কঠিন। ভাষাগত জ্ঞান না থাকলে কোন বিষয়েই ভাল করা যায় না। ভাষা হচ্ছে সঠিক যোগাযোগ, কোনও কিছু বোঝা এবং বোঝানোর মাধ্যম। সংক্ষিপ্ত পরীক্ষা গ্রহণের সময়েই বড় বড় শিক্ষাবিদগণ বলেছিলেন, এই দুটো বেসিক বিষয়ের পরীক্ষা না হওয়া মানে সঠিক মূল্যায়ন হচ্ছে না। কঠিন বিষয়ে পরীক্ষা না হওয়া, সংক্ষিপ্ত সিলেবাস অনুসরণ এবং বিষয় সংখ্যা কমানোর কারণেই এবার পাসের হার ও জিপিএ-৫ প্রাপ্তির হার অনেক বেশি। প্রশ্নপত্রে বিকল্প অনেক বেশি ছিল, এটিও একটি কারণ।


 
‘কাজেই এই ভাল মানে এতো ভাল হয়ে গেছে ----এই সরলীকরণ করা ঠিক হবে না। সবকিছু নির্ভর করবে অতিমারির পরের অবস্থার ওপর।’----মন্তব্যটি করেছেন মাননীয় শিক্ষামন্ত্রী। তাঁর সাথে আমি একমত পোষণ করছি। সংক্ষিপ্ত সিলেবাসে পরীক্ষা নেয়ার পরেও ৬ শতাংশের বেশি শিক্ষার্থী এবার অকৃতকার্য হয়েছে। এর পেছনে একটি কারণ হতে পারে এমসিকিউতে অকৃতকার্যতা। প্রতিটি বিষয়ে সিকিউ(সৃজনশীল)এবং এমসিকিউতে ফেল করেছে। এছাড়া কিছু শিক্ষার্থী সিকিউ অংশে পাস করতে পারেনি। এটি আর একটি বড় দুর্বলতা। আমাদের তরুণ ও স্মার্ট শিক্ষার্থীদের সৃজনশীল হওয়ার যথেষ্ট সুযোগ রয়েছে। কিন্তু মূল্যায়ন পদ্ধতি ও শিক্ষাদান পদ্ধতির দুর্বলতার কারণে তাদের সুপ্ত সৃজনশীল প্রতিভা চাপাই পড়ে থাকে। শিক্ষা বোর্ড ও শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বলছেন, মূলত বিশেষ ব্যবস্থায় পরীক্ষা ও মূল্যায়নের কারণেই ফল এত ভাল হয়েছে। আমরাও তাই মনে করি।

দেশের সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হয়তো একরকম হবে না। কিন্তু এক প্রতিষ্ঠান থেকে অন্য একটি প্রতিষ্ঠানের মাঝে যাতে আকাশ-পাতাল ব্যবধান না থাকে, সে বিষয়ে সংশ্লিষ্টদের দৃষ্টি দেয়া একান্ত প্রয়োজন।শিক্ষাক্ষেত্রে বিরাজমান হাজার বৈষম্যের মধ্যে এটি অন্যতম। মানসম্মত শিক্ষার কথা আমরা সব সময়ই বলে থাকি। কিন্তু বিষয়টি আসলে কী, সে সম্পর্কে আলোচনা হওয়া দরকার। একজন শিক্ষার্থী তার নিজ পাঠ্যপুস্তকের বাইরের জগৎ সম্পর্কে জানতে পারবে, নিজ পাঠ্যপুস্তকে যা যা শিখেছে, সেগুলো বাস্তব জীবনে কাজে লাগাতে পারবে, তাদের চিন্তনদক্ষতা বৃদ্ধি পাবে, তাদের কমিউনিকেশন বা যোগাযোগের দক্ষতা কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় থাকবে। সঠিকভাবে ভাষা ব্যবহার করতে পারবে---এগুলোর সমন্বিত রূপই হচ্ছে মানসম্মত শিক্ষা। একইভাবে শিক্ষকদেরও ক্রিটিক্যাল থিংকিং স্কিল উন্নত হতে হবে, শিক্ষাবিজ্ঞানের জরুরি ও প্রয়োজনীয় বিষয়গুলো সম্পর্কে ওয়াকিফহাল হতে হবে এবং সেভাবে শিক্ষার্থী ডিলিং করতে জানতে হবে। শিক্ষার্থীদের ভেতর জ্ঞানপিপাসা জাগ্রত করার কৌশল জানতে হবে। নিজের উপস্থাপন দক্ষতা হতে হবে আকষর্ণীয়। ইনফরমেশন টেকনোলজি সম্পর্কে ধারণা থাকতে হবে এবং এর ব্যবহার জানতে হবে। একজন শিক্ষার্থী প্রচলিত নিয়মে হয়তো তার দক্ষতা প্রদর্শন করতে পারেনি। কিন্তু তার অন্তর্নিহিত দক্ষতা একজন শিক্ষককে আবিষ্কার করতে জানতে হবে এবং সে অনুযায়ী তাকে গাইড করা এবং মূল্যায়ন করার দক্ষতা ও কৌশল অবলম্বন করতে হবে। সেটিই কিন্তু প্রকৃত মুল্যায়ন। 
 
লেখক : মাছুম বিল্লাহ, প্রেসিডেন্ট, ইংলিশ টিচার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ইট্যাব)

হাইকোর্টের আদেশ পেলে আইনি লড়াইয়ে যাবে বুয়েট: উপ-উপাচার্য - dainik shiksha হাইকোর্টের আদেশ পেলে আইনি লড়াইয়ে যাবে বুয়েট: উপ-উপাচার্য প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগ: তৃতীয় ধাপের ফল প্রকাশ হতে পারে আগামী সপ্তাহে - dainik shiksha প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগ: তৃতীয় ধাপের ফল প্রকাশ হতে পারে আগামী সপ্তাহে ভূমির জটিলতা সমাধানে ভূমিকা রাখবেন নবম শ্রেণির শিক্ষার্থীরা - dainik shiksha ভূমির জটিলতা সমাধানে ভূমিকা রাখবেন নবম শ্রেণির শিক্ষার্থীরা সর্বজনীন শিক্ষক বদলি চালু হোক - dainik shiksha সর্বজনীন শিক্ষক বদলি চালু হোক ডিপ্লোমা প্রকৌশলীদের বিএসসির সমমান দিতে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কমিটি - dainik shiksha ডিপ্লোমা প্রকৌশলীদের বিএসসির সমমান দিতে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কমিটি রায় জালিয়াতি করে পদোন্নতি: শিক্ষা কর্মকর্তা গ্রেফতার - dainik shiksha রায় জালিয়াতি করে পদোন্নতি: শিক্ষা কর্মকর্তা গ্রেফতার কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.003662109375