শেখ হাসিনা: দ্যা এডিটর - দৈনিকশিক্ষা

শেখ হাসিনা: দ্যা এডিটর

আব্দুল্লাহ আল হাদী |

মৃতের ধৈর্য গুণ আর জীবিতের ব্যথার ভাঙনে জমা থাকে যেমন প্রচণ্ড শক্তি, আর যারা এ শক্তি সহ্য করতে পারেন, তাঁদের দিয়ে ঈশ্বর প্রকাশ করান সত্য। এখন প্রশ্ন হতে পারে, সত্য কি? -সত্য পৃথিবীর দিক নির্দেশনা। মানুষ মাঝে-মধ্যেই সত্যকে হারিয়ে ফেলেন, তাই ঈশ্বর কোন কোন মানুষকে রেখে দেন সেই সত্যের সন্ধানে, যেমন শেখ হাসিনা। এখন প্রশ্ন হচ্ছে সত্য শেখ হাসিনাকে সন্ধান করেছে, নাকি শেখ হাসিনা সত্যকে সন্ধান করে চলেছেন। কোন কোন সময় তা যুগপৎ ভাবেও ঘটে।

কথিত আছে, খুনি তার নিজের অজান্তেই সাক্ষী রেখে যায়। পৃথিবীতে মাঝে-মধ্যে শুধু মানুষ-ই নয়, মাঝে-মধ্যে ইতিহাসও খুন করা হয়। সে জন্যই ঈশ্বর বার বার মানুষের মধ্যে চেতনার ঐশ্বর্য দান করেন, যা সত্যকে চুম্বকের ন্যায় আকৃষ্ট করে এবং সে সকল মানুষ সেসব সত্যকে ঈশ্বরের প্রতিনিধি হিসেবে প্রকাশ করেন, এবং তাতে তাঁরা অশুভচক্রের প্রতিবন্ধকতারও শিকার হন। কিন্তু প্রকৃত মানুষকে কখনো দাবায় রাখা যায় না, আর ব্যাথিত হৃদয়কে তো নাই-না।

১৯৭৫ এর ১৫ আগস্টের পর পৃথিবীর সকল মানুষের ব্যথা এক জায়গায় জড় করলেও হয়ত শুদ্ধ বাঙালির যে কোন এক জনের হৃদয়ের ব্যথার সমান হবে কি-না তা প্রশ্ন থেকে যায়, আর শেখ হাসিনার মতো শুদ্ধ হৃদয় তো অবশ্যই। বলতে পারেন- হৃদয় শুদ্ধ হয় কীভাবে? সরল করে বললে অনেক উপাদানের মধ্যে ত্যাগের মহিমা-ই হৃদয়কে বেশি শুদ্ধ করে। যে ত্যাগ তিনি (শেখ হাসিনা) নিজে চোখে দেখে বড় হয়েছেন, কীভাবে একটা পরিবার একটা ভৌগলিক অংশের নির্যাতিত মানুষের পরিবারে পরিণত হতে পারে। কীভাবে একজন মানুষ একটা অসম্ভবকে সম্ভব করে তুলতে পারেন নিপীড়িত মানুষের মুক্তির জন্য। সেই দীর্ঘ যাত্রা পথের একটি সহজ অনুমেয় চিত্র যা একদিন চির তরে মুছে ফেলতে চাওয়া হয়ে ছিল।

শেখ হাসিনা সেই বাঙালির মুক্তির সংগ্রামকেই খুঁজে খুঁজে হুবহু কয়েক ভাগে সম্পাদনা করেছেন, দিয়েছেন গৌরবান্বিত হওয়া শিকড়ের সন্ধান, প্রকাশ করে চলেছেন Secret Document of Intelligence Brance on Father of the Nation Bangabandhu Sheikh Mujibur Rahman। একটা দীর্ঘ সত্যের সম্পাদনা করে চলেছেন তিনি, যা প্রকাশ না পেলে হয়ত আমরা কোনদিন বিকৃত হওয়া ইতিহাসের মধ্যে তথ্য-উপাত্তসহ জানতেই পারতাম না -কেমন ছিল সেই সব দিন? কারা ছিল? মুজিবসহ কতজন গ্রেফতার হয়েছিল ১৯৪৮ সালের ১১ মার্চের ভাষা দিবসে, ১৯৫২ সালের শহীদ দিবসের পরে শহীদের প্রাণের দাবী কীভাবে বাঙালির মনে রক্তের হরফে বুনে গিয়েছিল, মুজিবসহ কে বা কারা গ্রামে-গঞ্জে দেশে-বিদেশে বপন করেছিল 'ভাষার জন্য শহীদের রক্ত বৃথা হতে দেওয়া হবে না।ধারাবাহিকভাবে কতদূর আনুভূমিক সহ্য করতে হয়েছিল তরুণ ছাত্রনেতা মুজিবকে ১৯৪৮, ১৯৫২, ১৯৫৪ এর যুক্তফ্রট নির্বাচন সহ তার পরবর্তী সময়গুলোতে। ১৯৫৬ সালে প্রবল সাংগঠনিক সংকটে কীভাবে মুজিব হাল ধরেছিলেন শেষ পর্যন্ত চূড়ান্ত বিজয়ের পথে। কীভাবে কাশ্মীর ইস্যুতে সোহরাওয়ার্দী সাহেবকে নিয়ে মুজিব জনমত তৈরি করতে পেরেছিলেন, কাশ্মীর ইস্যুতে নেহেরুর সাথে মওলানা ভাসানির গোপন কোয়ালিশন, তার আগে ৫৪ সালে ৮৭ বছর বয়স্ক একে ফজলুল হক সাহেবের মন্ত্রীপরিষদে ৫২ এর ভাষা আন্দোলনে ছাত্র হত্যায় পুলিশের সহায়তাকারি মোহন মিঞাদের অংশগ্রহণ নিয়ে মুজিবের অসন্তোষ এবং তাঁর চেষ্টায় সেখানে অনাস্থা জ্ঞাপন, যুক্তফ্রন্ট ভেঙে যাওয়া। নানাবিধ অজানা তথ্য নানা ধরনের পত্র, বক্তৃতা, বিবৃতি যা থেকে আমরা একটি সফল বিপ্লবের প্রথম থেকে বস্তুনিষ্ঠ চিত্রকল্প পাই। বস্তুনিষ্ঠ বললাম এই জন্য যে, এই সম্পাদিত গ্রন্থ সমূহ কোন ব্যক্তি লেখকের লেখা নয়, যা ছিল সম্পূর্ণ বাঙালীদের বিপরীতে কাজ করা একটি প্রশিক্ষিত বাহিনীর গোয়েন্দা তথ্য। যে কারণে কারো ব্যক্তি আবেগে ইতিহাসের দিক পরিবর্তন হওয়ার কোন সম্ভাবনা সেখানে ঘটেনি নিশ্চিতভাবে বলা যায়। জানা যায়, মুজিব কীভাবে গ্রামের পর গ্রামে জনসভা করে করে, দিনের পর দিন ঘুরে ঘুরে জানতে পেরেছেন এদেশের দেশীয় অর্থনীতির নিজস্ব সংস্করণ, সম্ভাবনাময় সোনার মাটি ও মানুষ। দিনের পর দিন কারাগারে কাটিয়ে কাটিয়ে তিনি জানতে পেরেছিলেন বাঙালিকে চূড়ান্তভাবে মুক্ত করেই তাঁর মুক্তির কথা ভাবতে হবে।

পৃথিবীর চূড়ান্ত যতগুলি প্রকাশন ঘটেছে তার মধ্যে বোধ হয় তৎকালীন পাকিস্তানি সিক্রেট ডকুমেন্টে থেকে এই সম্পাদিত গ্রন্থের খণ্ডগুলোই সবচেয়ে বেশি ইতিহাস বিকৃতির বিপরীতে আজ খাড়া সত্য অনুষঙ্গ হিসেবে প্রকাশ পেয়েছে, কেননা ধারনা করা হয় পৃথিবীর মধ্যে ইতিহাস বিকৃতি এদেশেই অর্থাৎ বাংলাদেশেই সবচেয়ে বেশি হয়েছে। ১৫ আগস্টের হত্যাকাণ্ড কোন ব্যক্তি মানুষের হত্যাকাণ্ড ছিল না, সেটি ছিল একটা দীর্ঘ সংগ্রামের ধারাবাহিক পথ রেখাকে মুছে ফেলার বহুমুখী সুপরিকল্পিত প্রচেষ্টা। এই জন্যই আমরা পুরাতন এই ডকুমেন্ট সমূহ যা মোট ১৪ খণ্ডে গ্রন্থিত হবে ১৯৪৮-১৯৭১ সাল পর্যন্ত।

এখন পর্যন্ত এখান থেকে আমরা ১৯৬১ সাল পর্যন্ত জানতে পেরে নিজেদের মধ্যে উজ্জীবিত এবং শেখহাসিনার কাছে কৃতজ্ঞতা অনুভব করছি  এই জন্য যে শেষ পর্যন্ত তিনি হাল ছাড়েন নাই। শত প্রতিকূলতার মধ্যেও তিনি এই পরিশ্রমলব্ধ কাজটি করে যেতে পেরেছেন এবং প্রজন্মের জন্য রেখে গেলেন গৌরবান্বিত হওয়ার এক অমূল্য দলিল কিংবা তথ্য ভাণ্ডার। এবং এধরনের বৃহৎ প্রকাশনা থেকে সহজেই অনুমান করা যায় শেখ হাসিনার ব্যতিক্রমী এক সম্পাদকীয় গুণাবলী।

সিক্রেট ডকুমেন্ট ছাড়াও শেখ হাসিনা কর্তৃক সম্পাদিত আরো তিনটি গ্রন্থ হলো অসমাপ্ত আত্মজীবনী -শেখ মুজিবুর রহমান, কারাগারের রোজনামচা -শেখ মুজিবুর রহমান, আমার দেখা নয়াচীন -শেখ মুজিবুর রহমান। যা ছিল কতগুলো ডায়েরি, বঙ্গবন্ধু মুজিব জেলে বসে যা লিখে ছিলেন। এগুলো গ্রন্থ আকারে ছিল না। টেক্সটগুলো হুবহু অপরিবর্তিত রেখে শেখ হাসিনা তাঁর সম্পাদিত এসকল গ্রন্থের ভূমিকা লিখতে গিয়ে অনেক কথাই প্রাসঙ্গিকভাবে তুলে ধরেছেন, যেমন 'আমার দেখা নয়াচীন' সম্পাদিত গ্রন্থের ভূমিকায় শেখ হাসিনা নিজেই লিখেছেন এভাবে- "এই ভ্রমণকাহিনি যতবার পড়েছি আমার ততবারই মনে হয়েছে যে তিনি গভীর পর্যবেক্ষণ করেছেন প্রতিটি ক্ষেত্রে। তার কারণ হলো তাঁর ভিতরে যে সুপ্ত বাসনা ছিল বাংলার মানুষের মুক্তির আন্দোলন ও স্বাধীনতা অর্জন সেটাই বারবার ফুটে উঠেছে আমার মনে, এ-কথাটও অনুভব করেছি।" ভূমিকার এই লেখার একটু নিচেই তিনি রচনার সাল নিয়ে লিখেছেন- "১৯৫২ সালের চীন ভ্রমণের এ কাহিনি তিনি রচনা করেছিলেন ১৯৫৪ সালে যখন কারাগারে ছিলেন। তাঁর লেখা খাতাখানার ওপর গোয়েন্দা সংস্থার সেন্সর ও কারাগার কর্তৃপক্ষের যে সিল দেওয়া আছে তা থেকেই সময়কালটা জানা যায়।" এবং একই ভাবে তিনি কারাগারের রোজনামচা গ্রন্থের ভূমিকায় গ্রন্থটি সম্বন্ধে বলতে গিয়ে বলেছেন- "বর্তমান বইটার নাম ছোট বোন রেহানা রেখেছে- 'কারাগারের রোজনামচা' । এতটা বছর বুকে আগলে রেখেছি যে অমূল্য সম্পদ-আজ তা তুলে দিলাম বাংলার জনগণের হাতে । "পাঠকদের হাতে বিশেষ করে বাংলাদেশের মানুষের কাছে এই ডায়েরির লেখাগুলি যে তুলে দিতে পেরেছি তার জন্য আল্লাহর কাছে শুকরিয়া আদায় করছি। অসমাপ্ত আত্মজীবনী বাঙালি জাতির অধিকার আদায়ের সংগ্রামের পথপ্রদর্শক ।"

অসমাপ্ত আত্মজীবনী গ্রন্থের ভূমিকায় তিনি লিখেছেন-"এই মহান নেতা নিজের হাতে স্মৃতিকথা লিখে গেছেন যা তার মহাপ্রয়াণের উনত্রিশ বছর পর হাতে পেয়েছি। তিনি যা দেখেছেন, উপলব্ধি করেছেন এবং রাজনৈতিকভাবে পর্যবেক্ষণ করেছেন সবই সরল সহজ ভাষায় প্রকাশ করেছেন। তাঁর এই সংগ্রাম, অধ্যাবসায় ও আত্মত্যাগের মহিমা থেকে যে সত্য জানা যাবে তা আগামী প্রজন্মকে অনুপ্রাণিত করবে। ইতিহাস বিকৃতির কবলে পড়ে যারা বিভ্রান্ত হয়েছেন তাদের সত্য ইতিহাস জানার সুযোগ করে দেবে। গবেষক ও ইতিহাসবিদদের কাছে এ গ্রন্থ মূল্যবান তথ্য ও সত্য তুলে ধরবে।"

সিক্রেট ডকুমেন্টের ভূমিকায় তিনি (শেখ হাসিনা) লিখেছেন- "'কারাগারের রোজনামচা' নামে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের যে ডাইরিটা প্রকাশিত হয়েছে সেই বইয়ের প্রথম অংশের লেখা খাতাটা বাজেয়াপ্ত করা হয়েছিল। সেই লেখা খাতাখানাও সংগ্রহ করা হয়েছে এখান থেকেই। এভাবে বহু দুর্লভ ও মূল্যবান তথ্যসমূহ আমরা পেয়েছি। আরও অনেক বিষয় রয়েছে যা বাংলাদেশ নামে এই ভু-খণ্ডের স্বাধীনতা সংগ্রামের অমূল্য দলিল হিসেবে পাওয়া গেছে।"

গ্রন্থগুলোর সম্পাদক এগুলোকে অমূল্য দলিল হিসেবে প্রকাশ করেছেন, আর আমরা মনে করেছি তিনি জাতিকে সুস্থতা দান করেছেন, কেননা দীর্ঘদিন বিকৃত ইতিহাসের মধ্যে মুখ গুঁজে থাকা একটা জাতিকে ফের পুনরায় চেতনার সঙ্গে সংযুক্ত করতে পারা, সে তো জাতিকে সুস্থতা দান করারই সমান। সৃষ্টিকর্তা শেখ হাসিনাকে সেই শক্তি দান করেছেন, আমি এবং আমরা তরুণ প্রজন্মের মানুষেরা সৃষ্টিকর্তার কাছে শেখ হাসিনার দীর্ঘায়ু কামনা করি। কেননা তিনি প্রজন্ম থেকে প্রজন্মকে শিকড় বিহীন, গৌরবহীন প্রজন্মে পরিণত হওয়ার হাত থেকে রক্ষা করেছেন। সত্যের সন্ধানে মজবুত ভিত্তি দিয়েছেন। যে ভিত্তি আমাদের আরো বদ্ধমূল নির্দেশনা দিয়েছে যে শেখ হাসিনা পৃথিবীর তাবৎ সৃষ্টিশীল মানুষদের মধ্যে অন্যতম সম্পাদকীয় গুণাবলীর অধিকারী, এবং সত্য প্রকাশে অক্লান্ত কর্মী।

 লেখক: আব্দুল্লাহ আল হাদী, কবি ও সাহিত্যিক এবং সভাপতি, ৩১তম বিসিএস ক্যাডার অ্যাসোসিয়েশন। 

দেশে তিন দিনের হিট অ্যালার্ট জারি - dainik shiksha দেশে তিন দিনের হিট অ্যালার্ট জারি আকাশে তিনটি ড্রোন ধ্বংস করেছে ইরান, ভিডিয়ো প্রকাশ - dainik shiksha আকাশে তিনটি ড্রোন ধ্বংস করেছে ইরান, ভিডিয়ো প্রকাশ অভিভাবকদের চাপে শিক্ষার্থীরা আত্মকেন্দ্রিক হয়ে উঠছেন - dainik shiksha অভিভাবকদের চাপে শিক্ষার্থীরা আত্মকেন্দ্রিক হয়ে উঠছেন আমি সরকার পরিচালনা করলে কৃষকদের ভর্তুকি দিবই: প্রধানমন্ত্রী - dainik shiksha আমি সরকার পরিচালনা করলে কৃষকদের ভর্তুকি দিবই: প্রধানমন্ত্রী বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে মামলা ১২ হাজারের বেশি - dainik shiksha বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে মামলা ১২ হাজারের বেশি শিক্ষকদের অবসর সুবিধা সহজে পেতে কমিটি গঠন হচ্ছে - dainik shiksha শিক্ষকদের অবসর সুবিধা সহজে পেতে কমিটি গঠন হচ্ছে শিক্ষকদের শূন্যপদ দ্রুত পূরণের সুপারিশ - dainik shiksha শিক্ষকদের শূন্যপদ দ্রুত পূরণের সুপারিশ ইরানে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালালো ইসরায়েল - dainik shiksha ইরানে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালালো ইসরায়েল কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0068521499633789