জটিলতায় ৬ বছর ধরে বেতন-ভাতা পাচ্ছেন না রুমা উপজেলার জাতীয়করণকৃত রুমা সাঙ্গু সরকারি কলেজের শিক্ষক-কর্মচারীরা। ফলে পরিবার-পরিজন নিয়ে মানবেতর দিন কাটাচ্ছেন প্রতিষ্ঠানটিতে কর্মরত ১১ শিক্ষক ও ৩ কর্মচারী।
সরেজমিন দেখা যায়, রুমা-বান্দরবান সড়কের পাশে সাঙ্গু নদীর কোল ঘেঁষে প্রায় তিন একর জমির ওপর প্রাকৃতিক মনোরম পরিবেশে কলেজটির অবস্থান। সীমানার ভেতরে ঢুকতেই হাতের বামপাশে চোখে পড়ে ভাষাশহীদদের স্মরণে আধুনিক মানের শহীদ মিনার, একাডেমিক ভবন, শ্রেণিকক্ষ, অফিস, শিক্ষক ডরমেটরি, ছাত্র ও ছাত্রীদের হোস্টেলসহ চলমান কয়েকটি উন্নয়ন কাজ। একটি সরকারি কলেজে যা যা থাকার কথা সবই রয়েছে বলাই যায়। নেই শুধু কলেজে কর্মরত শিক্ষক-কর্মচারীদের মুখে হাসি। তাদের চোখে-মুখে লক্ষ করা গেছে হতাশা ও দুশ্চিন্তার ছাপ।
অফিস সহায়ক মো. জাফর আলম জানান, কলেজটি সরকারি হয়েছে ঠিক, কিন্তু ৬টি বছর বেতন পাচ্ছি না। দুই সন্তান, স্ত্রী আর মাকে নিয়ে খুব কষ্টে আছি। আত্মীয়স্বজনও পয়সাওয়ালা নেই। দোকানদারও আর বাকি দিতে চাচ্ছেন না। তাই খেয়ে-না খেয়ে কষ্টে দিন পার করছি।
নৈশপ্রহরী লুপ্রম্নমং মার্মা জানান, তিন সন্তান নিয়ে মানবেতর জীবন পার করছি। সংসারে
অভাবের কারণে ৪ বছর আগে তিন সন্তান রেখে স্ত্রী বাপের বাড়ি চলে গেছে। বড় মেয়েটা অন্যের ক্ষেত-খামারে দিনমজুরি করে যা পায়, তা দিয়ে কোনোরকম সংসার চলছে। বেতন-ভাতা কখন পাব জানি না।
জানা যায়, ২০০০ খ্রিষ্টাব্দে উপজেলার স্থানীয় কয়েকজন শিক্ষানুরাগী ব্যক্তিদের সমন্বয়ে প্রতিষ্ঠা করা হয় রুমা সাঙ্গু কলেজ। প্রতিষ্ঠার পর বছর কয়েক আগে কিছুসংখ্যক ছাত্রছাত্রী নিয়ে পথচলা শুরু করে এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটি। পরে তখনকার নানা রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার কারণে বন্ধ হয়ে যায় কলেজটি। দীর্ঘ ১২ বছর বন্ধ থাকার পর ২০১৩ সালে ১৭ সেপ্টেম্বর বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা রুমা সাঙ্গু ব্রিজ উদ্বোধনে আসেন। এসময় তিনি প্রত্যেক উপজেলায় একটি করে সরকারি কলেজ প্রতিষ্ঠার ঘোষণা দেন। এরই জেরে দীর্ঘ ১২ বছর বন্ধ থাকার পর ২০১৪ সালে ৬ শিক্ষক ও ৫৭ ছাত্রছাত্রী নিয়ে আবার যাত্রা শুরু করে কলেজটি। এরপর ২০১৬ সালে দেশের ২১৭টি কলেজকে সরকারীকরণের ষোষণা দেয় সরকার। পরে ২০১৮ সালে ৮ আগস্ট জাতীয়করণের জন্য ঘোষিত কলেজগুলোর গেজেট প্রকাশ করে।
এ সময় পার্বত্য মন্ত্রীর ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় রুমা সাঙ্গু কলেজটিকেও জাতীয়করণের আওতায় আনা হয়। এরপর কলেজটির নামকরণ হয় 'রুমা সাঙ্গু সরকারি কলেজ'। শুরু হয় কলেজে ছাত্রছাত্রী ভর্তি, বিভিন্ন অবকাঠামো উন্নয়ন, শিক্ষক নিয়োগসহ শ্রেণি কার্যক্রম। প্রাণ ফিরে পায় কলেজটি। ইতোমধ্যে ২০২১ সাল পর্যন্ত ৬টি ব্যাচ এ কলেজ থেকে এইচএসসি পরীক্ষা দিয়ে সাফল্যের সঙ্গে উত্তীর্ণ হয়ে শিক্ষার্থীরা বেরিয়ে গেছে বলে জানিয়েছে কলেজ কর্তৃপক্ষ।
সূত্র জানায়, কলেজটি জাতীকরণের পর ২০১৯ সালে মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তরে শিক্ষক ও কর্মচারীদের ফাইলপত্র প্রেরণ করা। এরপর ২০২১ সালে ১১ মার্চ কলেজে কর্মরত ১১ শিক্ষক ও ৩ কর্মচারীর ফাইল প্রেরণ করা হয় শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে কাগজপত্র যাচাই-বাছাইয়ের পর ৮ শিক্ষকের কাগজপত্রে অসঙ্গতি পাওয়ায় আটকে যায় তাদের ফাইলগুলো। অন্য ৩ শিক্ষক ও ৩ কর্মচারীর কাগজপত্র সঠিক থাকায় তাদের ফাইল চলে যায় অর্থ মন্ত্রণালয়ে। ফাইলগুলো বর্তমানে মন্ত্রিপরিষদ বৈঠকে অনুমোদনের অপেক্ষায় আছে বলে জানা গেছে।
এদিকে এরই মধ্যে 'নো বিসিএস নো ক্যাডার' আন্দোলনের কারণে বেসরকারি শিক্ষক ও কর্মচারী আত্মীকরণ বিধিমালা-২০০০ বাতিল করে 'বেসরকারি শিক্ষক ও কর্মচারী আত্মীকরণ বিধিমালা-২০১৮ গেজেট প্রকাশের কারণে কলেজ সরকারীকরণ প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত না হয়ে দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হয়।
শিক্ষক নুখ্যাইপ্রম্ন মার্মা বলেন, আমাদের অবস্থা এতটাই খারাপ যে, এখন সুদে টাকা নিয়ে চলতে হচ্ছে। আর পারছি না। তাই আমাদের বিষয়টি বিবেচনার জন্য সরকারের কাছে দৃষ্টি আকর্ষণ করছি।
কলেজের অধ্যক্ষ (ভারপ্রাপ্ত) সুইপ্রম্নচিং মার্মা বলেন, চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে কলেজটি আজ রুমা উপজেলার একমাত্র সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠ হিসেবে জ্ঞানার্জনের প্রাণকেন্দ্রে পরিণত হয়েছে। কিন্তু আমিসহ ১১ শিক্ষক ও ৩ কর্মচারীর ৬ বছর বেতন-ভাতা বন্ধ থাকায় পরিবার-পরিজন নিয়ে মানবেতর জীবনযাপন করতে হচ্ছে।
তিনি আরও বলেন, কর্মরত শিক্ষক-কর্মচারীরা শ্রম দিলেও তারা শ্রমের মজুরি পাচ্ছেন না। দিনের পর দিন মাসের পর মাস ও বছরের পর বছর শ্রম দিয়ে শিক্ষার্থীদের পাঠদান করে তারা কলেজটি সচল রেখেছেন। তাই বিষযটি সুরাহার জন্য পার্বত্য মন্ত্রীর মাধ্যমে সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন তিনি।