সি আর দত্ত : কীর্তিমানের মৃত্যু নেই - দৈনিকশিক্ষা

সি আর দত্ত : কীর্তিমানের মৃত্যু নেই

রিপন চন্দ্র ভৌমিক |
১৯২৭ খ্রিষ্টাব্দের ১ জানুয়ারি মহান মুক্তিযুদ্ধের ৪ নং সেক্টর কমান্ডার মেজর জেনারেল সি আর দত্তের জন্ম আসামের শিলংয়ে। পুরো নাম চিত্ত রঞ্জন দত্ত। তার পৈতৃক বাড়ি হবিগঞ্জের চুনারুঘাট উপজেলার মিরাশি গ্রামে। তার বাবার নাম উপেন্দ্র চন্দ্র দত্ত এবং মায়ের নাম লাবণ্য প্রভা দত্ত। মেজর জেনারেল সি আর দত্তের মৃত্যু বার্ষিকী আজ (২৫ আগস্ট)। মৃত্যু কালে তার বয়স হয়েছিলো ৯৩ বছর।
 
সি আর দত্ত বাংলা মায়ের এক বীর সন্তানের নাম, সাহসী দেশপ্রেমিকের নাম। ছোট বেলা থেকেই অত্যন্ত সাহসী ও দুরন্ত ছিলেন তিনি। অন্যায় আর অবিচারের বিরূদ্ধে প্রতিবাদে জেগে উঠার নাম। কিন্তু এই নামটি এই প্রজন্মের অনেকের কাছেই অজানা, তবে সি আর দত্ত বীর উত্তম সেই নামটির সঙ্গে আমাদের পরিচয় যারা মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে ধারণ করি, বহন করি কিংবা ইতিহাসকে জানতে চাই তাদের কাছে শিশুকাল থেকেই। তার মতো এমন একজন সাহসী বীরের সাফল্যগাঁথা সংগ্রামী জীবনী হতে পারে আগামী প্রজন্মের দেশপ্রেমের, অনুপ্রেরণার উৎস।
 
বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের সভাপতি ছিলেন সি আর দত্ত। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ৪ নং সেক্টরের সেক্টর কমান্ডারের দায়িত্ব পালন করেছেন। মুক্তিযুদ্ধে অবদানের জন্য ‘বীর উত্তম’ খেতাবে ভূষিত হয়েছেন। একজন খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা। সেক্টর কমান্ডার্স ফোরামের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। ১৯৭২ খ্রিষ্টাব্দের সংবিধানে বিশ্বাসী। অসাম্প্রদায়িক চেতনায় বিশ্বাসী একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা। 
 
১৯৭৪ খ্রিষ্টাব্দের হেড কোয়ার্টার চিফ অব লজিস্টিক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন৷ ১৯৭৭ খ্রিষ্টাব্দে মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্টের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করেন৷ ১৯৭৯ খ্রিষ্টাব্দে বিআরটিসির চেয়ারম্যান হন। ১৯৮২ খ্রিষ্টাব্দে পুনরায় মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্টের চেয়ারম্যান হন৷ ১৯৮৪-এ এরশাদ সরকারের আমলে মেজর জেনারেল পদে থাকা অবস্থায় বাধ্যতামুলক অবসর দেয়া হয়।
 
১৯৮৮ খ্রিষ্টাব্দে বাংলাদেশের ৮ম সংশোধনীর প্রতিবাদ করলে তৎকালীন স্বৈরাচার প্রেসিডেন্ট এরশাদের লোকজন সি আর দত্তের গাড়িতে বোমা বিস্ফোরণ ঘটালে গুরুতর আহত হন। বিদেশে চিকিৎসার করার পর সুস্থ হয়ে উঠেন। 
 
১৯৮৮ খ্রিষ্টাব্দে প্রতিষ্টা করেন বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খৃষ্টান ঐক্য পরিষদ। যার লক্ষ্য ছিলো মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় ১৯৭২-এর সংবিধান বাস্তবায়ন করা। তিনি ছিলেন সংগঠনের আজীবন সভাপতি। সি আর দত্ত ছিলেন একজন মানবিক মানুষ। যিনি তার জীবন উৎসর্গ করে নিরলসভাবে আন্দোলন করে গেছেন দেশের স্বাধীনতা ও হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিষ্টান ধর্মাবলম্বীদের অধিকার রক্ষার জন্য। কোনো সরকারের  কাছেই  তিনি মাথা নত করেননি। কোনো পদ-পদবীর লোভ লালসা তাকে আর্কষণ করতে পারেনি। সবর্দা সততার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করেছেন। যখন যেখানে তাকে যে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে সততা, আন্তরিকতা , সাহসিকতা ও দেশপ্রেমের সঙ্গে দায়িত্ব পালন করেছেন তিনি। [inside-a]
 
বাংলাদেশের ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ‌্যালঘুদের অধিকার প্রতিষ্ঠা করে সমঅধিকার ও সমমর্যাদার আন্দোলনের অন‌্যতম সূচনাকারী সি আর দত্ত । সিআর দত্তের আন্দোলনের জন্যই সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের কিছু দাবি আদায় করা সম্ভব হয়েছে। তার আদর্শকে লালিত করে ঐক্যবদ্ধভাবে আন্দোলনের মাধ্যমে গ্রাম থেকে রাজধানী পযর্ন্ত সবাইকে সম্পৃক্ত করেই আমাদের অধিকার আমরা আদায় করবো এই হউক আমাদের অংগীকার। নিজেদের পদ-পদবীর লোভের ঊর্ধ্বে উঠে আমাদেরকে কাজ করতে হবে তাহলেই সিআর দত্তের আত্বা শান্তি পাবে। আজীবন মানুষকে ভালোবাসতেন ও শ্রদ্ধা করতেন বলেই তার প্রতি ও ছিলো সবার অতল শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা। মহান মুক্তিযুদ্ধে তার অনন্য অবদান দেশ ও জাতি চিরদিন কৃতজ্ঞ চিত্তে স্মরণ করবে।
 
১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দে মুক্তিযুদ্ধের সেই দিনগুলোতে সংখ্যালঘুরা বিশেষ করে হিন্দুরা পাক সেনা আর তাদের দোষরদের কাছে ছিলো গনিমতের মাল। সেই দিনগুলোতে যেখানে দেশে থাকাই কষ্টদায়ক হয়ে গিয়েছিলো, যেখানে প্রাণ বাঁচাতে সংখ্যালঘু অনেকেই পার্শ্ববর্তী ভারতে আশ্রয় নিয়েছিলেন। সেখানে সি আর দত্ত নিঃসন্দেহে একটি বীরত্বের পরিচয় দিয়েছেন। সংখ্যালঘুদের  উদ্বুদ্ধ করেছিলেন মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের জন্য।
 
একাত্তরের পরাজিত শক্তির সংখ্যালঘু হ্রাসকরণ প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে দেশে একটি গণতন্ত্র ও সার্বভৌমত্বের সংকট তৈরি করার প্রক্রিয়া দীর্ঘদিনের। তাদের ভাবনা যদি সংখ্যালঘুদের তাড়িয়ে দেয়া যায় তাহলে বাংলাদেশকে সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র করাও সহজতর হবে। সেই দৃষ্টিতে সি আর দত্তের তৎকালীন সিদ্ধান্ত ও অবদান নিঃসন্দেহে সাহসী ছিল। তিনি নিজে শুধু মুক্তিযুদ্ধে অবদানই রাখেননি বরং তার সাহসিকতা ও দেশপ্রেম দেখে সংখ্যালঘুরা মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়তে অনুপ্রেরণা পেয়েছিলেন। 
 
ঢাকার কাঁটাবন থেকে কারওয়ান বাজার সিগন্যাল পর্যন্ত সড়কটি ‘বীরউত্তম সি আর দত্ত’ সড়ক নামে নামকরণ করা হয়। ব্যক্তি জীবনে তার চাওয়া-পাওয়ার কোনো অপূর্ণতা নেই। কিন্তু একটা বড় ধরনের কষ্ট নিয়ে মারা গেছেন সি আর দত্ত। দেশ জাতির কল্যাণে আজীবন নিবেদিত তিনি সব সময় লড়াই করেছেন অসাম্য নীপিড়নের বিরুদ্ধে। এখানেই তার যতো কষ্ট ও অভিমান। তিনি আক্ষেপ করে বলতেন, মুক্তিযুদ্ধ করে দেশ স্বাধীন করেছি। কখনো ভাবিনি আমাকে এই দেশের সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর অধিকার ও নিরাপত্তার জন্য লড়াই করতে হবে। 
 
কোনো চিন্তাশীল ও বিশিষ্ট নাগরিক এর প্রতি শ্রদ্ধা জানানোর উপায় হচ্ছে তার চেতনাকে লালন করা ও বাস্তবায়ন করা। সম্প্রীতির এই বাংলাদেশ সকল ধর্মের মানুষের সমান অধিকারে বিশ্বাসী। তারপরও কিছু বিচ্ছিন্ন ঘটনা নানান ভাবনার জন্ম দেয়। সাম্প্রদায়িক অপগোষ্ঠীর সকল অপতৎপরতার বিরুদ্ধে আমাদের সোচ্চার থাকতে হবে। সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের অধিকার সুরক্ষায় বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার সকল ইতিবাচক পদক্ষেপে বীর মুক্তিযোদ্ধা প্রয়াত সি আর দত্ত বীর উত্তম এর অতৃপ্ত বাসনা ও স্বপ্ন পূরণ হবে এই বিশ্বাস আমাদের সকলের। তৃতীয় প্রয়াণ দিবসে অতল শ্রদ্ধা তার স্মৃতির প্রতি।
 
লেখক : রিপন চন্দ্র ভৌমিক, অ্যাডভোকেট, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট

 

 

 

শিক্ষা কর্মকর্তার বিরুদ্ধে মাকে নির্যাতনের অভিযোগ - dainik shiksha শিক্ষা কর্মকর্তার বিরুদ্ধে মাকে নির্যাতনের অভিযোগ শিক্ষার্থী বিক্ষোভের মধ্যে ইহুদিবিদ্বেষ নিয়ে বিল পাস - dainik shiksha শিক্ষার্থী বিক্ষোভের মধ্যে ইহুদিবিদ্বেষ নিয়ে বিল পাস সপ্তদশ জুডিশিয়াল সার্ভিস পরীক্ষা কাল - dainik shiksha সপ্তদশ জুডিশিয়াল সার্ভিস পরীক্ষা কাল দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে রোববার থেকে প্রাথমিক বিদ্যালয় খোলা - dainik shiksha রোববার থেকে প্রাথমিক বিদ্যালয় খোলা শনিবার থেকে মাধ্যমিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলা - dainik shiksha শনিবার থেকে মাধ্যমিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলা please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0095529556274414