সিদ্ধান্ত অনুযায়ী স্বাস্থ্যবিধি মেনে স্কুল খোলা নিয়ে কিছু কথা - দৈনিকশিক্ষা

সিদ্ধান্ত অনুযায়ী স্বাস্থ্যবিধি মেনে স্কুল খোলা নিয়ে কিছু কথা

রবীন্দ্রনাথ রায় |

গত বছরের শেষে চীনে প্রথম করোনা রোগী শনাক্ত হয়। এর পর ধীরে ধীরে সারা বিশ্বে ছড়িয়ে যায়। গত ৮ মার্চ বাংলাদেশে প্রথম করোনা রোগী শনাক্ত হয়। করোনার প্রাদুর্ভাব কমাতে সরকার ২৬ মার্চ থেকে দেশে সাধারণ ছুটি ঘোষণা করে। তার আগে ১৮ মার্চ থেকে দেশের সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সাধারণ ছুটি ঘোষণা করা হয়। এখন পর্যন্ত বন্ধ রয়েছে সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। এতে স্বভাবতই শিক্ষা ব্যবস্থার ওপর প্রভাব পড়েছে। প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী ও ইবতেদায়ি শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষা চলতি বছরের জন্য স্থগিত ঘোষণা করা হয়েছে। করোনা পরবর্তীতে সিলেবাস ঠিক রেখে মানসম্মত শিক্ষা দেয়াটাও একটা চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখা দিবে। শিক্ষা কার্যক্রম অব্যাহত রাখতে সংসদ বিটিভি, বাংলাদেশ বেতার ও দেশের সব কমিউনিটি রেডিওর মাধ্যমে প্রাথমিকের পাঠদান কার্যক্রম চলমান রয়েছে। ইতোমধ্যে জুম ও গুগল মিটের মাধ্যমে অনলাইন ক্লাসও শুরু হয়েছে। কিন্তু তাতে শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণ সন্তোষজনক নয়। 

কোনো কোনো দেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলার পরে নতুন করে করোনা সংক্রমণের হার উদ্বেগজনকভাবে বেড়ে যাওয়ায় আবার বন্ধ করে দিতে বাধ্য হয়েছে। বর্তমানে বাংলাদেশে করোনা সংক্রমণের হার ক্রমাগত কমে আসছে কিন্তু শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলার সিদ্ধান্ত এখনও গ্রহণ করা হয়নি। তবে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকার ফলে শ্রেণিশিক্ষা কার্যক্রমে ব্যাঘাতসহ শিশুর শিখন যোগ্যতার ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। বিশেষ করে প্রান্তিক শিক্ষার্থীরা যত বেশি সময় বিদ্যালয়ের বাইরে থাকবে, তাদের বিদ্যালয়ে ফেরার সম্ভাবনা ততই কমে যাবে। প্রাথমিক শিক্ষাস্তরে স্বচ্ছল পরিবারের শিশুদের তুলনায় অস্বচ্ছল পরিবারের শিশুদের ঝরে পড়ার হার প্রায় ৫ গুণ বেশি। বিদ্যালয় থেকে ঝরে পড়া শিশুদের মাঝে বাল্যবিবাহ, অপ্রাপ্ত বয়সে মাতৃত্ব, যৌন নির্যাতন ও সহিংসতার শিকার হওয়া এবং অন্যান্য ঝুঁকির আশঙ্কা বৃদ্ধি পায়। এছাড়া, দীর্ঘদিন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় বিদ্যালয়কেন্দ্রিক সেবা কার্যাবলী, যেমন: টিকাদান কর্মসূচি, একবেলা খাদ্য প্রদান কর্মসূচি এবং শিশুদের মানসিক স্বাস্থ্য ও মনোসামাজিক সহায়তা প্রদান বাধাগ্রস্ত হতে পারে। একই সাথে ব্যাহত রুটিন ব্যবস্থা ও সমবয়সীদের মধ্যে মিথস্ক্রিয়ার অভাবে শিশুদের মধ্যে মানসিক চাপ ও উদ্বিগ্নতা বাড়তে পারে। প্রান্তিক শিশু যেমন ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী, প্রতিবন্ধী ও এতিম শিশুদের ওপর এ ধরনের নেতিবাচক পরিস্থিতির প্রভাব উল্লেখযোগ্যভাবে বেশি হয়। 

শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলার কোনো সিদ্ধান্ত এখন পর্যন্ত গ্রহণ করা হয়নি। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়  WHO, UNESCO, UNICEF, World Bank, CDC (USA) এর গাইডলাইন অনুসরণ করে একটি নির্দেশিকা প্রণয়ন করেছে। তবে স্থানীয় বাস্তবতার সাথে সামঞ্জস্য বিধান করতে এবং প্রতিটি শিশুর শিখন, স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তার চাহিদা পূরণ করতে এই নির্দেশিকাটি ক্রমাগত অভিযোজন ও প্রাসঙ্গিকীকরণ করা প্রয়োজন হবে। বিদ্যালয় পুনরায় চালু করার সিদ্ধান্ত নেয়া হলে নিরাপদ এলাকা ও পরিস্থিতি বিবেচনায় এলাকাভিত্তিক বিদ্যালয় চালু করা যেতে পারে। করোনা সংক্রমণ বিবেচনায় কোনো এলাকাকে সরকার কর্তৃক রেড জোন ঘোষণা করা হলে সে এলাকায় বিদ্যালয় খোলা রাখা যাবে না। 

নির্দেশিকা অনুসারে বিদ্যালয় অভ্যন্তরীণ অবকাঠামোগত পরিবেশ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখা ও জীবাণুমুক্তকরণ, শারীরিক দূরত্ব বজায় রাখা, হাত ধোয়া, হাঁচি-কাশি বিষয়ক শিষ্টাচার, সুরক্ষা সরঞ্জামের ব্যবহার, অসুস্থদের জন্য করণীয় এবং নিরাপদ খাদ্যদ্রব্য প্রস্তুতকরণের অভ্যাস গড়ে তুলতে হবে। এ বিষয়ে শিক্ষক, শিক্ষার্থী কর্মচারী ও অভিভাবকের জন্য তথ্য ও নির্দেশনা সংবলিত পোস্টার বা লিফলেট প্রস্তুত ও বিতরণ করতে হবে। এ সকল নির্দেশনা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ও গণমাধ্যমে প্রচার করা হবে। উদ্বুদ্ধকরণের মাধ্যমে শিশুদেরকে স্কুলে আনার জন্য বিশেষ উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। বিভিন্ন ধর্মীয় উপাসনালয়ের মাধ্যমে শিক্ষা ও স্বাস্থ্য সচেতনতামূলক কার্যক্রম গ্রহণ করা যেতে পারে।

শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও কর্মচারীদের সার্বক্ষণিক হাত ধোয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করার জন্য পর্যাপ্ত নিরাপদ পানি সরবরাহের ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। হাত ধোয়ার সময় যাতে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের জটলা তৈরি না হয় সেভাবে প্রতিটি বিদ্যালয়ভিত্তিক পানির টেপের অবস্থান ও সংখ্যা নির্ধারণ করতে হবে। এছাড়া যেখানে সম্ভব হবে সে সব জায়গায় পর্যাপ্ত পানির ব্যবস্থা করতে হবে এবং ছেলে ও মেয়েদের জন্য পৃথক শৌচাগার স্থাপন বা সম্প্রসারণ করতে হবে। মেয়ে শিক্ষার্থীদের ঋতুকালীন সময়ে স্বাস্থ্য সুরক্ষার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা রাখতে হবে। 

বিদ্যালয় খোলার আগেই অবশ্যই বিদ্যালয় প্রাঙ্গণসহ শ্রেণিকক্ষ ও টয়লেটগুলো স্বাস্থ্যসম্মত ও জীবাণুমুক্ত করতে হবে। বিদ্যালয়ের অফিস কক্ষ, শ্রেণিকক্ষ, সর্বসাধারণ কর্তৃক ব্যবহৃত হয় এমন জায়গাসহ অন্যান্য জায়গার মেঝে ও ঘরের দরজার হাতল, সিঁড়ির হাতল, বেঞ্চ এবং যেসব বস্তু বারবার ব্যবহৃত হয় সেসব বস্তুর তল বা পৃষ্ঠ পরিষ্কার ও জীবাণুমুক্ত করতে হবে। বিদ্যালয় চলাকালীন প্রতি শিফটে অন্ততঃ একবার পরিষ্কার ও জীবাণুমুক্ত করতে হবে। প্রতিদিন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান চত্বরের আবর্জনা পরিষ্কার এবং আবর্জনা সংরক্ষণকারী পাত্র জীবাণুমুক্ত করতে হবে। প্রতিবার টয়লেট ব্যবহারের পরে অবশ্যই সাবান দ্বারা হাত জীবাণুমুক্ত করতে হবে। এ বিষয়ে শিক্ষক-শিক্ষার্থী ও পরিচ্ছন্নতাকর্মীকে যথাযথ প্রশিক্ষণ প্রদান ও সচেতন করতে হবে। অসুস্থ শিক্ষক-শিক্ষার্থী বা কর্মচারী এবং সন্তানসম্ভবা শিক্ষিকাদের বিদ্যালয়ে উপস্থিতি থেকে বিরত রাখতে হবে। অসুস্থ সন্তানকে বিদ্যালয়ে না পাঠানোর জন্য অভিভাবকদের অনুরোধ করতে হবে। অসুস্থতাজনিত অনুপস্থিতির কারণে সংশ্লিষ্ট শিক্ষার্থী যেন শ্রেণি মূল্যায়নে ক্ষতিগ্রস্ত না হয় সে বিষয়ে বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন। শিক্ষক, কর্মচারী এবং শিক্ষার্থীদের বাধ্যতামূলকভাবে মাস্ক ব্যবহার করতে হবে। হাত ধোয়সহ অন্যসব স্বাস্থ্যবিধি আবশ্যিকভাবে প্রতিপালন করতে হবে। হাঁচি বা কাশি দেয়ার সময় মুখ এবং নাক ঢাকতে টিস্যু বা কনুই ব্যবহার করতে হবে। যাদের পক্ষে সম্ভব তারা যেন সহজভাবে কাপড়ের মাস্ক (৩ লেয়ার কাপড়ের) বানাতে পারেন তার সচিত্র বিবরণ দেয়া যেতে পারে। স্বাস্থ্যবিধি সম্পর্কিত তথ্যাদি ক্ষুদ্র-নৃতাত্বিক জনগোষ্ঠীর ভাষায় এবং ব্রেইলের মাধ্যমে সহজলভ্য করে তুলতে হবে এবং অবশ্যই ব্যবহৃত ভাষা শিশুবান্ধব হতে হবে। প্রয়োজনবোধে এ সকল বিষয়ে ছোটো ছোটো তথ্যচিত্র নির্মাণ করে প্রচার করা যেতে পারে। বিদ্যালয় কার্যক্রমের শুরু, সমাপ্তি ও মিড-ডে-মিলের সময়সূচি এমনভাবে সাজিয়ে নিতে হবে যাতে শিক্ষার্থী এবং অভিভাবকদের জটলা তৈরি না হয়। বিদ্যালয়ের অবকাঠামো এবং শিক্ষার্থীর সংখ্যা বিবেচনা করে একাধিক শিফট কিংবা সপ্তাহের একেক দিন একেক শ্রেণির বা একাধিক শ্রেণির পাঠদানের ব্যবস্থা রেখে বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ স্থানীয়ভাবে পরিকল্পনা প্রণয়ন করবেন যাতে শারীরিক দূরত্ব নিশ্চিত করা যায়।

শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রবেশ পথে শারীরিক দূরত্ব বজায় রেখে শিক্ষক, কর্মচারী, শিক্ষার্থী এবং বহিরাগতদের শরীরের তাপমাত্রা পরিমাপ করতে হবে। দৃশ্যমান একাধিক স্থানে ছবিসহ স্বাস্থ্য সুরক্ষা নির্দেশনা ঝুলিয়ে রাখতে হবে। হোস্টেলে থাকাকালীন শিক্ষার্থীরা শারীরিক দূরত্ব বজায় রাখতে যথাযথ পরামর্শ প্রদান করতে হবে। খাদ্য গ্রহণের সময়ও দূরত্ব বজায় রাখতে হবে। কমপক্ষে ১ মিটার শারীরিক দূরত্ব বজায় রেখে খাবার গ্রহণ এবং সম্পূর্ণ নিজস্ব থালা বাসন বা ওয়ান টাইম থালাবাসন ও পানির পাত্র ব্যবহার করতে হবে। থালাবাসন এবং পানির পাত্র পরিষ্কার ও জীবাণুমুক্ত করতে হবে। প্রতিবার পরিবেশনের পরে পুনরায় ব্যবহারযোগ্য থালাবাসন ও পানির পাত্র জীবাণুমুক্ত করতে হবে। স্বাভাবিক অবস্থা না আসা পর্যন্ত কোনো প্রকার অভ্যন্তরীণ জমায়েত আয়োজন করা যাবে না। করোনাকালীন লম্বা বেঞ্চে ২ জন করে শিক্ষার্থী বসবে। বিদ্যালয়ের বাইরেও যেন শিক্ষার্থী ও তাদের অভিভাবকরা এ সকল স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলে সে বিষয়ে সংশ্লিষ্ট সকলকে সচেতন করতে হবে। বিদ্যালয় চলাকালীন শিক্ষক, কর্মচারী এবং শিক্ষার্থীদের বহির্গমন কমিয়ে দিতে হবে। অত্যাবশ্যক না হলে কেউ বাইরে যাবে না। 

শিশুদের মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর গুরুত্ব দিতে হবে। কোয়ারেন্টিনে অবস্থানরত শিক্ষক-কর্মচারী বা শিক্ষার্থীদের পিতামাতার স্বাস্থ্যের অবস্থা জানা এবং তাদের সাথে সবসময় যোগাযোগ রাখতে হবে। শিক্ষার্থী ও কর্মচারীদের স্বাস্থ্য মনিটর করা, স্থানীয় প্রশাসন ও স্বাস্থ্য কর্তৃপক্ষের সাথে নিয়মিত যোগাযোগ রাখতে হবে। জরুরি প্রয়োজনে যাদের সাহায্য দরকার হবে তাদের নাম এবং মোবাইল নম্বর তালিকা করে সংরক্ষণ করতে হবে। কোনোরূপ আতঙ্ক বা লোকলজ্জা সৃষ্টি না করে অসুস্থ শিক্ষার্থী-কর্মচারীদেরকে সাময়িকভাবে আলাদা রাখার ব্যবস্থা করতে হবে। অসুস্থ শিক্ষার্থী-কর্মচারীদেরকে নিজ গৃহে অবস্থান করাসহ স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার জন্য পরামর্শ প্রদান করতে হবে।

লেখক : রবীন্দ্রনাথ রায়, জনসংযোগ কর্মকর্তা, প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়।

ছুটি না বাড়ালে বাড়ি যেতে হতে পারে ঈদের দিন - dainik shiksha ছুটি না বাড়ালে বাড়ি যেতে হতে পারে ঈদের দিন হাইস্কুলে কমেছে দশ লাখের বেশি শিক্ষার্থী - dainik shiksha হাইস্কুলে কমেছে দশ লাখের বেশি শিক্ষার্থী জালিয়াতি করে পদোন্নতি শিক্ষা ক্যাডার গ্যাঁড়াকলে - dainik shiksha জালিয়াতি করে পদোন্নতি শিক্ষা ক্যাডার গ্যাঁড়াকলে রুয়েটের সাবেক উপাচার্য-রেজিস্ট্রারের বিরুদ্ধে মামলা - dainik shiksha রুয়েটের সাবেক উপাচার্য-রেজিস্ট্রারের বিরুদ্ধে মামলা উপবৃত্তির জন্য সংখ্যালঘু কোটার তথ্য চেয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয় - dainik shiksha উপবৃত্তির জন্য সংখ্যালঘু কোটার তথ্য চেয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয় প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগে সতর্কীকরণ বিজ্ঞপ্তি - dainik shiksha প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগে সতর্কীকরণ বিজ্ঞপ্তি উপবৃত্তির জন্য সংখ্যালঘু কোটার তথ্য চেয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয় - dainik shiksha উপবৃত্তির জন্য সংখ্যালঘু কোটার তথ্য চেয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয় হাইস্কুলে কমেছে দশ লাখের বেশি শিক্ষার্থী - dainik shiksha হাইস্কুলে কমেছে দশ লাখের বেশি শিক্ষার্থী please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0044219493865967