সুফিয়া কামাল : ‘হে পূর্ণ তব চরণের কাছে’ - দৈনিকশিক্ষা

প্রয়াণদিনে শ্রদ্ধাঞ্জলিসুফিয়া কামাল : ‘হে পূর্ণ তব চরণের কাছে’

আবদুল্লাহ আল মোহন |

১.

দেশের নারী আন্দোলনের পুরোধা ব্যক্তিত্ব বেগম সুফিয়া কামাল। রাজনৈতিক কর্মীর চেয়েও কবি হিসেবে তিনি সমধিক পরিচিত। কিন্তু সেই পরিচয়কে ছাপিয়ে উঠেছে দেশ ও সমাজের সার্বিক কল্যাণ-অভিমুখী তার যাবতীয় কর্মকাণ্ড।  এমন যে মহীয়সী নারী, তাঁর সংগ্রামী জীবনের কেন্দ্রে ছিল নারীমুক্তির বিষয়টি। ব্যক্তিগত সংগ্রাম থেকে নারী আন্দোলন এবং তা থেকে বৃহত্তর জাতীয় আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়তে পিছপা হননি কখনোই। প্রয়াণ দিনে ‘অদম্য’ সুফিয়া কামাল, সকলের প্রিয় খালাম্মার অমর স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে ‘চরণরেখা তব’ স্মরণে তাঁর চরণ ছুঁয়ে সংক্ষিপ্ত পরিসরে জীবন-কর্মতে দৃষ্টিপাতে সচেষ্ট থাকবো।


২.
কবি সুফিয়া কামাল রক্ষণশীল পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। এ সময় মেয়েদের ব্যক্তিস্বাধীনতা, চলাচল, শিক্ষাগ্রহণ এবং সাংস্কৃতিক চর্চা ছিল বেশ কঠিন। এমন এক প্রতিকূল সময়ে কবি সুফিয়া কামাল স্বশিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে আত্মমর্যাদাসম্পন্ন, স্বাধীনচেতা এবং অসাম্প্রদায়িক মানুষ হয়ে ওঠেন। সুফিয়া কামাল তেমন কোনো প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা লাভ করেননি। তখনকার পারিবারিক ও সামাজিক প্রতিকূল পরিবেশে বাস করেও তিনি নিজ চেষ্টায় হয়ে ওঠেন স্বশিক্ষিত ও সুশিক্ষিত। খুব বেশি প্রাতিষ্ঠানিক লেখাপড়া না করেও তিনি ছিলেন উদার ও গণতন্ত্রমনস্ক। সেই চেতনা বুকে ধারণ করে আজন্ম তিনি সমাজসেবা ও বিভিন্ন সামাজিক সংগঠনের সঙ্গে সক্রিয়ভাবে যুক্ত ছিলেন।
৩.
জন্মেছিলেন ১৯১১ খ্রিষ্টাব্দের ২০ জুন বরিশালের শায়েস্তাবাদে মামার বাড়িতে। তাঁর বাবা সৈয়দ আবদুল বারি পেশায় উকিল এবং মা সৈয়দা সাবেরা খাতুন ছিলেন গৃহিণী। যখন সাত বছর বয়স, তখন তাঁর বাবা গৃহত্যাগ করেন। নিরুদ্দেশ বাবার অনুপস্থিতিতে তিনি নানাবাড়িতে মায়ের স্নেহ-পরিচর্যায় লালিত-পালিত হতে থাকেন। ১৯২৩ খ্রিষ্টাব্দে মামাতো ভাই সৈয়দ নেহাল হোসেনের সঙ্গে তাঁর বিয়ে হয়। বিয়ের পর তিনি ‘সুফিয়া এন হোসেন’ নামে পরিচিত হন। স্বামীর সঙ্গে কলকাতায় গেলে সেখানে বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের সঙ্গে দেখা হয়। সুফিয়া কামালের কবিতা পড়ে মুগ্ধ হন নজরুল ইসলাম এবং সেগুলো পত্রিকায় প্রকাশের জন্য তাঁকে উদ্বুদ্ধ করেন। ১৯২৬ খ্রিষ্টাব্দে তাঁর প্রথম কবিতা ‘বাসন্তী’ প্রকাশ পায় সেই সময়ের প্রভাবশালী সাময়িকী সওগাতে। ১৯৩২ খ্রিষ্টাব্দে তার স্বামী মারা যান। এরপর তিনি কলকাতা করপোরেশন প্রাইমারি স্কুলে শিক্ষকতা শুরু করেন। শিক্ষকতার পাশাপাশি তাঁর সাহিত্যচর্চাও চলতে থাকে। ১৯৩৮ খ্রিষ্টাব্দে প্রকাশিত হয় তাঁর ‘সাঁঝের মায়া’ কাব্যগ্রন্থটি। এই কাব্যগ্রন্থের ভূমিকা লিখেছিলেন কাজী নজরুল ইসলাম। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এটি পড়ে উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করেন। এর মাধ্যমেই সুফিয়ার কবিখ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে। ১৯৩৯ খ্রিষ্টাব্দে তিনি চট্টগ্রামের লেখক ও অনুবাদক কামালউদ্দীন আহমদের সঙ্গে পুনরায় পরিণয়সূত্রে আবদ্ধ হন। সেই থেকে তিনি ‘সুফিয়া কামাল’ নামে পরিচিত হন। 

৪.
কলকাতায় বেগম রোকেয়ার নারীবাদী দর্শনের সঙ্গে তাঁর সংশ্রব ঘটে। বেগম রোকেয়ার সামাজিক আদর্শ তাকে আজীবন প্রভাবিত করে বলেই নানা ধরনের আন্দোলনের মধ্য দিয়ে নারী মুক্তির আন্দোলন অগ্রসর হতে থাকেন। তিনি নারী মুক্তির আন্দোলন, রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক আন্দোলন এবং গণতান্ত্রিক আন্দোলনসহ বিভিন্ন সৃষ্টিশীল উদ্যোগের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। নারীর মুক্তিকে মানবমুক্তি হিসেবে দেখার যে মন্ত্র বেগম রোকেয়া ছড়িয়েছিলেন, সেই মন্ত্রে এবং কাজে দীক্ষিত ছিলেন বেগম সুফিয়া কামাল। তাঁকে কেন্দ্র করেই রোকেয়া-পরবর্তী বাংলাদেশের নারী আন্দোলন অগ্রসর হতে থাকে। তিনি রোকেয়ার ওপর অনেক কবিতা রচনা করেন এবং তাঁর নামে ‘মৃত্তিকার ঘ্রাণ’ (১৯৭০) শীর্ষক একটি সংকলন উৎসর্গ করেন। 
৫.
১৯৩৮ খ্রিষ্টাব্দে প্রকাশিত হয় তাঁর ‘সাঁঝের মায়া’ কাব্যগ্রন্থ। ‘কেয়ার কাঁটা’, ‘মায়া কাজল’, ‘মন ও জীবন’, ‘উত্তপ্ত পৃথিবী’, ‘অভিযাত্রিক’ ইত্যাদি তাঁর বিখ্যাত বই। এ ছাড়া তিনি ‘সোভিয়েতের দিনগুলি’ নামে একটি ভ্রমণকাহিনি, ‘একালে আমাদের কাল’ নামে আত্মজীবনী এবং ‘একাত্তরের ডায়েরী’ নামে স্মৃতিকথা লেখেন। সাহিত্যচর্চার জন্য সুফিয়া কামাল ১৯৬১ খ্রিষ্টাব্দে ‘তঘমা-ই-ইমতিয়াজ’ পুরস্কার পেয়েছিলেন। কিন্তু ১৯৬৯ খ্রিষ্টাব্দে বাঙালিদের ওপর অত্যাচারের প্রতিবাদে তিনি তা বর্জন করেন। 
৬.
১৯৪৬ খ্রিষ্টাব্দে কলকাতায় যখন হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গা বাধে, তখন দাঙ্গাপীড়িতদের সাহায্যের ক্ষেত্রে সুফিয়া কামাল সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন। ১৯৫২ খ্রিষ্টাব্দের ভাষা আন্দোলনে তিনি সরাসরি অংশ নেন। পাকিস্তান সরকার বাংলা ভাষা ও বাঙালি সংস্কৃতির ওপর দমননীতির অংশ হিসেবে রবীন্দ্রনাথকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করলে তিনি এই অন্যায়ের বিরুদ্ধেও তীব্র প্রতিবাদ জানান। ১৯৬১ খ্রিষ্টাব্দে রবীন্দ্রনাথের জন্মশতবর্ষে তিনি ‘সাংস্কৃতিক স্বাধিকার আন্দোলন’ পরিচালনা করেন। ১৯৬৯ খ্রিষ্টাব্দে ‘মহিলা সংগ্রাম পরিষদ’ গঠিত হলে তিনি এর প্রতিষ্ঠাতা প্রধান নির্বাচিত হন। আজীবন তিনি প্রতিষ্ঠানটির সঙ্গে জড়িত ছিলেন। মহিলা সংগ্রাম পরিষদ এখন ‘বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ’ নামে সুপরিচিত। 
৭.
জননী সাহসিকা কবি সুফিয়া কামাল বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় ছিলেন মহিলা পরিষদের সভানেত্রী। ১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দের মার্চে অসহযোগ আন্দোলনে নারীদের মিছিলে নেতৃত্ব দেন। রাজপথে-জনপদে হেঁটে নারীমুক্তির মশাল প্রজ্বালনের পাশাপাশি দেশমাতৃকার মুক্তির গানও গেয়েছেন নির্ভীক কণ্ঠে। একাত্তরের মার্চ মাসের অসহযোগ আন্দোলনে ঢাকায় নারী সমাবেশ ও মিছিলে নেতৃত্ব দিয়ে, ধানমন্ডির নিজ বাড়িতে অবস্থান করে মুক্তিযোদ্ধাদের সাহায্য-সহযোগিতা করে, পাকিস্তানের পক্ষে স্বাক্ষর দান প্রস্তাবের বিরোধিতা করে তিনি তাঁর মুক্তিসংগ্রামী–সত্তার প্রকাশ ঘটিয়েছেন। ১৯৯০ খ্রিষ্টাব্দে স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে শরিক হন, কারফিউ উপেক্ষা করে নীরব শোভাযাত্রা বের করেন।
৮.
১৯৯৯ খ্রিষ্টাব্দের ২০ নভেম্বর ঢাকায় তিনি মৃত্যুবরণ করলে তাঁকে পূর্ণ রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় সমাহিত করা হয়। বাংলাদেশি নারীদের মধ্যে তিনিই প্রথম এই সম্মান লাভ করেন। এ ছাড়া ২০১৯ খ্রিষ্টাব্দের ২০ জুন তার ১০৮তম জন্মদিন উপলক্ষে গুগল ডুডল তৈরি করে সম্মাননা প্রদান করে।
৯.
সবশেষে রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে প্রতিবছর কবির জন্ম ও প্রয়াণদিন পালনের মাধ্যমে তাঁর জীবন-কর্মের আলেখ্য তরুণ প্রজন্মসহ সবার মাঝে ছড়িয়ে দেওয়ার প্রয়াস অব্যাহত রাখার দাবি জানাচ্ছি। নারী জাগরণের অগ্রদূত সুফিয়া কামালের দৃষ্টান্ত স্থানীয় জীবনকে তুলে ধরতে রবীন্দ্রবাণী দিয়ে শেষ করতে চাই-
‘হে পূর্ণ, তব চরণের কাছে   যাহা-কিছু সব আছে আছে আছে--
…  জীবনের মাঝে স্বরূপ তোমার রাখিবারে যদি পাই’

লেখক : সহকারী অধ্যাপক, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, ভাসানটেক সরকারী কলেজ, ঢাকা

প্রাথমিকের শিক্ষকদের ফের অনলাইনে বদলির সুযোগ - dainik shiksha প্রাথমিকের শিক্ষকদের ফের অনলাইনে বদলির সুযোগ তীব্র তাপপ্রবাহের ভেতরই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলছে রোববার - dainik shiksha তীব্র তাপপ্রবাহের ভেতরই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলছে রোববার দেশে তিন দিনের হিট অ্যালার্ট জারি - dainik shiksha দেশে তিন দিনের হিট অ্যালার্ট জারি নতুন শিক্ষাক্রম ও কিছু কথা - dainik shiksha নতুন শিক্ষাক্রম ও কিছু কথা কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে স্কুলে দুই শিফটের ক্লাস চালু রাখার সভা রোববার - dainik shiksha স্কুলে দুই শিফটের ক্লাস চালু রাখার সভা রোববার শিক্ষা কর্মকর্তার আইডি ভাড়া নিয়ে প্রধান শিক্ষকের বাণিজ্য - dainik shiksha শিক্ষা কর্মকর্তার আইডি ভাড়া নিয়ে প্রধান শিক্ষকের বাণিজ্য শিক্ষকদের অবসর সুবিধা সহজে পেতে কমিটি গঠন হচ্ছে - dainik shiksha শিক্ষকদের অবসর সুবিধা সহজে পেতে কমিটি গঠন হচ্ছে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে নিষিদ্ধ, মৌলবাদী সংগঠনের বিরুদ্ধে অবিলম্বে ব্যবস্থা নিন - dainik shiksha নিষিদ্ধ, মৌলবাদী সংগঠনের বিরুদ্ধে অবিলম্বে ব্যবস্থা নিন please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0035290718078613