স্কুল পর্যায়ে পরীক্ষা কমাতে হবে - দৈনিকশিক্ষা

স্কুল পর্যায়ে পরীক্ষা কমাতে হবে

আবু আহমেদ |

মিলন, মোহাম্মদ মিলন, বয়স হবে আট থেকে ১০ বছর। ছোট চাকরি করে সেলুনে, ক্ষুর-কাঁচি-তোয়ালে—এসব এগিয়ে দেয়।

গত এক বছর থেকে আছে এই চাকরিতে। আগে কিছুদিন স্কুলে গিয়েছিল, পরে স্কুল ছেড়ে এই চাকরিতে প্রবেশ করেছে। আমি সেলুনের সেবার খরিদ্দার হয়ে কাজ শেষ করার পর সোফায় বসে পত্রিকা পড়ছিলাম। আগে মিলনের প্রতি অতটা খেয়াল করতে পারিনি। দেখলাম একটা ছোট্ট শিশু অন্য গ্রাহকদের জন্যও ক্ষুর-কাঁচি-তোয়ালে এগিয়ে দিচ্ছে। একজন গ্রাহক তাকে রুটি আনতে বলল, সে সেটাও করল। তার পরনে মোটামুটি ড্রেস আছে। মনও ভালো মনে হলো।

ভাবলাম এই ছেলেটার তো এখন স্কুলে থাকার কথা। সে কেন এইখানে।
মিলনকে জিজ্ঞেস করলাম স্কুলে যাও না কেন? মিলন বলল, প্রাইভেট পড়ার ব্যবস্থা নেই। তাই স্কুলে যাই না। একসময় যেতাম, পরে আমার বাবাই এ কাজ বা অন্য কোনো কাজ করার জন্য আমাকে পাঠিয়েছে। আমি বললাম, স্কুলে তো এখন বিনা মূল্যে বই দেওয়া হয়। স্কুলে পড়তে কোনো ফি লাগে না। ছাত্রদের জন্য ফ্রি প্রাইমারি শিক্ষা। তার পরও তুমি বলছ অর্থের অভাবে তুমি স্কুলে থাকতে পারোনি। সে বলল, ওই সব ঠিকই আছে. তবে বাস্তব চিত্র ভিন্ন। খাতা-কাগজ-কলম এসব কিনতে হয়। প্রাইভেটে না পড়লে নম্বর মিলে না। কে দেবে আমাকে আমার স্কুল ড্রেস। সেই জন্য স্কুল ভালো লাগেনি। ঢাকা শহরে এসে সেলুনে হেলপারের কাজ নিয়েছি। মিলনকে জিজ্ঞেস করলাম ডিউটি কতক্ষণ এবং বেতন কেমন। মিলন বলল, ডিউটি সকাল ৯টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত। বেতনের কথাটা বলতে চাইল না।

ডিউটি ও বেতনের কথাটা বলতে তার মনে যেন কেমন একটা ভয় কাজ করছে। পাছে সেলুনের মালিক এসে পড়ে এবং আমার সঙ্গে তার কথাবার্তা শুনে ফেলে। হ্যাঁ, এর মধ্যে মালিকও এসে গেল। মিলন সব কথা বন্ধ করে দিল। যে চায়ের কাপটা চাসহ বাইরে থেকে নিয়ে এসেছিল, ওই কাপটা নিয়ে সে বাইরে চলে গেল। আমারও কাগজ পড়া শেষ। আমিও উঠে পড়লাম। উঠতে উঠতে ভাবলাম, হায়রে মিলন, তুমি হতে পারতে ভবিষ্যতের একজন বিখ্যাত লোক। আর আজকে তুমি সেলুনের বেয়ারা। ভাগ্যের কী পরিণতি। শুধু বাবার অর্থ নেই বলে স্কুল থেকে চলে এসে যেকোনো কাজে ঢোকা। প্রাইভেট কেন পড়তে হবে—এ কথা মিলনকে জিজ্ঞেস করে লাভ নেই। সে চোখের সামনে দেখছে অন্য প্রায় সব ছাত্র স্কুল ছুটির পর প্রাইভেট পড়ার দিকে ছুটছে। মিলন তাদের সঙ্গে যেতে পারে না। মনটা তার খারাপই লাগে। আরো খারাপ হয় যখন দেখে স্কুলের শিক্ষকও তাকে ভালো নজরে দেখেন না। ফ্রি প্রাইমারি শিক্ষা এখন আর ফ্রি নেই। এখন সেই শিক্ষায়ও বাণিজ্য প্রবেশ করেছে। প্রাইভেট পড়াটা যারা অর্থ দিয়ে কিনতে পারছে, তারাই কেবল ওই ফ্রি স্কুলের ছাত্র থাকতে পারছে। অন্যরা ওই স্কুল ত্যাগ করছে।

মিলন পড়েছে চতুর্থ শ্রেণি পর্যন্ত। তারপর সে স্কুল ড্রপ-আউট হয়ে গেছে। তার মতো অনেক মিলন আছে, যাদের পেছনে একই কাহিনি। স্কুল তাদের ধরে রাখতে পারেনি। স্কুলে পড়তে মাসে যে এক হাজার টাকা করে খাতা-কলম প্রাইভেটের পেছনে ব্যয় করতে হয়, তা তারা জোগান দিতে পারেনি। তাই তারা হয়ে পড়েছে স্কুল ড্রপ-আউটস। স্কুল ড্রপ-আউটসদের নিয়ে অনেকে অনেক গবেষণা করে। সরকার ফ্রি প্রাইমারিতে নাশতা খাওয়ানোর ব্যবস্থা করেছে। অবশ্য এটা শুনেছি। নিজে কখনো দেখিনি কী নাশতা খাওয়ানো হচ্ছে ছাত্র-ছাত্রীদের স্কুলে টানার জন্য। তবুও ভালো, এখন নাশতা আর নগদ সহায়তা দিয়ে স্কুল-এইজের সবাইকে স্কুলে নেওয়ার একটা চেষ্টা করা হচ্ছে। তবুও সবাই কি স্কুলে যাচ্ছে? মোটেই না। সবাই স্কুলে গেলে তো স্কুল টাইমে চায়ের দোকানে, মুদি দোকানে আট থেকে ১০ বছরের শিশুদের দেখতাম না শুধু খাওয়ার বদলে বেকার খাটতে। তারা কেন স্কুলে যাচ্ছে না এটা জিজ্ঞেস করার লোকও নেই। দোকানদার-গ্যারেজদার শিশুদের মধ্যে সস্তা শ্রমিকের অনুসন্ধান পেয়েছে।

তাই তো দেখি মোটরগাড়ির গ্যারেজে যারা কাজ করছে তাদের প্রায় সবাই শিশু। এরা প্রাইমারি স্কুল পেরিয়ে হাই স্কুলে যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু বাস্তব অবস্থা এদেরও স্কুল থেকে তাড়িয়েছে। ঢাকা শহরে এসে এরা মেকানিক হওয়ার জন্য গ্যারেজে চাকরি নিয়েছে। কিছু কম বয়সের লোক রিকশাও চালায়। রিকশায় আমিও উঠি। ভাবি, এরাই বা কেন অশিক্ষিত থাকল। চারদিকে এত স্কুল, শিক্ষার জন্য এত আয়োজন, তাহলে এরা কেন অশিক্ষিত থেকে গিয়ে রিকশার চালক হলো। হ্যাঁ, এদেরও স্কুল টানতে পারেনি। টানলেও রাখতে পারেনি। এরাও জীবিকার জন্য ঢাকা শহরে এসে সহজ কাজ রিকশা চালানোর পেশা নিয়েছে।

এত ভোকেশনাল ট্রেনিং ইনস্টিটিউট, যুবকদের জন্য ছয় মাস বা এক বছরের ছোট প্রগ্রামস। তাহলেও কেন সঠিক কারিগরটাকে অর্থ দিয়েও পাওয়া যায় না। বাস্তব অবস্থা হলো এ ক্ষেত্রেও যে অর্থটা ব্যয় করতে হয়, তা অনেকেরই নেই। তাই শুধু ছয় মাসের একটা কোর্সে ভর্তি হতে পারেনি, কিছুই না জেনে অবশেষে চায়ের দোকানে, মুদির দোকানে, গ্যারেজের কর্মচারী হয়েছে। এগুলো কি চাকরি? এই চাকরিগুলোর বৈশিষ্ট্য হলো শুরু যেখানে শেষও সেখানে। বলা চলে ফিজিক্যাল লেবারের চাকরি। যত দিন শরীর ভালো থাকে তত দিন এদের জন্য এই চাকরিগুলো থাকবে। এরা কিন্তু অবসর বয়স আসার আগেই অবসরে চলে যাবে। পথে-ঘাটে-রাস্তায় হাজার হাজার মিলনকে দেখতে পাওয়া যায়। কখনো এরা বিনা পয়সায় ক্রিকেট খেলাও দেখে। কিন্তু এদের মধ্যেও তো আছে সাকিব-মুশফিকরা। অর্থ নেই বলে এরা পেটপুরে খেতে পারেনি। তাই এখন ব্যাট-বল হাতে নেওয়ার অবস্থা তাদের নেই। এরা খেলা দেখে। সবাই চলে গেলে মিলনরা ফেলে যাওয়া বল নিয়ে নকল ব্যাট বানিয়ে ক্রিকেট খেলে। তারপর এরা একেকজন একেক দিকে চলে যায়। এদের ঠিকানা এক জায়গায় নয়। শুধু খেলা দেখতে এলে কদাচিৎ একে অন্যকে দেখে।

হায়রে প্রাইভেট টিউশনি, তুমি এতই কস্টলি (costly) যে তোমার জন্য মিলনরা অর্থ জোগান দিতে না পেরে স্কুল থেকে ঝরে পড়েছে। হে স্কুলশিক্ষক, তোমার হয়েছে কী, তুমি কেন এত অধঃপতিত হলে। নিজ ছাত্রকে প্রাইভেট পড়তে বাধ্য করছ। না পড়লে নম্বর কম দিয়ে তাদের মন ভাঙছ! সরকার তো শিক্ষার জন্য অনেক কিছুই করেছে। সবার নাগালের মধ্যে শিক্ষা, অন্তত তাত্ত্বিকভাবে এসে গেছে। কিন্তু বাস্তব অবস্থাটা অনুধাবন করার জন্য অনুরোধ করব। প্রাইভেট পড়া, নোট-গাইড বই কেনা, এসব আমাদের ফ্রি এডুকেশনকে ফ্রি থাকতে দেয়নি। তাই দরিদ্রদের জন্য এখনো স্কুলের শিক্ষা দূরেই থেকে গেল। আমরা কি পারি না প্রাইভেট পড়ানোটা বন্ধ করতে? আমরা কি পারি না আরো কিছু কম বই পাঠ্যসূচিতে অন্তর্ভুক্ত করতে? আমরা কি পরি না স্কুল পর্যায়ে আরো কিছু পরীক্ষা কমিয়ে দিতে?

 

লেখক : অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

 

সৌজন্যে: কালের কণ্ঠ

ছুটি না বাড়ালে বাড়ি যেতে হতে পারে ঈদের দিন - dainik shiksha ছুটি না বাড়ালে বাড়ি যেতে হতে পারে ঈদের দিন হাইস্কুলে কমেছে দশ লাখের বেশি শিক্ষার্থী - dainik shiksha হাইস্কুলে কমেছে দশ লাখের বেশি শিক্ষার্থী জালিয়াতি করে পদোন্নতি শিক্ষা ক্যাডার গ্যাঁড়াকলে - dainik shiksha জালিয়াতি করে পদোন্নতি শিক্ষা ক্যাডার গ্যাঁড়াকলে রুয়েটের সাবেক উপাচার্য-রেজিস্ট্রারের বিরুদ্ধে মামলা - dainik shiksha রুয়েটের সাবেক উপাচার্য-রেজিস্ট্রারের বিরুদ্ধে মামলা উপবৃত্তির জন্য সংখ্যালঘু কোটার তথ্য চেয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয় - dainik shiksha উপবৃত্তির জন্য সংখ্যালঘু কোটার তথ্য চেয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয় প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগে সতর্কীকরণ বিজ্ঞপ্তি - dainik shiksha প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগে সতর্কীকরণ বিজ্ঞপ্তি উপবৃত্তির জন্য সংখ্যালঘু কোটার তথ্য চেয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয় - dainik shiksha উপবৃত্তির জন্য সংখ্যালঘু কোটার তথ্য চেয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয় হাইস্কুলে কমেছে দশ লাখের বেশি শিক্ষার্থী - dainik shiksha হাইস্কুলে কমেছে দশ লাখের বেশি শিক্ষার্থী please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0058698654174805