স্কুলের পাঠ্যপুস্তকে ভাষা দিবসের গুরুত্ব তুলে ধরতে হবে - দৈনিকশিক্ষা

স্কুলের পাঠ্যপুস্তকে ভাষা দিবসের গুরুত্ব তুলে ধরতে হবে

দৈনিকশিক্ষা ডেস্ক |

বায়ান্নর একুশে ফেব্রুয়ারি—বাঙালির আত্মপরিচয় ও স্বকীয়তাবোধের জাগ্রত চেতনা থেকে উৎসারিত একটি দিন। এ দিনে মাতৃভাষা বাংলার সম্মান রক্ষার তাগিদে বুকের রক্তে রাজপথ রঞ্জিত করেছিলেন বাংলার দামাল তরুণরা। বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী এবং দেশের স্বাধীনতার ৫০ বছর উদযাপনের ক্ষণে আমরা তাদের চিরশ্রদ্ধায় স্মরণ করি। ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’ স্লোগান দিতে দিতে ঘাতকের বুলেটের সামনে বুক পেতে দিয়েছিলেন সালাম, বরকত, রফিক, জব্বারসহ নাম না জানা অনেক শহীদ। তারা বিদেশী শাসকদের বুঝিয়ে দিয়েছিলেন, বাংলা ও বাঙালি এক অবিচ্ছিন্ন সত্তা। এ শক্তিকে অস্বীকার করার শক্তি কারো নেই। প্রতি বছর ২১ ফেব্রুয়ারি আমাদের যেমন ইতিহাসের গৌরবোজ্জ্বল সংগ্রাম ও আত্মত্যাগের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়, তেমনি আমাদের দাঁড় করায় এক আত্মজিজ্ঞাসার মুখোমুখিও। এ দীর্ঘ সময়ে মাতৃভাষার চর্চা, মর্যাদা ও অধিকার প্রতিষ্ঠায় আমরা কতখানি এগিয়েছি? রোববার (২১ ফেব্রুয়ারি) বণিক বার্তা পত্রিকায় প্রকাশিত সম্পাদকীয়তে এ তথ্য জানা যায়। 

সম্পাদকীয়তে আরও জানা যায়, ভাষা আন্দোলনের মর্মবাণী ছিল এর রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি এবং সর্বস্তরে বাংলা ভাষার প্রচলন। কিন্তু ভাষা শহীদদের প্রধান যে অঙ্গীকার—সর্বস্তরে বাংলা ভাষার প্রচলন—স্বাধীনতার ৫০ বছরেও আমরা তা করতে পুরোপুরি সফল হইনি। এ দীর্ঘ সময়ে আমরা মাতৃভাষাকে পুরোপুরি শিক্ষার বাহন করতে পারিনি। প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরে বাংলা চালু থাকলেও বাংলা এখনো উচ্চশিক্ষার বাহন হয়নি। সরকারি কাজকর্মে বাংলা চালু থাকলেও উচ্চশিক্ষা, গবেষণাসহ নানা গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রে ইংরেজি প্রাধান্য পেয়ে আসছে। বিজ্ঞান, চিকিৎসাশাস্ত্র, প্রকৌশলসহ বহু বিষয়ে বাংলায় পাঠ্যপুস্তক রচনা করা সম্ভব হয়নি। ফলে এসব বিষয়ে শিক্ষার্থীরা ইংরেজিতে পড়তে বাধ্য হচ্ছে। অথচ বাংলাদেশের চেয়ে কম জনসংখ্যার দেশ জাপান, কোরিয়াসহ অনেক রাষ্ট্র মাতৃভাষায় উচ্চশিক্ষার সব দরজা খুলে দিয়েছে।

বাংলাদেশের শিল্প-কারখানা, ব্যবসা-বাণিজ্য ও ব্যাংক-বীমা প্রতিষ্ঠানে প্রতিদিনের কার্যক্রম সম্পাদিত হচ্ছে ইংরেজি ভাষায়। অফিস-আদালতের প্রয়োজনীয় শব্দগুলো ইংরেজিতে লেখা হয় আজও। বাংলাদেশের করপোরেট ভাষা এখনো ইংরেজি। অনেকেই যুক্তি দেখান, মুক্তবাজার অর্থনীতিতে বিশ্ববাজারে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকার জন্য ইংরেজি জানা জরুরি। অথচ বিশ্ববাজারে চীনের উৎপাদিত পণ্য বিশাল জায়গা দখল করে আছে, চীনারা যদিও ইংরেজি ভাষা ব্যবহার করে না। বিশ্ববাণিজ্যে রাশিয়ার আধিপত্যও কম নয়, রুশরাও ইংরেজি বলে না। আমাদের মনে রাখতে হবে, শ্রম বা পণ্য বিনিময়ের ক্ষেত্রে ভাষা অন্যতম মাধ্যম। যে ভাষার জাতি তার কারখানায় পণ্যটি উৎপাদন করছে, সেই ভাষার মাধ্যমে যদি ভোক্তাকে অনুপ্রাণিত না করা যায়, তাহলে পণ্যের বাজারটি ধরে রাখা সম্ভব হয় না। ইংরেজির পাশাপাশি বাংলায় আইন প্রণয়ন করা হলেও উচ্চ আদালতে বাংলা ভাষা চালু হয়নি। বেশ কয়েক বছর আগে উচ্চ আদালত বাংলা ভাষা ব্যবহারে শৃঙ্খলা আনতে একটি কমিটি করে দিলেও তার কাজের অগ্রগতি সম্পর্কে কিছুই জানা যায় না। মাতৃভাষার চর্চা ও বিকাশের ক্ষেত্রে আমাদের পিছিয়ে থাকা ভাষা আন্দোলনের চেতনার সঙ্গে মোটেই সংগতিপূর্ণ নয়।

প্রতি বছরই ২১ ফেব্রুয়ারিকে সামনে রেখে আমরা সর্বস্তরে বাংলা ভাষা প্রবর্তনের কথা বলি। কিন্তু সর্বস্তরে মাতৃভাষা বাস্তবায়নে অগ্রগতি সামান্যই। এক্ষেত্রে যাদের ওপর দায়িত্ব ন্যস্ত, তাদের নিষ্ক্রিয়তা আমাদের পীড়িত করে। ভাবতে অবাক লাগে সিয়েরা লিয়নের মতো দেশ যেখানে বাংলা ভাষাকে তাদের সরকারি ভাষা হিসেবে ঘোষণা দিতে পারে, সেখানে আমরা কেন আমাদের অফিস-আদালতে এখনো ব্রিটিশ আমলের প্রথা মেনে চলি। বাংলা ভাষা প্রচলিত আইন ১৯৮৭ অনুসারে, বাংলাদেশের সর্বত্র তথা সরকারি অফিস, আদালত, আধা সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান কর্তৃক বিদেশের সঙ্গে যোগাযোগ ব্যতীত অন্য সব ক্ষেত্রে নথি ও চিঠিপত্র, আইন-আদালতের সওয়াল-জবাব এবং অন্যান্য আইনানুগ কার্যাবলি অবশ্যই বাংলায় লিখতে হবে।

বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনের পথ ধরেই ১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দে রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতা এসেছে। প্রযুক্তির উন্নততর উত্কর্ষে বিশ্ব এগিয়ে যাচ্ছে, অন্যদের সঙ্গে তাল মিলিয়ে আমাদেরও এগিয়ে যেতে হবে। কিন্তু সে অগ্রগামিতা যেন বাঙালির আত্মপরিচয়ের পরিপন্থি না হয়। ১৯৯৯ খ্রিষ্টাব্দে ২১ ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের স্বীকৃতি লাভের পর বিশ্বের প্রায় সব দেশ দিবসটি আনুষ্ঠানিকভাবে উদযাপন করে মাতৃভাষার মর্যাদার স্মারক হিসেবে। প্রতিটি ভাষার মর্যাদা প্রতিষ্ঠায় দিবসটি তাত্পর্যপূর্ণ। প্রত্যাশা থাকবে, বিশ্বের অন্যান্য অঞ্চলের প্রায় হারিয়ে যাওয়া ভাষাগুলো সংরক্ষণে ইউনেস্কো কার্যকর উদ্যোগ নেবে। একই সঙ্গে সক্রিয় হবে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট। বিশ্বের বিভিন্ন ভাষা সংরক্ষণ, রক্ষা ও গবেষণার যে উদ্দেশ্য নিয়ে এটি প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে, তা যেন যথাযথ ভূমিকা রাখতে পারে।

আমাদের মনে রাখতে হবে, নিজস্ব ভাষা, নিজস্ব রীতি-কৃষ্টিকে প্রান্তিক রেখে সামগ্রিক উন্নয়ন সম্ভব নয়। সময় এসেছে নতুন করে ভাষার গুরুত্ব উপলব্ধির। স্কুলের পাঠ্যপুস্তকে ভাষা দিবসের গুরুত্ব তুলে ধরতে হবে। বাংলা ভাষার পাশাপাশি দেশের অন্যান্য জাতিসত্তার ভাষা সংরক্ষণ ও সুরক্ষার দিকে দৃষ্টি দিতে হবে। দেশের অন্যান্য অঞ্চলের মানুষের ভাষাকে রুগ্ণ রেখে সার্বিক সমৃদ্ধি অর্জন সম্ভব নয়। নিজেদের আত্মমর্যাদাশীল জাতি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে হলে শিক্ষা, সরকারি-বেসরকারি দপ্তর, ব্যবসা-বাণিজ্যসহ সর্বস্তরে বাংলা ভাষা প্রচলনে আমাদের মহাপরিকল্পনা গ্রহণের পাশাপাশি দ্রুততম সময়ে তা বাস্তবায়ন করতে হবে। মুজিব বর্ষে এটাই হতে পারে ভাষা শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদনের শ্রেষ্ঠ উপায়।

প্রাথমিকের শিক্ষকদের ফের অনলাইনে বদলির সুযোগ - dainik shiksha প্রাথমিকের শিক্ষকদের ফের অনলাইনে বদলির সুযোগ তীব্র তাপপ্রবাহের ভেতরই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলছে রোববার - dainik shiksha তীব্র তাপপ্রবাহের ভেতরই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলছে রোববার দেশে তিন দিনের হিট অ্যালার্ট জারি - dainik shiksha দেশে তিন দিনের হিট অ্যালার্ট জারি নতুন শিক্ষাক্রম ও কিছু কথা - dainik shiksha নতুন শিক্ষাক্রম ও কিছু কথা কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে স্কুলে দুই শিফটের ক্লাস চালু রাখার সভা রোববার - dainik shiksha স্কুলে দুই শিফটের ক্লাস চালু রাখার সভা রোববার শিক্ষা কর্মকর্তার আইডি ভাড়া নিয়ে প্রধান শিক্ষকের বাণিজ্য - dainik shiksha শিক্ষা কর্মকর্তার আইডি ভাড়া নিয়ে প্রধান শিক্ষকের বাণিজ্য শিক্ষকদের অবসর সুবিধা সহজে পেতে কমিটি গঠন হচ্ছে - dainik shiksha শিক্ষকদের অবসর সুবিধা সহজে পেতে কমিটি গঠন হচ্ছে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে নিষিদ্ধ, মৌলবাদী সংগঠনের বিরুদ্ধে অবিলম্বে ব্যবস্থা নিন - dainik shiksha নিষিদ্ধ, মৌলবাদী সংগঠনের বিরুদ্ধে অবিলম্বে ব্যবস্থা নিন please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0066981315612793