স্বতন্ত্র ইবতেদায়ি মাদরাসা শিক্ষকের ঈদ - দৈনিকশিক্ষা

স্বতন্ত্র ইবতেদায়ি মাদরাসা শিক্ষকের ঈদ

এম আবু বককার মল্লিক |

“আজ ঈদ মদিনার ঘরে ঘরে আনন্দ। পথে পথে শিশুদের কলোরব। দলে দলে লোকজন ঈদগাহে চলেছে। তাদের গায়ে নানান রংয়ের পোষাক। বাতাসে আতর গোলাপের সুবাস।” ছোট বেলায় বইয়ে পড়া এই গল্পটি হাজার লোকের মনে জাগিয়ে তোলে ঈদের দিনের মহা আনন্দের কথা।

এ আনন্দের মহা উৎসবে প্রতিটি ঘরে ঘরে ধনী-গরীব ছোট বড় মিলে কত কোলাহল, সেই সকালে ঘুম থেকে উঠে গোসল করা, সুন্দর জামা কাপড় পরা, আতর মাখা, ফিরনি-সিমাই খাওয়া, সকলে মিলে ঈদগাহে যাওয়া, ঈদের নামাজ পড়া, কোলাকুলি করা, প্রিয়জনের সাথে দেখা করা।

ছোট্ট ছোট্ট শিশুদের রঙ বে-রঙের পোশাকে আনাগোনা আর তাদের বায়না পূরণ করা, আত্মীয়স্বজনের আপ্যায়ন করা, নতুন বধুয়ার বেশে রমণীর পোলাও, কোরমা, রং বে-রঙের খাবার রান্না ও পরিবেশন করা সব মিলিয়ে যেন ঈদের দিনটি ঝরনার কলতানের মতো আনন্দের সাগরে ভেসে থাকে।  

সাতদিন পরেই ঈদ। এই করোনা মহামারিকালে বড়দের মন স্থির থাকলেও ছোট্ট ছোট্ট শিশুদের মন ঈদের আনন্দে, উদাস হাওয়ার মতো যেন ভেসে বেড়াচ্ছে। ইবতেদায়ি শিক্ষকের অবুঝ বালক বালিকা দু’টি ক’দিন থেকে ঈদের বায়না শুরু করেছে।  

সেই ১৯৮৪ খ্রিষ্টাব্দ থেকে প্রাথমিক শিক্ষা বিস্তারে দেশে অনেক ইবতেদায়ি মাদরাসা প্রতিষ্ঠা হয়। আদর্শ জাতি ও সমাজ গঠনের লক্ষ্যে এবং জীবন ও জীবিকার সন্ধানে অনেক ভালো ভালো ছেলে-মেয়েরা এখানে চাকরি গ্রহণ করে। স্বতন্ত্র ইবতেদায়ি মাদরাসার এসব শিক্ষকেরা যেন অরণ্য প্রকৃতির মাঝে ফুটন্ত বনফুল। পল্লী গায়ের মেঠো পথে যেন শিশিরে ভেজা দূর্বা কোমল। এদেরকে মাড়িয়ে গেলেও কোমল ছোঁয়ার পরশ ছাড়া আর কিছু দিতে জানে না। কয়েক দশকে বাংলাদেশের শিক্ষকদের ইতিহাসে স্বতন্ত্র ইবতেদায়ি মাদরাসার শিক্ষকেরা যেন নীতি-নৈতিকতার মূর্ত প্রতীক। সৎ, নিরী্হ, অনুগত,পরশ পাথর, দেশ ও জাতি গঠনের প্রাথমিক কারিগর, অভুক্ত থেকেও দেশের সেবায় নিজেকে নিয়োজিত রেখেছেন। স্বতন্ত্র ইবতেদায়ি মাদরাসার শিক্ষকেরা শত কষ্টের মধ্য থেকেও কখনোই আদর্শ থেকে বিচ্যুত হইনি।

অনেক দিন থেকে, মাঝে মাঝে জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে মানববন্ধন, সাংবাদ সম্মেলন এবং অনশন করে স্বতন্ত্র ইবতেদায়ি মাদরাসার শিক্ষকেরা তাদের দুর্বল হৃদয়ের আর্তনাদ প্রকাশ করে আসছে  কিন্তু কয়েক দশকের অনাহারী ক্ষুধার্ত বঞ্চিত শিক্ষকদের ক্ষীণ আর্তনাদ কেন জানি ব্যস্ত ঐ শহরের দামি দামি গাড়ির হর্নের শব্দে কেউ শুনতে পায় না। সবাই যেন নিজের কাজে ব্যস্ত। অজপাড়া গাঁয়ের কোন অভুক্ত শিক্ষক অনাহারে কনকনে শীতে কি যেন আশায় ঐ ফুটপাতে পড়ে আছে, কে তার খবর রাখে?  

তাদের মাঝে এ অবুঝ বালক বালিকা দু’টির বাবাও একজন শিক্ষক। সুদীর্ঘ তিন দশক অতিক্রম করলেও ঘোরেনি ইবতেদায়ি মাদরাসার শিক্ষকদের ভাগ্যের চাকা। ইবতেদায়ি মাদরাসায় দায়িত্ব পালনের কারণে তাদের কর্মময় জীবনে অন্য কোনো উপার্জনের পথ নাই বললে চলে। এমতাবস্থায় স্বতন্ত্র ইবতেদায়ি মাদরাসার শিক্ষকদের পরিবারে দারিদ্র্যতা নিত্যদিনের সাথী।    

দারিদ্র্যের কষাঘাতে রোগাক্রান্ত বৃদ্ধ পিতা-মাতার করুণ চাহনি, স্ত্রীর মলিন বদন, ছোট দু’টি ছেলে মেয়ের আবদার পূরণে ব্যর্থ পিতা, দু’দিন পরেই ঈদ কিন্তু এ শিক্ষক জানে কারো আবদার সে পূরণ করতে পারবে না। ছোটবেলায় যে পিতা কাঁধে করে নিয়ে যেত হাটে, ঈদের বায়না মেটাতো প্রতি পদে পদে আজকে সে পিতা মলিন মুখে চেয়ে আছে মোর পথপানে। যে মাতা শত স্নেহ মমতা দিয়ে করেছে লালন পালন, আজ সে দুঃখিনী মাতা অশ্রুসজল চোখে চেয়ে আছে ছেলের মলিন মুখোপানে। করে না তারা ঈদের বায়না, চাহে না  কিছু মোর কাছে। সন্তানের একটু হাসি মুখটা দেখতে চেয়েছিল দু’জনে।

দশ বছর বয়সের ছেলেটা আমার, হীরার থেকেও দামি। দাদা দাদি তারে বহুবার বলে এ যেন বংশের বাতি। এমন ছেলে জড়িয়ে গলা  বুলিয়ে  মাথায় হাত পিতার কাছে কত বার যে বায়না করে আজ। “এবার ঈদে রিমোটের গাড়ি কিনে দিও আমায়। পাশের বাড়ির ছেলেটার মতো সুন্দর দেখে পাঞ্জাবি, পায়জামা কিন্তু সাদা হতে হবে, কিনে দিও টুকটুকে লাল টুপি। আগের ঈদে ক্যানের আরসি চেয়েছিলাম তোমার কাছে, না দিয়ে তুমি চলে এসেছিলে, সে কথা আমার মনে আছে।” ছয় বছরের মেয়েটা দেখতে চাঁদের মতো মুখ, কেড়ে নিয়েছে পল্লী গায়ের শত মানুষের রূপ। পাড়ার লোকেরা বহুবার বলে আহা কেমন লক্ষী মেয়ে গো তোমার, ওর মায়ের মতো রূপ। কত আদরে কত মমতায় বুকে লই তারে বারে বারে, তবু যেন তৃষ্ণা মেটেনা কভু ক্ষণিকের তরে। সেই মেয়ে আজি নিকটে আসিয়া মুখে বুলাই হাত। কানের কাছে মুখ নিয়ে বলে “আমার কিছু দাও?” গল্প নয় গো? সত্যি কথা।

রুপাই মিয়ার সাজুর মতো, ওদের মায়ের মুখ। এত কষ্টে থাকে তবু বোঝা যায় না দুঃখ। হাসে যখন চাঁদের হাসি বইছে শতরূপ। এমন মানুষ চেয়েছিল অনাহারি মুখে, হঠাৎ করে কোনো খেয়ালে এদিকে উঠে আসে। ছিন্ন কাপড়ে মলিন বদনে শোনায় একটি কথা, এই ঈদে আমার লাগবে না কিছু,পরের ঈদে দিয়ো। পল্লী গায়ের পল্লী বধু ছেলের ধরিল কান, বলিতে লাগিল দশ বছর বয়স হয়েছে তোর, অত সব বায়না করিস কেন? ছোট্ট মেয়েটি দাদির আচলে লুকিয়ে মুখখানা রক্ষা পাইল এবারের মতো, ভয়ে হইল সারা। এমন সময় মাস্টার সাহেব কহিতে চাহিলেন কথা। আগুন হইয়া উঠিল সাজু বলিল শুনবো না তোমার কোনো কথা। আপন মনে বলিতে লাগিল অশ্রুসজল চোখে। এক যুগ হল ঘরে এনেছো কি দিয়েছো বলো আগে। পাশের বাড়ির খোকার বাবা প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক, তুমি তাই ভেবে বসে আছো আজি কষ্ট আমার এই লাগে। ছোটবেলায় আমিও ছিলাম ইবতেদায়ির ছাত্রী। সেই সময় কার নেয়ামতুল্লাহ স্যার তোমাদের মতো করে, বিদায় হয়েছে অজানার দেশে আসবে না কভু ফিরে। হেড স্যার ছিল শহীদুল্লাহ স্যার আশায় আশায় থেকে দু’বছর আগে বিদায় হয়েছে বয়সের ভারে নত হয়ে।

চেয়ে দেখো মোর জীর্ণ কুটির খানি, যেন আসমানিদের ঘরের ছাউনি। ঝড়ো হাওয়া বৃষ্টি বাদলে কি হবে মোদের এ কথা কি ভেবে পাওনি? শত শ্রম আর সাধনা দিয়ে মাদরাসার ঘর করেছো উজালা, ফুলে ফুলে আজ ভরে গেছে সে মাদরাসার আঙ্গিনা। কতবার তোমার ছাত্ররা পেল ঢাকা বোর্ড থেকে বৃত্তি, একদিন ও চোখে দেখলাম না সামান্য একটু মিষ্টি। জীবন তো আর বসে থাকে না, কি করলে আজ আমাদের জন্য বলো না একটু ভেবে? বাচ্চা দুটো এই বছরে ক্লাসে হইল ফার্স্ট, তাদের হাতে কি দিয়েছো বলো দেখি আজ? আগের ঈদে গোস্ত দিয়েছিল তোমার মেজো ভাই। তার পরে আর মানিক জোড়েরে গোস্ত খাওয়াতে পারিনি যে আমি আর। তুমি থাকো মাদরাসাতে তোমার কাজ নিয়ে। যত জ্বালা পোহাতে হয় আমাকে সব নিয়ে। পাশের বাড়িতে গোস্ত আনে প্রতি শুক্রবার, ফল-ফলাদি কাপড়-চোপড় অভাব নেইকো তার। আমরা না হয় বড় মানুষ,বাচ্চারা কি বুঝে? একটি মোরগ রেখে ছিলাম করবো রান্না ঈদে। মেয়ের অসুখে বিক্রি করিলে, করবো  লকি বলো ঈদে ?   
       
মাস্টার সাহেব বহু চুপ থেকে কহিলেন এবার কথা চিন্তা করো না, সবুর করো, শোনো মোর একটি কথা।  ধৈর্য ধরেছি সবুর করেছি বহু বছর ধরে, আশা রাখো এবার ইনশাল্লাহ একটা ব্যবস্থা হবে। 

লেখক : প্রধান শিক্ষক, নিত্যানন্দী স্বতন্ত্র ইবতেদায়ি মাদরাসা, শালিখা, মাগুরা।

[মতামতের জন্য সম্পাদক দায়ী নন]

নারীদের আইসিটিতে দক্ষ হতে হবে: শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী - dainik shiksha নারীদের আইসিটিতে দক্ষ হতে হবে: শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী ডিগ্রি তৃতীয় শিক্ষকদের এমপিওভুক্তির সভা ৩০ এপ্রিল - dainik shiksha ডিগ্রি তৃতীয় শিক্ষকদের এমপিওভুক্তির সভা ৩০ এপ্রিল সনদের কাগজ কীভাবে পায় কারবারিরা, তদন্তে নেমেছে ডিবি - dainik shiksha সনদের কাগজ কীভাবে পায় কারবারিরা, তদন্তে নেমেছে ডিবি কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে বুয়েটে সিসিটিভি ফুটেজে ধরা পড়লো হিজবুত তাহরীরের লিফলেট বিতরণ - dainik shiksha বুয়েটে সিসিটিভি ফুটেজে ধরা পড়লো হিজবুত তাহরীরের লিফলেট বিতরণ সাংবাদিকদের ঘুষ বিষয়ক ভাইরাল ভিডিও, ইরাব কোনো বিবৃতি দেয়নি - dainik shiksha সাংবাদিকদের ঘুষ বিষয়ক ভাইরাল ভিডিও, ইরাব কোনো বিবৃতি দেয়নি ফাঁসপ্রশ্নে প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগ, নজরদারিতে যারা - dainik shiksha ফাঁসপ্রশ্নে প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগ, নজরদারিতে যারা এইচএসসির ফল জালিয়াতির অডিয়ো ফাঁস - dainik shiksha এইচএসসির ফল জালিয়াতির অডিয়ো ফাঁস please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0072929859161377