কোভিড-১৯ নামে একটি নতুন ভাইরাস ছড়িয়ে পড়ার পর গত বছরের ৩০ জানুয়ারি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা জরুরি অবস্থা ঘোষণা করেছিল। জানুয়ারির শেষের সেই দিনটিতে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ মূলত চীনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল এবং তখন পর্যন্ত বিশ্বের ১৮টি দেশে ৮২ জন এবং চীনে ৭৭৩৬ জনসহ মোট ৭৮১৮ জন করোনায় আক্রান্ত হয়েছিলেন এবং তাদের মধ্যে প্রায় ১৫০ জনের মৃত্যু হয়েছিল। এরপর দ্রুতই এ ঘাতক ভাইরাসটির সংক্রমণ সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে এবং এক বছরের মাথায় প্রায় ১০.৮৮ কোটি লোক আক্রান্ত হয় এবং ২৩.৯৪ লাখ লোকের প্রাণহানি ঘটে। বাংলাদেশে গত বছরের ৮ মার্চ প্রথম করোনা রোগী শনাক্ত হয়। রোববার (১৪ ফেব্রুয়ারি) যুগান্তর পত্রিকায় প্রকাশিত উপসম্পাদকীয়তে এ তথ্য জানা যায়।
উপসম্পাদকীয়তে আরও জানা যায়, করোনা মহামারির মৃত্যুঝুঁকি থেকে জনগণকে রক্ষার জন্য বিশ্বের প্রায় প্রতিটি দেশেই এক সময় লকডাউন, কোয়ারেন্টিন ও সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখাসহ স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার ওপর গুরুত্ব দেওয়া হয়। পরে মানুষের জীবনযাত্রা ও অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড সচল রাখার স্বার্থে আস্তে আস্তে লকডাউন ও কোয়ারেন্টিন উঠিয়ে দেওয়া হলেও কেবল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ বিবেচনায় এখন পর্যন্ত বন্ধ রাখা হয়েছে। যদিও গত বছরের সেপ্টেম্বরে পশ্চিমা বিশ্বের কয়েকটি দেশসহ বিশ্বের কিছু দেশ মাধ্যমিক স্তর পর্যন্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেয় এবং শিক্ষার্থীদের মধ্যে করোনা সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে আবার বন্ধ করে দিতে বাধ্য হয়। আমাদের দেশে প্রায় সব প্রতিষ্ঠানই খুলে দেওয়ার পরও গত বছরের ১৭ মার্চ থেকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রয়েছে এবং দ্রুত খুলে দেওয়ার জন্য সরকার চাপের মধ্যে আছে।
সরকারি পরিসংখ্যান মতে, দেশে করোনা সংক্রমণের হার অনেকটা কমে এসেছে। তবে এটাও সত্য, সরকার কোটি কোটি শিক্ষার্থী, শিক্ষক ও কর্মকর্তা-কর্মচারীসহ তাদের পরিবারের সদস্যদের করোনার কারণে মৃত্যুঝুঁকিতে ঠেলে না দিয়ে জীবনের নিরাপত্তাকেই সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিতে চায় বলেই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মতো ঝুঁকিপূর্ণ খাত এখনো বন্ধ রেখেছে। এদিকে দীর্ঘসময় ধরে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় শিক্ষার্থীরা লেখাপড়া চর্চা থেকে দূরে সরে গিয়ে সেশনজটের কবলে পড়ে মানসিকভাবে ভালো নেই এবং অনেক শিক্ষার্থীর আত্মহত্যার খবর পাওয়া গেছে। অনেক শিক্ষার্থী লেখাপড়া ছেড়ে অন্য কাজকর্মে বা শিশুশ্রমে ঢুকে পড়েছে; আবার অনেকেই লেখাপড়ার অভ্যাস ছেড়ে টিভি দেখা ও ইন্টারনেট গেমের প্রতি আসক্ত হয়েছে। এসব শিক্ষার্থীর একটি অংশকে আবারও স্কুলে ফিরিয়ে আনা কঠিন হবে। কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক শিক্ষার্থী লেখাপড়ার পাশাপাশি টিউশনি করে নিজের লেখাপড়ার খরচ বহনসহ তাদের পরিবারের খরচও চালিয়ে নিত; এমনকি অনেক পরিবার তাদের সন্তানের টিউশনির উপার্জনের ওপর নির্ভরশীল। করোনাকালীন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকার কারণে টিউশনিও বন্ধ থাকায় এসব অভাবী পরিবারের শিক্ষার্থীরা আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত ও অনেকেই ঋণগ্রস্ত হয়ে অন্য পেশায় নিয়োজিত হতে বাধ্য হয়েছে।
শিক্ষার্থী ছাড়াও বেসরকারি অনেক স্কুল-কলেজ বন্ধ হয়ে যাওয়ার কারণে বা বেতনভাতা বন্ধ হওয়ার দরুন শিক্ষক-কর্মকর্তারা আর্থিক সংকটে পড়ে মানবেতর জীবনযাপনসহ অনেকেই জীবন-জীবিকার তাগিদে ছোটখাটো অন্য পেশায় চলে যেতে বাধ্য হয়েছেন। দীর্ঘদিন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকার কারণে সৃষ্ট অতুলনীয় ক্ষতি পুষিয়ে নেওয়াই এখন সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। সরকারও করোনা পরিস্থিতি বিবেচনা করে স্বাস্থ্যবিধি মেনে খুব শিগগির ধাপে ধাপে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকার পরও করোনা আক্রান্ত হয়ে ইতোমধ্যে অনেক শিক্ষক প্রাণ হারিয়েছেন; অনেকেই অসুস্থ হয়ে করোনার সঙ্গে লড়াই করছেন, আবার অনেকেই স্বাস্থ্যগত দিক দিয়ে নানা ঝুঁকিতে রয়েছেন। এমনিতেই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো করোনা ছড়ানোর সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ স্থান; তাই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সবার করোনা সংক্রমণ থেকে সুরক্ষার ব্যবস্থা নিশ্চিত করেই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়া যুক্তিযুক্ত।
কোভিড-১৯ থেকে জনগণকে সুরক্ষা দেওয়ার জন্য গত ২৭ জানুয়ারি থেকে বাংলাদেশেও টিকাদান কার্যক্রম শুরু হয়েছে এবং ৭ ফেব্রুয়ারি থেকে গণটিকাদান কার্যক্রম চলছে। এখন পর্যন্ত বাংলাদেশসহ বিশ্বের মাত্র ৮১টি দেশ করোনার টিকা জোগাড় করতে পেরেছে। তাই বর্তমান সরকারের কূটনৈতিক সফলতার কারণেই যে দেশে দ্রুত গণটিকা প্রদান শুরু হয়েছে, তা অস্বীকার করার উপায় নেই। আশার কথা, প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে ইতোমধ্যে দেশের সব প্রাথমিক শিক্ষককে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে টিকা দেওয়ার উদ্যোগ নিয়েছে সরকার।
লোকসমাগম যেখানে বেশি, করোনা সংক্রমণের ঝুঁকিও সেখানে বেশি। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানও এ ঝুঁকিতে রয়েছে। তাই বিশ্বের কোনো দেশই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষক-কর্মচারীদের করোনা টিকার মাধ্যমে সুরক্ষা দেওয়ার আগে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো খুলে দেওয়ার ঝুঁকি নিতে চাচ্ছে না।
পশ্চিমা উন্নত দেশগুলোর মতো আমাদের দেশে অনলাইন পাঠদান কার্যক্রম শুরু হলেও যেসব কারণে তা সফল হয়নি তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে-দরিদ্র শিক্ষার্থীদের আর্থিক সমস্যার কারণে প্রয়োজনীয় ডিভাইস ও ইন্টারনেট প্যাকেজ কেনার সামর্থ্য না থাকা, অনেক প্রত্যন্ত অঞ্চলে ইন্টারনেট সংযোগের অভাব বা দেশের বিভিন্ন স্থানে ইন্টারনেটের গতি খুবই কম থাকা এবং পড়াশোনার উপযুক্ত পরিবেশের অভাবসহ অসচেতন অভিভাবকদের কারণে অনলাইন ক্লাসে প্রায় ৭০ শতাংশ শিক্ষার্থীর যুক্ত হতে না পারা। কাজেই করোনা ঝুঁকি থেকে নিরাপত্তা নিশ্চিত করে শিক্ষার্থীদের খুব দ্রুতই ক্লাসে ফিরিয়ে আনার জন্য সরকার যত তাড়াতাড়ি সম্ভব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার পথ যে বের করতে চায়, তাতে বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই।
গর্ভবতী ও ক্যান্সারের রোগীসহ যারা টিকা নিতে পারবেন না, তাদের জন্য প্রত্যেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভার্চুয়াল পদ্ধতিতে ক্লাস নেওয়ার ব্যবস্থা করা প্রয়োজন। আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও ছাত্র-শিক্ষকদের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের মতো আর্থিক প্রণোদনা প্যাকেজের অধীনে এনে শিক্ষা কার্যক্রম আগের অবস্থায় নিয়ে আসার পদক্ষেপ নিশ্চয়ই মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বিবেচনা করবেন। এ ক্ষেত্রে লেখাপড়া ছেড়ে যেসব শিক্ষার্থী শ্রমবাজারে প্রবেশ করেছে এবং জীবিকার তাগিদে শিক্ষকতা ছেড়ে যারা অন্য পেশায় নিয়োজিত হয়েছেন, তাদের আবারও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ফিরে আসার পথ সুগম করা হবে, এটাই কাম্য।
আমরা আশা করব, শিক্ষার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সবাইকে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে করোনার টিকা দিয়ে তাদের স্বাস্থ্য সুরক্ষা নিশ্চিত করে তারপর সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়া হবে।
লেখক : ড. মো. শফিকুর রহমান, অধ্যাপক, মাইক্রোবায়োলজি বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।