এক সামরিক অভ্যুত্থানে ১৯৮২ সালের ২৪ মার্চ তৎকালীন সেনাপ্রধান এইচএম এরশাদ রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করেন। ওই বছরের শেষ দিকে ১৪টি প্রগতিশীল ছাত্র সংগঠন একত্রিত হয়ে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ গঠন করে। ১৯৮৩ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি সংগ্রাম পরিষদ তৎকালীন শিক্ষামন্ত্রী ড. আব্দুল মজিদ খান প্রণীত শিক্ষানীতি বাতিলের দাবিতে সচিবালয় ঘেরাও কর্মসূচি ঘোষণা করে। ওই দিন ঢাকা নগরীর বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে ছাত্রছাত্রীরা দলে দলে মিছিল করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে জড়ো হতে থাকে। সকাল ১১টা নাগাদ বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা ছাত্রসমুদ্রে পরিণত হয়।
আমি তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের প্রথম বর্ষের ছাত্র। উচ্চ মাধ্যমিকে অধ্যয়নকালে আমি চট্টগ্রাম কলেজ ছাত্র সংসদের নির্বাচিত সাংস্কৃতিক সম্পাদক ছিলাম। ফলে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের ঘেরাও কর্মসূচিতে শিকড়ের টানে যুক্ত হয়ে গেলাম। পূর্ব ঘোষিত কর্মসূচি অনুযায়ী ছাত্রছাত্রীরা মিছিল নিয়ে এগিয়ে যায় সচিবালয়ের দিকে। কার্জন হল পার হয়ে শিক্ষা ভবনের কাছাকাছি যেতেই মিছিলটি পুলিশের বাধার সম্মুখীন হয়। ছাত্ররা পুলিশের ব্যারিকেড ভেঙে এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করতেই শুরু হয় লাঠিচার্জ। ছাত্ররাও পুলিশের দিকে পাল্টা ইট-পাটকেল ছুড়তে শুরু করে। লাঠিচার্জ করে যখন ছাত্রদের ঠেকানো যাচ্ছিল না, তখন পুলিশ টিয়ার গ্যাস ছুড়তে শুরু করে। তাতেও ছাত্ররা দমে না গিয়ে পুলিশের ব্যারিকেড ভেঙে এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করলে পুলিশ একপর্যায়ে গুলি ছুড়তে শুরু করে।ছাত্রের হতাহত হওয়ার খবর ক্যাম্পাসে আসতে শুরু করে। দুপুর নাগাদ পুলিশের গুলিতে নিহত একজন ছাত্রের লাশ (জাফর অথবা জয়নালের) ঢাকা মেডিকেল থেকে ক্যাম্পাসে আনা হয়। বিকেলে অপরাজেয় বাংলার পাদদেশে দাঁড়িয়ে ডাকসুর তৎকালীন সহসভাপতি আক্তারুজ্জামান সমবেত ছাত্রদের উদ্দেশে বলছিলেন- 'আমরা এ লাশ নিয়ে মিছিল করে বায়তুল মোকাররমে যাব, পথে যদি কোনো বাধা আসে তবে আমরা তার দাঁতভাঙা জবাব দেব।' ঠিক তখনই পুলিশের একটি গাড়িবহর কলাভবনের মূল ফটক দিয়ে ভেতরে ঢুকে যায়। সেখানে দাঁড়িয়ে থাকা নিরাপদ মনে করে দ্রুত কলা ভবনের ভেতরে আমার ডিপার্টমেন্টে যেতে চাইলাম। কিন্তু ঢুকতে গিয়ে দেখি কলাপসিবল গেটটি বন্ধ। নিরুপায় হয়ে সামনের অংশে অবস্থিত কলা অনুষদের ডিন অফিসের একটি কক্ষে ঢুকে পড়লাম। পুলিশও ওই কক্ষে ঢুকে বেধড়ক লাঠিচার্জ শুরু করে। নিমিষে লাঠির আঘাতে কয়েকজন ছাত্রকে মাটিতে পড়ে যেতে দেখলাম। রুমের বাইরে বেরিয়ে আসতে আসতে পিঠে, মুখে ও পায়ে আমিও কয়েক ঘা খেলাম। পার্শ্ববর্তী 'মলে' যাওয়ার গেটও ততক্ষণে বন্ধ। পুলিশে পরিপূর্ণ কলাভবন এলাকায় কিছুক্ষণ ছোটাছুটি করে এক পর্যায়ে 'মল' সংলগ্ন প্রায় চার-পাঁচ ফুট উঁচু দেয়ালের ওপর উঠে গেলাম। কিন্তু দেয়ালের ওপাশেও যেন ঢাকা শহরের সব পুলিশ অপেক্ষা করছে। দেয়াল থেকে নামতেই একজন পুলিশ অফিসার দৌড়ে এসে আমাকে পাকড়াও করে উপাচার্যের বাসভবনের সামনে দাঁড়ানো বাসে উঠিয়ে দিলো।
খানিক বাদে বাস থেকে নামিয়ে একটি পিকআপে তোলা হলো। সেখানে দেখলাম, তৎকালীন ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক খ. ম. জাহাঙ্গীর (পরবর্তী সময়ে প্রতিমন্ত্রী) বসে আছেন। আমাদের নিয়ে যাওয়া হলো রমনা থানায়। সন্ধ্যার পর থানায় গ্রেপ্তারকৃতদের সংখ্যা বাড়তে থাকে। তাদের অধিকাংশই রক্তাক্ত ও মাথায় ব্যান্ডেজ বাঁধা। রাতে থানা থেকে ভাত-ডাল দেওয়া হলো। মাঝরাতে খ. ম. জাহাঙ্গীরকে অন্যত্র সরিয়ে নেওয়া হলো। থানার দুটি ক্ষুদ্র কক্ষে শখানেক ছাত্রকে রাখা হয়েছিল; ফলে রাতে শোয়া দূরের কথা, পা মেলে বসার মতো জায়গাও ছিল না।
পরদিন দুপুরে থানা থেকে খাবার দেওয়া হলে কক্ষ-সংলগ্ন টয়লেটের দুরবস্থা দেখে না খাওয়াই সমীচীন মনে করলাম। এভাবে দুটি দিন কেটে যায়। ১৭ তারিখ সকালে আমাদের নেওয়া হয় কোর্টে, সেখান থেকে নাজিমউদ্দীন রোডের কেন্দ্রীয় কারাগারে। ছাত্রদের অধিকাংশই ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের। বুয়েট ও অন্যান্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেরও কয়েকজন ছিল।
কেন্দ্রীয় কারাগারে গিয়ে তিন দিন পর 'খোলামেলা' পরিবেশ ভালো লাগল। দুপুরে ডাল-রুটি খেতে দেওয়া হলো। বিকেলে কারাগারের '৫ খাতার' নিচের তলার পাশাপাশি দুটি ওয়ার্ডে আমাদের থাকার ব্যবস্থা করা হয়। জনপ্রতি তিনটি করে কম্বল, একটি অ্যালুমিনিয়ামের থালা ও একটি বাটি দেওয়া হলো। তিনটি কম্বলের একটি ফ্লোরে বিছানোর জন্য, একটি ভাঁজ করে বালিশের মতো ব্যবহারের জন্য এবং অপরটি গায়ে দেওয়ার জন্য। সন্ধ্যায় জেল হাসপাতালের ডাক্তার এলেন। গ্রেপ্তারকৃত সব ছাত্রই কম-বেশী আহত ছিল। স্থান সংকুলান না হওয়ায় সবাইকে হাসপাতালে ভর্তি দেখিয়ে ওয়ার্ডেই চিকিৎসা দেওয়া হলো। এ ব্যবস্থা এক সপ্তাহের জন্য বলে জানিয়ে দেওয়া হলো। মেডিকেল ডায়েট হিসেবে সকালে দুধ পাউরুটি, দুপুরে সবজি-ভাত-ডাল, বিকেল ৩টায় ডিম-চা এবং ৫টায় ভাতের সঙ্গে মাছ অথবা মাংস বরাদ্দ ছিল। সন্ধ্যার আগে বন্দিদের লকআপে যাওয়ার নিয়ম থাকায় রাতের খাবার বিকেলেই পরিবেশন করা হতো।
কারাগারে প্রত্যেকটি বিল্ডিংয়ের সামনে প্রশস্ত আঙিনা ছিল যেখানে বন্দিরা সন্ধ্যায় লকআপে যাওয়ার আগ পর্যন্ত ঘুরে বেড়াতে পারত। আঙিনার এক প্রান্তে ছিল গোসল করার জায়গা। সেটি অদ্ভুত ধরনের। ২০-২৫ ফুট লম্বা একটি প্ল্যাটফরমের দুই পাশে থাকা চ্যানেলের এক প্রান্ত থেকে দিনের নির্দিষ্ট সময়ে পানি ছাড়া হতো। কারাবাসী চ্যানেলের পাশে লাইন ধরে বসে এই পানিতে গোসল করত।
কারাগারে আমরা সিগারেটের প্যাকেটের উল্টোদিকে কলম দিয়ে এঁকে কার্ড বানিয়ে 'স্পেড ট্রাম্প' খেলতাম। বিকেলে প্যান্ট-শার্ট পরে আঙিনায় হাঁটতাম। এ সময় কারাগার সংলগ্ন ব্যস্ত নাজিমউদ্দীন রোডের গাড়ির হর্ন, রিকশার ঘণ্টা, মানুষের কোলাহল শুনে এবং আশপাশের ভবনের ছাদে নারী-পুরুষের বৈকালিক পদচারণা দেখে মুক্তির আকাঙ্ক্ষায় মনটা ব্যাকুল হয়ে উঠত। ওয়ার্ডে আমাদের দেখাশোনা করার জন্য কয়েকজন পুরাতন কয়েদি নিয়োজিত ছিল যাদের 'মেট' বলে ডাকা হতো। মেটদের কাছ থেকে কারাগারের নানা গল্প শুনতাম।
কারাগারে বন্দিদের কারও কারও কাছে রেডিও ছিল। আমরা বিবিসি, ভোয়া শুনতাম। মধ্য ফেব্রুয়ারির ছাত্র আন্দোলনের উত্তাল তরঙ্গ যে সারাদেশে ছড়িয়ে পড়েছিল, সে খবর আমরা বিদেশি সংবাদমাধ্যমের সাহায্যে জানতাম। এরই মধ্যে আমরা কারাগারের পরিবেশের সঙ্গে মোটামুটি খাপ খাইয়ে নিয়েছিলাম। মাঝে মধ্যে সম্ভাব্য সাজার দুশ্চিন্তা মনকে দুর্বল করে ফেললেও কৃতকর্মের জন্য পুলক অনুভূত হতো।
৮ মার্চ, ১৯৮৩, সন্ধ্যার পর কারাগারের একজন কর্মকর্তা এসে আমাদের মধ্যে ২০ জনের তালিকা পাঠ করে লকআপ থেকে বেরিয়ে আসতে বললেন। জানতে পারলাম 'ওপরের হুকুমে' আমাদের অফিসে ডেকে পাঠানো হয়েছে। কানাঘুষা শোনা গেল, আমাদের সম্ভবত ঢাকার বাইরে কোনো কারাগারে স্থানান্তর করা হতে পারে। অজানা আশঙ্কায় মনটা আচ্ছন্ন হয়ে গেল।
আনুমানিক রাত ৯টা নগাদ সব আশঙ্কার অবসান ঘটিয়ে আমাদের মুক্তির বারতা এসে পৌঁছাল। কিছু আনুষ্ঠানিকতা শেষে কারা কর্তৃপক্ষের কাছে গচ্ছিত আমার ঘড়ি এবং কিছু টাকা ফেরত নিয়ে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের লৌহকপাট দিয়ে যখন বেরিয়ে এলাম, তখন এক অনাবিল আনন্দে মনটা নেচে উঠল। আকাশের দিকে তাকিয়ে বুকভরে নিঃশ্বাস নিলাম। ঘড়িতে তখন রাত ১১টা। কালক্ষেপণ না করে একজন কারাসঙ্গীসহ রিকশায় চেপে বসলাম। রাতে নিকটবর্তী কোনো আত্মীয় বাড়িতে আশ্রয় নিতে হবে। হাতে বেশি সময় নেই। রাত ১২টা থেকে আবার কার্ফু্য আরম্ভ হবে।
লেখক: সাইফুল হাসান চৌধুরী, পরিচালক, জনসংযোগ বিভাগ, বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড
সূত্র: সমকাল