স্মার্ট বাংলাদেশ গড়তে জরুরি ডিজিটালাইজেশন - দৈনিকশিক্ষা

স্মার্ট বাংলাদেশ গড়তে জরুরি ডিজিটালাইজেশন

গাজী মোহাম্মদ এনামুল হক |

স্মার্ট বাংলাদেশ হলো বাংলাদেশ সরকারের একটি প্রতিশ্রুতি ও স্লোগান যা ২০৪১ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যে দেশকে ডিজিটাল বাংলাদেশ থেকে স্মার্ট বাংলাদেশে রূপান্তরের পরিকল্পনা। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ১২ ডিসেম্বর ২০২২ খ্রিষ্টাব্দে রাজধানীর বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রের (বিআইসিসি) অনুষ্ঠানে ডিজিটাল বাংলাদেশ দিবস-২০২২ উদ্যাপন উপলক্ষে আয়োজিত অনুষ্ঠানে সর্বপ্রথম ‘স্মার্ট বাংলাদেশ’ গড়ার কথা বলেন। ‘স্মার্ট বাংলাদেশ’ বলতে স্বাভাবিকভাবে বোঝায় প্রযুক্তিনির্ভর নির্মল ও স্বচ্ছ তথা নাগরিক হয়রানিবিহীন একটি রাষ্ট্র বিনির্মাণ প্রক্রিয়া। স্মার্ট সিটিজেন, স্মার্ট ইকনোমি, স্মার্ট গভর্নমেন্ট ও স্মার্ট সোসাইটি-এ শব্দগুলোর সঠিক বাস্তবায়নের মাধ্যমেই স্মার্ট বাংলাদেশ থিওরিকে বাস্তবে রূপায়ণ করা সম্ভব, যার মূল সারমর্ম হলো-দেশের প্রত্যেক নাগরিক প্রযুক্তি ব্যবহারে দক্ষ হবে, উইথ স্মার্ট ইকনোমি; অর্থাৎ, অর্থনীতির সব কার্যক্রম আমরা এ প্রযুক্তি ব্যবহার করে পরিচালনা করব। স্মার্ট গভর্নমেন্ট আর আমাদের গোটা সমাজটাই হবে স্মার্ট সোসাইটি।

ডিজিটাল বাংলাদেশের চারটি ভিত্তি ছিলো-মানবসম্পদের উন্নয়ন, ডিজিটাল সরকারব্যবস্থা, ডিজিটাল প্রযুক্তির মাধ্যমে জনগণের মধ্যে সংযোগ স্থাপন এবং অর্থনৈতিক উন্নয়নে তথ্য ও প্রযুক্তির বহিঃপ্রকাশ। আর স্মার্ট বাংলাদেশ ভিশন-২০৪১ এর ভিত্তি চারটি। এগুলো হচ্ছে-স্মার্ট নাগরিক, স্মার্ট অর্থনীতিম স্মার্ট সরকার এবং স্মার্ট সমাজ। স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণে এ চারটি নির্দিষ্ট ক্ষেত্রকে চিহ্নিত করে অগ্রসর হলে স্মার্ট বাংলাদেশে রূপান্তরের কোনো অবশিষ্ট থাকবে না। স্মার্ট নাগরিক ও স্মার্ট সরকার এর মাধ্যমে সব সেবা এবং মাধ্যম ডিজিটালে রূপান্তরিত হবে। আর স্মার্ট সমাজ ও স্মার্ট অর্থনীতি প্রবৃদ্ধি নিশ্চিত করলে অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজ গঠন এবং ব্যবসাবান্ধব পরিবেশ গড়ে তুলতে সহায়ক ভূমিকা পালন করবে।

 

‘স্মার্ট বাংলাদেশ হবে সাশ্রয়ী, টেকসই, জ্ঞানভিত্তিক, বুদ্ধিদীপ্ত ও উদ্ভাবনী। এক কথায় সব কাজই হবে স্মার্ট। যেমন-স্মার্ট শহর ও স্মার্ট গ্রাম বাস্তবায়নের জন্য স্মার্ট স্বাস্থ্যসেবা, স্মার্ট পরিবহন, স্মার্ট ইউটিলিটিজ, নগর প্রশাসন, জননিরাপত্তা, কৃষি, ইন্টারনেট সংযোগ ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করা। অনলাইনে শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে এক শিক্ষার্থী, এক ল্যাপটপ, এক স্বপ্নের উদ্যোগ নেয়ার কথা বলা হয়েছে। এর আওতায় সব ডিজিটাল সেবা কেন্দ্রীয়ভাবে সমন্বিত ক্লাউডের আওতায় নিয়ে আসা হবে। বাংলাদেশ সরকার ‘স্মার্ট বাংলাদেশ’ গড়ার লক্ষ্যে ৩০ সদস্যবিশিষ্ট ‘স্মার্ট বাংলাদেশ টাস্কফোর্স’ গঠন করেছে, যার চেয়ারপারসন হলেন প্রধানমন্ত্রী, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার। বাকি ২৯ জন সদস্য। 

২০৪১ খ্রিষ্টাব্দ নাগাদ একটি ‘স্মার্ট বাংলাদেশ’ গড়ে তোলা সরকারের নতুন রূপকল্প দ্রুত বাস্তবায়নে সারা বছর ধরে বিভিন্ন সরকারি সেবা সহজীকরণ করতে এটুআই বেশকিছু ডিজিটাল প্রোগ্রাম উদ্ভাবন ও বাস্তবায়ন করে সরকারকে ‘ভিশন-২০৪১’ এর সঙ্গে সংগতি রেখে একটি উদ্ভাবন ও জ্ঞান-ভিত্তিক ‘স্মার্ট বাংলাদেশ’ গড়ার নতুন লক্ষ্য গ্রহণ করতে উৎসাহ যুগিয়েছে। করোনা অতিমারির সংকটকালীন মুহূর্তেও ঘরে বসেই অনলাইনে নাগরিকরা প্রায় সকল ধরনের সেবা পেয়েছেন, যা ডিজিটাল বাংলাদেশরই সুফল। দেশের স্বাস্থ্য ও চিকিৎসা ব্যবস্থা থেকে শুরু করে শিক্ষা, অফিস-আদালত, ব্যাংক, সভা-সেমিনার, কনফারেন্স ইত্যাদি অনলাইনভিত্তিক করার পাশাপাশি নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি কেনাকাটা ঘরে বসেই করতে পেরেছেন। এ ছাড়া তথ্যপ্রযুক্তিকে ঘিরে করোনা বিষয়ক তথ্যসেবা, টেলিমেডিসিন সেবা, সুবিধাবঞ্চিতদের জন্য জরুরি খাদ্য সহায়তাও প্রদান করা হয়েছে। প্রযুক্তির এই সহজলভ্যতার কারণে সকল ধরনের বিল ও আর্থিক লেনদেন ঘরে বসেই অনলাইনের মাধ্যমে করা সম্ভব হচ্ছে। শুধু শহরেই নয়, বরং জেলা-উপজেলা সদর ছাড়িয়ে গ্রাম, এমনকি প্রত্যন্ত ও দুর্গম অঞ্চলেও তথ্যপ্রযুক্তি সেবা পৌঁছে যাচ্ছে। দেশ এখন ডিজিটাল বাংলাদেশ থেকে স্মার্ট বাংলাদেশে রূপান্তরিত হতে উদগ্রীব হয়ে আছে। 

এ প্রেক্ষিতে ২০২২ খ্রিষ্টাব্দ জুড়ে বেশকিছু উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। যেমন-ডিজিটাল প্রযুক্তি ব্যবহার করে সরকারের বিভিন্ন সেবা প্রদান এবং এসব সেবা গ্রহণে নাগরিকদের সম্পৃক্ত করার ইকোসিস্টেম তৈরিতে নতুন নতুন প্রকল্প বাস্তবায়ন করে বাংলাদেশ বিশ্বব্যাংকের ‘গভটেক লিডারস’ তালিকায় স্থান করে নিয়েছে। এ ছাড়া ই-পার্টিসিপেশনে ২০ ধাপ এগিয়ে ৭৫তম এবং জাতিসংঘের ই-গভর্নমেন্ট ডেভেলপমেন্ট ইনডেক্সে ৮ ধাপ এগিয়েছে বাংলাদেশ। ডব্লিউএসআইএস পুরস্কার ২০২২ চূড়ান্ত পর্বে এটুআই-এর ৪টিসহ বাংলাদেশের মোট ৯টি উদ্ভাবনী উদ্যোগে পুরস্কৃত হয়েছে। বিচারিক ব্যবস্থাকে সহজ করতে চালু হয়েছে অনলাইন কজলিস্ট, জুডিসিয়াল মনিটরিং ড্যাশবোর্ড এবং আমার আদালত (মাইকোর্ট) অ্যাপ। দেশীয় উদ্যোক্তাদের পণ্য সারা বিশ্বে ছড়িয়ে দিতে ‘একশপ গ্লোবাল’ এর যাত্রা শুরু। দেশব্যাপী কোরবানির পশু কেনাবেচায় ২য় বছরের মতো সকল খামারি ও হাটকে যুক্ত করে ডিজিটাল হাট চালু করা হয়। ই-কমার্স খাতকে বিশ্বস্ত করতে চালু করা হয় ইউবিআইডি’র নিবন্ধন এবং কেন্দ্রীয় অভিযোগ নিষ্পত্তি সিস্টেম। 

গাজী মোহাম্মদ এনামুল হক

বাংলাদেশি নাগরিকদের প্রবাস যাত্রা সহজ করতে এবং প্রবাসে যাওয়ার প্রস্তুতিমূলক কাগজপত্র ও সেবাসমূহ একটি ওয়ান স্টপ সার্ভিস পয়েন্ট থেকে প্রদানের লক্ষ্যে দেশব্যাপী ডিজিটাল সেন্টারগুলোতে প্রবাসী হেল্প ডেস্ক চালু করার উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। সরকারের আর্থিক অন্তর্ভুক্তি কার্যক্রম ত্বরান্বিত করা ও আর্থিক অন্তর্ভূক্তিতে নারীদের অংশগ্রহণ বৃদ্ধিতে এটুআই চালু করেছে ‘সাথী’ নামক একটি নেটওয়ার্ক। বাংলাদেশ ব্যাংক, আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ ও বিভিন্ন বাণিজ্যিক ব্যাংকের সহযোগিতায় এটুআই প্রাথমিক পর্যায়ে ডিজিটাল সেন্টারের নারী উদ্যোক্তা নিয়ে এই নেটওয়ার্কের যাত্রা শুরু করেছে। দেশের সকল পরিষেবা বিল, শিক্ষা সংক্রান্ত ফি ও অন্যান্য সকল ধরনের সরকারি সেবার ফি/বিল প্রদানের পদ্ধতি সহজ ও সমন্বিতকরণে চালু হওয়া সমন্বিত পেমেন্ট প্ল্যাটফরম ‘একপে’-তে বিভিন্ন ধরনের করতে নতুন ৮টি আর্থিক সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানের নতুন পেমেন্ট চ্যানেল যুক্তকরণ। জাতীয় তথ্য বাতায়নের অধীন সকল ওয়েবসাইটকে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের ব্যবহার উপযোগী করা হয়েছে। ২০২৩ শিক্ষাবর্ষ থেকে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি) এটুআই-কর্তৃক উদ্ভাবিত মাল্টিমিডিয়া টকিং বই প্রণয়ন ও এর উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। 

 

পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ যখন ৬-জি নিয়ে কাজ করছে তখনো আমরা ৫-জিতে যেতে পারিনি। আমাদের স্কিল ডেভেলপমেন্ট, ডাটা কমিউনিকেশন ডেভেলপমেন্ট ক্যাপাসিটি বাড়াতে হবে। স্মার্ট বাংলাদেশ গড়তে ইউনিভার্সিটিগুলোর সঙ্গে ইন্ডাস্ট্রির সমন্বয় এবং আইসিটি, তথ্য, টেলিকমসহ মিনিস্ট্রিগুলোকে স্টেকহোল্ডারদের সঙ্গে সমন্বয় করে কাজ করতে হবে। যদি আমার ঘর স্মার্ট না হয়, আমি যদি স্মার্ট না হই, তাহলে স্মার্ট বাংলাদেশও সম্ভব হবে না। এজন্য স্মার্ট এডুকেশন, স্মার্ট এগ্রিকালচারের প্রয়োজন। তাই সমন্বিতভাবে এগোতে হবে। স্মার্ট বাংলাদেশ গড়তে স্মার্ট ডিভাইস যারা ব্যবহার করেন তাদের স্মার্ট লিটারেসির প্রয়োজন। পাশাপাশি ইন্ডাস্ট্রি একাডেমিয়া লিংকেজ, স্মার্ট ডিভাইসের ক্ষেত্রে উচ্চ করহার তুলে দেয়া প্রয়োজন। আমাদের স্বচ্ছতা, কানেকটিভিটি ও দুর্নীতি দূর করতে স্মার্ট বাংলাদেশ প্রয়োজন। করের বোঝা একটু কম হলে আরও সাশ্রয়ী মূল্যে গ্রাহকদের ডেটা সেবা দেয়া সম্ভব। স্মার্ট বাংলাদেশ গড়তে মোবাইল অপারেটরদের বড় ভূমিকা রাখার সুযোগ আছে। এজন্য প্রয়োজনে ইনসেনটিভ দেয়া উচিত। বাংলাদেশের নিজস্ব প্রযুক্তি ও সক্ষমতা দিয়ে ভবিষ্যতে স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণের পরিকল্পনা এখন থেকেই গ্রহণ করতে হবে। তাই এ যাত্রায় আমরা যেনো পিছিয়ে না থাকি সেজন্য এজেন্সি ফর নলেজ অন অ্যারোনটিক্যাল অ্যান্ড স্পেস হরাইজন আকাশ প্রতিষ্ঠা করতে হবে। আমরা যেনো অনুমান করতে পারি যে ভবিষ্যতে কোনো কোনো নতুন প্রযুক্তির ব্যবহার বিশ্ব অর্থনীতিতে নেতৃত্ব দেবে এবং ধাপে ধাপে ২০২৫, ২০৩১ কিংবা ২০৪১ খ্রিষ্টাব্দের জন্য প্রয়োজনীয় ইমার্জিং, ফ্রন্টিয়ার কিংবা ফিউচার টেকনোলজিতে গুরুত্ব প্রদান করতে হবে। তবেই আমরা উন্নত দেশগুলোর মতো জাতীয় জিডিপির প্রায় ২০ শতাংশের বেশি প্রযুক্তি খাত থেকে অবদান রাখতে পারব। স্মার্ট সিটি ও স্মার্ট ভিলেজ বাস্তবায়নের জন্য স্মার্ট স্বাস্থ্যসেবা, স্মার্ট ট্রান্সপোর্টেশন, স্মার্ট ইউটিলিটিজ, নগর প্রশাসন, জননিরাপত্তা, কৃষি, ইন্টারনেট কানেক্টিভিটি ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করতে হবে। এজন্য আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স, রোবটিক্স, মাইক্রোচিপ ডিজাইনিং অ্যান্ড ম্যানুফ্যাকচারিং ও সাইবার সিকিউরিটি এই চারটি প্রযুক্তিতে আমাদের মনোযোগী হতে হবে। কেন্দ্রীয়ভাবে সমন্বিত ক্লাউডে থাকবে সব ডিজিটাল সেবা। ডাটা নিরাপত্তা আইন, ডিজিটাল সার্ভিস আইন, শেখ হাসিনা ইনস্টিটিউট অব ফন্ট্রিয়ার টেকনোলজি (শিফট) আইন, ইনোভেশন ডিজাইন অ্যান্ড এন্ট্রাপ্রেনারশিপ অ্যাকাডেমি (আইডিয়া) আইন, এজেন্সি ফর নলেজ অন অ্যারোনটিক্যাল অ্যান্ড স্পেস হরাইজন (আকাশ) আইন, ডিজিটাল লিডারশিপ অ্যাকাডেমি আইন ও জাতীয় স্ট্যার্টআপ পলিসি প্রণয়ন করতে হবে। স্মার্ট বাংলাদেশ কীভাবে ২০৪১ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যে বাংলাদেশকে উন্নত রাষ্ট্রে পরিণত করতে পারে, সে বিষয়ে সুস্পষ্ট পরিকল্পনা প্রয়োজন। এ লক্ষ্যে তথ্যপ্রযুক্তির মাধ্যমে জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলা, কারিগরি শিক্ষার প্রসার, ইকোসিস্টেম পুনরুদ্ধার, পরিবহণ ও যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন, বিদ্যুৎ সরবরাহ, কর্মসংস্থান, কৃষিজমির সীমানির্ধারণ, পোকামাকড় ও রোগবালাই দমন, জমি ক্রয়-বিক্রয়ে ডিজিটাল সিস্টেম, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি নিয়ন্ত্রণ, কৃষিপণ্য উৎপাদনে প্রযুক্তিগত সেবা প্রদান নিশ্চিতকরণ, উৎপাদন থেকে বাজারজাতকরণ পর্যআন্ত পণ্যের গুণগত মান নিয়ন্ত্রণ, পরিবেশগত উষ্ণতা নিয়ন্ত্রণে করণীয়, স্বাস্থ্যসেবা ও প্রতিটি নাগরিকের নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ নাগরিকদের স্মার্ট হিসাবে গড়ে তুলতে সহায়ক হতে পারে। 

পরিসংখ্যান অনুযায়ী, বাংলাদেশে ২০২৩ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যে আরো ২০ লাখ মানুষ বাড়তে পারে। বর্তমানে দেশের ৫০ শতাংশের বেশি মানুষ স্মার্টফোন ব্যবহার করছে। ধারণা করা হচ্ছে, ২০২৫ খ্রিষ্টাব্দের ভ্রিষ্টাব্দের মধ্যে ৬৩ শতাংশের বেশি মানুষ স্মার্টফোন ব্যবহারের আওতায় আসবে। স্মার্ট নাগরিকদের কারিগরি ও প্রযুক্তিগত শিক্ষার গুরুত্ব অপরিসীম। তথ্য ও উপাত্ত বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, যুক্তরাষ্ট্রে কারিগরি ও প্রযুক্তিগত শিক্ষা অন্যান্য দেশের তুলনায় অনেক বেশি। যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রযুক্তি উদ্ভাবনের ক্ষমতা রয়েছে। দেশটিতে কম্পিউটার সায়েন্স, আইন, কৃষি, ব্যবসা ও প্রকৌশলীর ওপর ব্যাপক গুরুত্ব দেয়া হয়। ফলে গ্র্যাজুয়েটরা সাধারণ শিক্ষার পাশাপাশি কারিগরি শিক্ষা অর্জনে সক্ষম হচ্ছে। সুতরাং, স্মার্ট বাংলাদেশে প্রযুক্তিগত শিক্ষার বিকল্প নেই। সেক্ষেত্রে প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যান্ত উন্নত দেশের মতো কারিগরি ও প্রযুক্তিগত শিক্ষার গুরুত্ব বাড়াতে হবে। এ লক্ষ্যে পৌঁছাতে হলে শিক্ষক নিয়োগ, কোর্স কারিকুলাম, ক্লাসরুমে গবেষণাভিত্তিক শিক্ষাব্যবস্থা, প্রযুক্তি উদ্ভাবন ও বিস্তারে নৈতিকতার গুরুত্ব বাড়াতে হবে। তাছাড়া, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে অনলাইনে উচ্চশিক্ষা ও উদ্ভাবিত প্রযুক্তি মাঠ পর্যায়ে জনগণের কাছে হস্তান্তরের বিষয়ে গুরুত্ব বাড়াতে হবে। উদ্ভাবিত প্রযুক্তি দ্বারা জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলা করে কীভাবে ভেজালবিহীন খাদ্য উৎপাদন বাড়ানো যায়, সেদিকেও নজর দিতে হবে। এ লক্ষ্যে সরকার, রাজনীতিক, জনগণ ও গবেষকদের সমন্বয়ের প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। 

স্মার্ট বাংলাদেশে নাগরিকদের আগামী ৩০ বছর জলবায়ু পরিবর্তনে সৃষ্ট ক্ষতিকর প্রভাব মোকাবিলায় প্রস্তুত করতে হবে। নতুবা প্রাকৃতিক ভারসাম্যহীনতায় খাদ্য ঘাটতি ও পরিবেশের বিপর্যয় দেখা দেয়ার আশঙ্কা রয়েছে। জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় ‘ক্লাইমেট স্মার্ট লাইভেলিহুড’ মডেল তৈরি করা যেতে পারে। এ মডেলে জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় প্রথমত, জনগণকে স্থানীয় নেতিবাচক প্রভাবগুলোর প্রতি স্থিতিস্থাপক হতে হবে। উদাহরণস্বরূপ, লবণাক্ত এলাকায় এমন কিছু প্রযুক্তি প্রয়োগ করা উচিত, যা মাটিতে লবণের পরিমাণ কমাতে সাহায্য করবে। দ্বিতীয়ত, জলবায়ু পরিবর্তনে অবদান রাখবে এমন কোনো প্রযুক্তি ব্যবহার করা যাবে না। উদাহরণস্বরূপ, পরিবেশ বা খাদ্যে বিষাক্ততা সৃষ্টি করে এমন কোনো রাসায়নিক দ্রব্যাদি বা কীটনাশক ব্যবহার করা যাবে না। তৃতীয়ত, টেকসই জীবনযাপনে গুরুত্ব বাড়াতে হবে। এতে স্থানীয় জনগণ পরিবেশ সংরক্ষণে জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলা করে আর্থিকভাবে স্বাবলম্বী হতে পারবে। চতুর্থত, ক্লাইমেট স্মার্ট প্রযুক্তি এমন হতে হবে, যেখানে সমাজের মানুষ খুব কম বিনিয়োগেই পরিবেশ সংরক্ষণে ভূমিকা রাখতে পারবে। উপরোক্ত বিষয়গুলোর বাস্তব প্রয়োগ হলেই বাংলাদেশকে পরিবেশবান্ধব ক্লাইমেট স্মার্ট দেশে পরিণত করবে বলে আশা করা যায়। অন্যদিকে, বনায়ন ও ইকোসিস্টেমের ভারসাম্য কীভাবে সংরক্ষণ করা যায়, সে বিষয়ে জনগণকে প্রযুক্তিগত তথ্যের অবাধ সরবরাহ নিশ্চিত করতে হবে। ‘স্মার্ট বাংলাদেশ’ গঠনে ‘স্মার্ট সরকারের’ গুরুত্বও বিবেচনায় আনতে হবে। সরকারের অধীনস্থ মন্ত্রণালয়, অধিদপ্তর ও স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান কর্তৃক জনগণকে নিরবচ্ছিন্ন সেবা প্রদানই স্মার্ট সরকারের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। খাদ্য উৎপাদন, বাসস্থান, শিক্ষা, ব্যবসা, চিকিৎসা, ভূমি ক্রয়-বিক্রয়সহ সব সেবাই সরকার কর্তৃক জনগণকে কোনো ধরনের বাধা ব্যতীত সঠিক সময়ে পৌঁছে দিতে হবে। যদিও বর্তমান সরকারের উল্লেখযোগ্যসংখ্যক সেবা ডিজিটাল সিস্টেমে জনগণ কর্তৃক গৃহীত হচ্ছে; কিন্তু উন্নত দেশের তুলনায় তা অনেকটা কম। 

এখন প্রশ্ন হচ্ছে, স্মার্ট বাংলাদেশের ঘোষণা দিলেই তো আর স্মার্ট বাংলাদেশের রূপান্তর ঘটবে না। দেড় যুগ আগে ডিজিটাল বাংলাদেশের সূচনা হলেও দেশের ব্যাংক খাত প্রযুক্তিনির্ভর হলেও রয়েছে সমন্বয়হীনতা। সরকারের সদিচ্ছা থাকলেও সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো যেনো দেশকে ডিজিটাল ও স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ার পরিকল্পনাকে বারবার বৃদ্ধাঙ্গুলী দেখাতে চাইছে। ফলে, সেবাগুলো যেনো বারবার মুখ থুবড়ে পড়ছে। নামেমাত্র চলছে ডিজিটাল কার্যক্রম। দেশের প্রতিটি মন্ত্রণালয়, বিভাগ, জেলা, উপজেলা, ইউনিয়ন, স্কুল-কলেজ, মাদ্রাসায় ওয়েবসাইট থাকলেও তার সঠিক ব্যবহার না হওয়ায় সেবাগুলো জনগণের দোরগোড়ায় পৌঁছাচ্ছে না। চলছে সেবার নামে হয়রানি। ভূমি অফিসসহ প্রায় সকল সরকারি প্রতিষ্ঠানে খোদাই করে লেখা আছে আর্থিক লেনদেন ছাড়াই সেবার নোটিশ। অথচ, কাজ করতে গেলে দেখা যায় ঠিক তার বিপরীত চিত্র। ঘুষ দেবেন না তো মরেছেন। ঘুরতে-ঘুরতে আর অফিস কর্মীদের রূঢ় আচরণে সাধারণ মানুষের নাভিশ্বাস উঠে যায়। এমন সেবা স্মার্ট, স্বচ্ছ ও সোনার বাংলাদেশ বিনির্মাণের পথে অবশ্যই অন্তরায় সৃষ্টি করছে। এসব ব্যাপারে সরকারকে আরো তৎপর ও আন্তরিক হতে হবে। মনে রাখতে হবে, এটি এক বিশাল কর্মযজ্ঞ; যা সরকার, সরকারি-বেসরকারি, স্বায়ত্ত্বশাসিত প্রতিষ্ঠানসহ সর্ব সাধারণ এক মন নিয়ে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ না করলে লক্ষ্য অর্জন সহজতর হবে না। সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য নির্ধারণ এবং সেই লক্ষ্যে পৌঁছতে থাকা চাই সঠিক এবং বাস্তবসম্মত রোডম্যাপ। সরকার সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্তই নিয়েছে এবং এই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে সরকারের আন্তরিকতা এবং সদিচ্ছার কোনো কমতি থাকবে না, কিন্তু এই বিশাল কর্মযজ্ঞ বাস্তবায়নের দায়িত্বে যারা নিয়োজিত থাকবেন তাঁদের দক্ষতা, আন্তরিকতা, সেবার মানসিকতা, দূরদৃষ্টি এবং মুনশিয়ানার ওপরই নির্ভর করবে ২০৪১ খ্রিষ্টাব্দ নাগাদ সত্যিকার স্মার্ট বাংলাদেশ হবে, নাকি সম্পূর্ণ প্রযুক্তিনির্ভর, না ম্যানুয়াল পদ্ধতির এক এলোমেলো স্মার্ট বাংলদেশ হবে । 

পরিশেষে বলা যায়, স্মার্ট বাংলাদেশ গঠনে স্মার্ট সিটিজেন, স্মার্ট সরকার, স্মার্ট অর্থনীতি ও স্মার্ট সমাজব্যবস্থা একে অপরের পরিপূরক। সরকার, স্মার্ট বাংলাদেশ গঠনে সচেতন হলেও জনগণের সাহায্য ছাড়া কখনো স্মার্ট দেশে রূপান্তর সম্ভব নয়। পরিবেশ সংরক্ষণকে প্রাধান্য দিয়ে উন্নত ও টেকসই প্রযুক্তিই বাংলাদেশকে ‘স্মার্ট বাংলাদেশে’ রূপান্তর করতে পারে। তাই সত্যিকার স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ে তুলতে হলে ডিজিটাল বাংলাদেশের পরিপূর্ণতা দিতে হবে সবার আগে এবং এর ওপর ভিত্তি করেই স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণের গতি বেগবান হবে।

লেখক: সিনিয়র প্রভাষক, সমাজবিজ্ঞান বিভাগ, সরকারি ফুলতলা মহিলা কলেজ, খুলনা

 

কাল খুলছে সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, শনিবারও চালু ক্লাস - dainik shiksha কাল খুলছে সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, শনিবারও চালু ক্লাস সরকারি কলেজ মসজিদের ইমাম, মুয়াজ্জিন ও খাদিমের চাকরি জাতীয়করণ দাবি - dainik shiksha সরকারি কলেজ মসজিদের ইমাম, মুয়াজ্জিন ও খাদিমের চাকরি জাতীয়করণ দাবি উপবৃত্তির সব অ্যাকাউন্ট নগদ-এ রূপান্তরের সময় বৃদ্ধি - dainik shiksha উপবৃত্তির সব অ্যাকাউন্ট নগদ-এ রূপান্তরের সময় বৃদ্ধি শিক্ষকের বেতন ও শিক্ষার্থীদের ঝরে পড়া রোধে কাজ চলছে: শিক্ষামন্ত্রী - dainik shiksha শিক্ষকের বেতন ও শিক্ষার্থীদের ঝরে পড়া রোধে কাজ চলছে: শিক্ষামন্ত্রী বিএসসি মর্যাদার দাবিতে ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ারদের মাসব্যাপী কর্মসূচি - dainik shiksha বিএসসি মর্যাদার দাবিতে ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ারদের মাসব্যাপী কর্মসূচি কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে ১৩ বছরের কম বয়সী শিশুদের হাতে স্মার্টফোন নয় - dainik shiksha ১৩ বছরের কম বয়সী শিশুদের হাতে স্মার্টফোন নয় একই স্কুলের দুই ছাত্রীকে বিয়ের পর আরেক ছাত্রীকে ল্যাব সহকারীর অনৈতিক প্রস্তাব - dainik shiksha একই স্কুলের দুই ছাত্রীকে বিয়ের পর আরেক ছাত্রীকে ল্যাব সহকারীর অনৈতিক প্রস্তাব দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে এসএসসি পরীক্ষার ফল প্রকাশ ১২ মে - dainik shiksha এসএসসি পরীক্ষার ফল প্রকাশ ১২ মে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0032651424407959