হাসান আজিজুল হক স্যারকে হারিয়ে আমরা এখন একা : ড. জাফর ইকবাল - দৈনিকশিক্ষা

হাসান আজিজুল হক স্যারকে হারিয়ে আমরা এখন একা : ড. জাফর ইকবাল

মুহম্মদ জাফর ইকবাল |

পুরো করোনার সময় একটা বাসার চার দেয়ালের ভেতরে আটকা থেকে সময় কাটিয়েছি। তখন বসে বসে নানা কিছু চিন্তা করেছি, তার মাঝে একটা ছিল করোনার উপদ্রব শেষ হওয়ার পর কী করব, তার নানা রকম পরিকল্পনা। সবচেয়ে বড় কল্পনাটা ছিল রাজশাহী গিয়ে হাসান আজিজুল হক স্যারের সাথে দেখা করে তার সাথে কিছুক্ষণ কথা বলে আসা। স্যারের সাথে অনেকবার দেখা হয়েছে, অনেকবার কথা হয়েছে, কিন্তু আর কেউ নেই শুধু আমি আর স্যার, তার সাথে বসে সাহিত্য, দেশ, ইতিহাস, রাজনীতি এইসব সিরিয়াস বিষয় নিয়ে কথা বলার একটা ছেলেমানুষী সখ ছিল। যত সময় গিয়েছে, সেটা নিয়ে আমার সেই সখটা অনেক বেড়ে গিয়েছিল।

খবর পেয়েছিলাম স্যারের শরীরটা ভালো যাচ্ছে না, তার ছেলের বক্তব্য থেকে জানতে পেরেছিলাম তার স্মৃতিশক্তিও কমে আসছে, অনেক সময় পরিচিত মানুষজনকে চিনতে পারেন না। তারপর দেখলাম স্যারকে চিকিৎসার জন্য ঢাকা নিয়ে আসা হয়েছে, খুব ভয় পেয়েছিলাম তখন। তার ছেলের কাছে স্যারের খোঁজ নিয়েছি। করোনার সময়টিতে আমরা আইসিইউ নামে একটা ভয়ংকর শব্দ শিখেছি। দেখে আসছি একবার কেউ তার ভেতরে গেলে প্রায় কখনোই বেঁচে ফিরে আসছেন না। স্যার কিন্তু সুস্থ হয়ে বের হয়ে এসেছেন, আবার রাজশাহী ফিরে গিয়েছেন দেখে অনেক শান্তি পেয়েছিলাম। শুধু তাই না কয়েক সপ্তাহ আগে দেখলাম স্যার পত্রিকায় একটি লেখা দিয়েছেন, লেখার বিষয়বস্তুটুকু আমাকে যতটুকু আনন্দ দিয়েছে, তার থেকে বেশি আনন্দ দিয়েছে স্যার আবার লিখছেন, সেই তথ্যটুকু। আমি যখন রাজশাহী যাওয়ার কথা চিন্তা করছি, তখন একেবারে হঠাৎ করে জানতে পারলাম স্যার আমাদের ছেড়ে চলে গিয়েছেন। হঠাৎ করে মনে হলো একেবারে একা হয়ে গেছি। আমাদের বুঝি দেখেশুনে রাখার আর কেউ নেই।

বহুকাল আগে একবার রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে গেছি। তখন সময়টা ভালো না, দেশ থেকে মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি, বঙ্গবন্ধুর অবদান এসব কিছুকে নির্বাসন দেওয়া হয়েছে। সেই দুঃসময়ে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের ছেলেমেয়েরা মিলে মুক্তিযুদ্ধের জন্য ভালোবাসাটুকু ধরে রাখার জন্য একটা সংগঠন করেছে। সেই বাচ্চা ছেলেমেয়েরা আমাকে ডেকেছে, আমি তাদের সাথে কথাবার্তা বলছি। হঠাৎ করে দেখি সেই বাচ্চা ছেলেমেয়েদের মাঝে একজন বড় মানুষ- খবর পেয়ে হাসান আজিজুল হক স্যার চলে এসেছেন। দেশের বাইরে ছিলাম বলে দেশের এই বড় বড় কবি, সাহিত্যিক, শিল্পীদের সাথে আমার পরিচয় নেই, তার উপর সবাই ঢাকাকেন্দ্রিক, শুধু স্যার রাজশাহী থাকেন! স্যারের সাথে পরিচয় হলো, কথা হলো। তারপর থেকে যতবার রাজশাহী গিয়েছি স্যারের সাথে একটিবার হলেও দেখা করে এসেছি, স্যার হাসিমুখে আমার যন্ত্রণা সহ্য করেছেন।

আমি সিলেটের শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ে, অভ্যাস অনুযায়ী মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে কথাবার্তা বলে জামায়াত-শিবিরের চক্ষুশূল হয়ে আছি। দুইদিন পরে পরেই আমাকে নিয়ে ঝামেলা হয়, কখনো বাসায় বোমা পড়ে, কখনো ফাঁসির দাবি, কখনো আমার বিরুদ্ধে আন্দোলন- স্যার প্রতিবার রাজশাহী থেকে আমাকে ফোন করেন, সাহস দেন। আমার পাশে আছেন বলে আমিও ভরসা পাই, বাড়াবাড়ি করছি কিনা জানি না, কিন্তু ভুল করছি না, সেই বিষয়টা বুঝতে পারি।

এই দেশে যারা থেকেছে, মুক্তিযুদ্ধের জন্য ভালোবাসাটুকু ধরে রাখার জন্য তাদের সবাইকেই কাজ করতে হয়েছে, সেজন্য ঝামেলাও কম হয়নি। কাজেই বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক হওয়ার পরও স্যারের পরিচয় শুধু অধ্যাপক নয়, বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রগতিশীল চেতনার একজন অভিভাবকও। এত কিছুর পরেও স্যারের সবচেয়ে বড় পরিচয় হচ্ছে লেখক। আমি নিজে আমার ছেলেমানুষী লেখার চেষ্টা করি বলে আমি বুঝতে পারি আমরা কেন দায়সারা লেখক আর স্যার কেন সত্যিকারের লেখক- শুধু লেখক নয়, বড় লেখক! খুব বেশি লিখেননি কিন্তু যেটুকু লিখেছেন একেবারে খাঁটি সোনা। দেখে ভালো লাগে যে স্যারের লেখার জন্য দেশে এবং দেশের বাইরে তাকে ঠিকভাবে মূল্যায়ন করা হয়েছে।

বহুদিন আগে এলিস ওয়াকারের লেখা ‘দি কালার পারপল’ নামে একটা উপন্যাস পড়েছিলাম (আমার ধারণা এই নামে তৈরি চলচ্চিত্রটি মূল বই থেকে বেশি পরিচিত)। যারা মূল বইটি পড়েছেন, তারা জানেন এই বইয়ের ভাষা কিন্তু আমাদের পরিচিত ইংরেজি নয়, আমেরিকান কালো মানুষদের নিজস্ব এক ধরনের ভাষা। প্রথম এক দুই পৃষ্ঠা পড়লেই এই ভাষাটিতে অভ্যস্ত হয়ে যাওয়া যায়, তখন এই নূতন ভাষাটিকে রীতিমতো মিষ্টি একটি ভাষা বলে মনে হতে থাকে। আমাদের বাংলা ভাষায় লেখা বইয়েও কেউ এক দুইটি সংলাপ নয় পুরো বইটি এভাবে লিখেছেন কিনা আমার সেটি নিয়ে কৌতূহল ছিল।

হাসান আজিজুল হক স্যারের ‘আগুনপাখি’ বইটি পড়ে আমার সেই অতৃপ্তিটুকু প্রথমবার পূরণ হয়েছে। প্রমিত ভাষায় বই পড়ে পড়ে হঠাৎ করে একটা স্থানীয় আঞ্চলিক ভাষায় একটা মেয়ের জবানিতে পুরো বইটুকু পড়ে মনে হয় সামনে বুঝি একটা নূতন দিগন্ত খুলে গিয়েছে। বইয়ের ভাষা হচ্ছে মাত্র একটি দিক, বইটিতে সেই সময়ের এত নিখুঁত এবং এত মানবিক একটি ইতিহাস উঠে এসেছে যে তার তুলনা নেই। ব্রিটিশ উপনিবেশ, দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ, আমাদের দেশে যে ভয়াবহ অবস্থা তৈরি করেছিল, তার একটা অসাধারণ বাস্তব ছবি এই বইয়ে পরম মমতায় তুলে ধরা হয়েছে, সেটি না পড়া পর্যন্ত কেউ বুঝতে পারবে না। স্যারের সাথে যতবার দেখা হয়েছে, প্রত্যেকবার সাধারণ কথাবার্তা হয়েছে কিন্তু আমার মনের গহিনে একজন সত্যিকার সাহিত্যিকের সাথে সাহিত্য নিয়ে কথা বলার একটা গোপন বাসনা ছিল। সেই বাসনাটুকু বাসনা হিসেবেই থেকে গেল।

হাসান আজিজুল হক স্যারের মেধাবী ছেলেটি আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক হিসেবে যোগ দেওয়ার জন্য ইন্টারভিউ দিতে এসেছিল। সে যোগ্য প্রার্থী ছিল, এখন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক কিন্তু সেই সময়টিতে হাসান আজিজুল হকের পুত্র হওয়ার অপরাধে এখানে নিয়োগ পায়নি, যদিও বিশ্ববিদ্যালয়ে তার মতো একজনের খুবই প্রয়োজন ছিল। তখন তার সাথে পরিচয় হয়েছিল এবং তার কাছে স্যারের অনেক গল্প শুনেছি। তার কাছে জেনেছি স্যারের হাতের লেখা নাকি খুবই দুর্বোধ্য, যারা তার হাতের লেখার সাথে পরিচিত নন, তাদের কাছে মনে হবে স্যার বুঝি কলম দিয়ে কাগজে দাগ দিয়ে গিয়েছেন, মাঝে মাঝে শুধু কলমটি একটু উপরে নিচে করেছেন! শুধুমাত্র সে তার হাতের লেখা মর্মোদ্ধার করতে পারে! আমি স্যারের হাতের লেখা দেখিনি, তাই কথাটুকু কতটুকু বাবাকে নিয়ে কৌতুক, কতটুকু সত্যি কখনো যাচাই করে দেখতে পারিনি! হাতের লেখা যে রকমই হয়ে থাকুক, সেই লেখা দিয়ে তিনি যে অসাধারণ লেখাগুলো লিখে গিয়েছেন, তার জন্য আমরা সবসময়ই স্যারের প্রতি কৃতজ্ঞ থাকব।

আমি জানি স্যার পরিণত বয়সে একটি পূর্ণাঙ্গ জীবন শেষে অসাধারণ কালজয়ী কিছু লেখা আমাদের উপহার দিয়ে, একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে নিজেই একটি প্রতিষ্ঠান হিসেবে থেকে দেশের অসংখ্য মানুষের অভিভাবক হয়ে আত্মীয় পরিজন গুণগ্রাহীদের মাঝ থেকে বিদায় নিয়েছেন। আমাদের হয়তো দীর্ঘশ্বাস ফেলে এটা মেনেই নিতে হবে।

কিন্তু যখন মনে হয়, তিনি আর নেই, তখনই মনে হয় এখন আমরা একা। একেবারেই একা।

লেখক : মুহম্মদ জাফর ইকবাল, কথাসাহিত্যিক, অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, সিলেট

মুজিবনগর দিবসে সব স্কুল-কলেজে আলোচনা - dainik shiksha মুজিবনগর দিবসে সব স্কুল-কলেজে আলোচনা মেয়াদোত্তীর্ণ শিক্ষক নিবন্ধন সনদের ফটোকপি পোড়ানো কেমন প্রতিবাদ! - dainik shiksha মেয়াদোত্তীর্ণ শিক্ষক নিবন্ধন সনদের ফটোকপি পোড়ানো কেমন প্রতিবাদ! স্কুলের অর্থ আত্মসাৎ, প্রধান শিক্ষক গ্রেফতার - dainik shiksha স্কুলের অর্থ আত্মসাৎ, প্রধান শিক্ষক গ্রেফতার শিক্ষা অধিদপ্তরে ডিজির রুটিন দায়িত্ব, জিয়া পরিষদ সদস্যদের পোয়াবারো! - dainik shiksha শিক্ষা অধিদপ্তরে ডিজির রুটিন দায়িত্ব, জিয়া পরিষদ সদস্যদের পোয়াবারো! জাল সনদে শিক্ষকের একযুগ চাকরির অভিযোগ - dainik shiksha জাল সনদে শিক্ষকের একযুগ চাকরির অভিযোগ ‘পুরো মুসলিম বিশ্ব ফিলিস্তিনের স্বাধীনতা উদযাপন করবে’ - dainik shiksha ‘পুরো মুসলিম বিশ্ব ফিলিস্তিনের স্বাধীনতা উদযাপন করবে’ কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0055570602416992